ঢাকা, বুধবার, ৩১ চৈত্র ১৪৩১, ১৫ মে ২০২৪, ০৬ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

ভুয়া লাইসেন্স তৈরি: ১০ বছরে মোস্তফা হাতিয়ে নেয় ৩ কোটি টাকা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৮ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২২
ভুয়া লাইসেন্স তৈরি: ১০ বছরে মোস্তফা হাতিয়ে নেয় ৩ কোটি টাকা

ঢাকা: ১৯৯২ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের (এইচএসসি) গণ্ডি পার হয়ে বরিশালের উজিরপুর থেকে ঢাকা আসেন গোলাম মোস্তফা (৬০)। ঢাকার একটি ডেন্টাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে এক বছর এক্স-রে মেশিন টেকনিশিয়ানের প্রশিক্ষণ নেয়।

এরপর তিনি একটি ডায়াগনেস্টিক ক্লিনিকে ৫-৭ বছর এক্সরে মেশিন টেকনিশিয়ান হিসেবে চাকরিও করেন।

২০০০ সালে তিনি নিজে একটি এক্সরে মেশিন নিয়ে ছোট দোকান শুরু করেছিলেন। সেসঙ্গে লেগুনা গাড়ি কিনে শুরু করেন ব্যবসাও। লেগুনা থাকার সুবাদে তিনি প্রায় বিআরটিএ অফিসে যাতায়াত করতেন। পরে ২০১০ সালে প্রতারণার সঙ্গে জড়িয়ে যান গোলাম মোস্তফা। তৈরি করেন একটি সিন্ডিকেট। এরপর তিনি একাধিক লেগুনা গাড়ি নামায়। একইসঙ্গে ভুয়া এনআইডি কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ডর জাল সার্টিফিকেট তৈরি এবং জালিয়াতি শুরু করেন তিনি। এসব প্রতারণা ও জালিয়াতির অপরাধে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। এসব মামলায় একাধিকবার কারাবরণ করেছেন ওই প্রতারক গোলাম মোস্তফা।

শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অনলাইনে চটকদার বিজ্ঞাপণের মাধ্যমে বিভিন্ন দ্রব্য বেচাকেনার পাশাপাশি মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ভুয়া এনআইডি কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, বিভিন্ন ধরনের জাল সনদ তৈরি করে আসছিলেন প্রতারক গোলাম মোস্তফা। গত ১০ বছরে জালিয়াতি ও প্রতারণার করে তিন কোটির বেশি টাকা হাতিয়ে নেয় একটি চক্রটি।

মঙ্গলবার (২২ মার্চ) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাজধানীর কারওয়ানবাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। সম্প্রতি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ২১ মার্চ রাজধানীর মালিবাগ, বাসাবো, শাহজাহানপুর ও কোতোয়ালী থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে ভুয়া এনআইডি কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স ও বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ডর জাল সার্টিফিকেট তৈরি এবং জালিয়াতি চক্রের মূলহোতা গোলাম মোস্তফাসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৩)।

গ্রেফতার প্রতারকচক্রের বাকি সদস্যরা হলেন- জালাল বাশার (৫৪), মুসলিম উদ্দিন (৬৫), মিনারুল ইসলাম (মিন্নি) (২২) ও তারেক মৃধা (২১)। অভিযানে তাদের হেফাজত থেকে ২টি কম্পিউটার, ২ হাজার ৪৬০টি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের জাল প্রাপ্তি স্বীকার রশিদ, ২৬টি ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, ১টি ল্যাপটপ, ১টি ডিজিটাল ক্যামেরা, ১৮টি ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স, ৮০টি সাদা রঙের প্লাস্টিকের ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্স তৈরির ব্লাঙ্ক কার্ড, ৫০টি স্বচ্ছ কার্ড হোল্ডার, ২ রিল সিকিউরিটি লেমিনেটিং পেপার যা দিয়ে জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স ও জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা যায়, ১টি কার্ড প্রিন্টার, ৪টি সফ্টওয়্যারের সিডি, ৪টি পেনড্রাইভ, ৫টি মোবাইলফোন এবং নগদ ২ হাজার ৮শ টাকা।
খন্দকার আল মঈন বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক (রোহিঙ্গা) এক শ্রেণির অসাধু চক্রের মাধ্যমে ভুয়া এনআইডি কার্ড পাওয়া যায়। এছাড়া কয়েকজন জঙ্গি সদস্য আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে ভুয়া এনআইডি কার্ডের মাধ্যমে পাসপোর্ট তৈরি করে বিভিন্ন দেশে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। এমন অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছে। এছাড়াও আমরা বেশকিছু পলাতক আসামি গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। সেখানে আমরা দেখেছি, তারা নিজেদেরকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য ভিন্ন নামে ভুয়া এনআইডি কার্ড তৈরি করে নিজের প্রকৃত পরিচয় আড়াল করে অন্যত্র বসবাস করছেন। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে বেশ কয়েকটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমরা ঘাতক পরিবহনের চালকদের গ্রেফতারে দেখেছি তাদের অনেকেই অপরিপক্ক চালক এবং তারা ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স সংগ্রহ করে এসব পরিবহন চালাচ্ছিলেন। এসব বিষয়ে সামনে আসায় আমরা গোযেন্দা নজরদারি বাড়িয়েছি।  

তিনি বলেন, এই ধারাবাহিকতায় রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে প্রতারণা ও জালিয়াতি চক্রের মূলহোতাসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার আসামিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে ৫-৭ জনের একটি চক্র গড়ে ওঠে। তারা গত ৮-১০ বছর ধরে ভুয়া এনআইডি কার্ড, ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জাল সার্টিফিকেট ও অন্যান্য জাল নথিপত্র তৈরি করে আসছিলেন।

ওই কর্মকর্তা বলেন, চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন নির্বাচন অফিস ও বিআরটিএ অফিসের সামনে অবস্থান করে গ্রাহকদের টার্গেট করতেন। পরে তাদেরকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স ও জাতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে টাকা নিতো এবং প্রতারিত করতেন। চক্রের সদস্যরা বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জনের জন্য তারা হুবহু জাল প্রাপ্তি স্বীকারপত্র ও মানি রিসিটটি বিআরটিএ ও বিভিন্ন ব্যাংকসহ ভুয়া সিল ও সই ব্যবহার করে গ্রাহককে দিতেন। চক্রটি প্রতিটি ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য গ্রাহকদের কাছ থেকে ৩-৪ হাজার টাকা নিতো।  তবে, দ্রুত এনআইডি/ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা ৮-১০ হাজার টাকা নিয়ে থাকতো। টাকা নিয়ে চক্রটি ৩-৭ দিনের মধ্যে ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স/এনআইডি সরবরাহ করার নিশ্চয়তা দিতেন। তবে, টাকা লেনদেরে ক্ষেত্রে চক্রটি মোবাইল ব্যাংকিং বা সরাসরি লেনদেন করতেন।

খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেফতার মিনারুল ২০২০ সালে জামালপুরের একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে টেক্সটাইল ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। সে গত এক বছর ধরে এই চক্রের সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি কম্পিউটার এক্সপার্ট এবং ভুয়া এনআইডি কার্ড ও ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ জাল সার্টিফিকের তৈরির ক্ষেত্রে গ্রাফিক্স ও ডিজাইনের কাজ করতেন। অপরদিকে চক্রের সদস্য মুসলিম জন্ম থেকেই ঢাকায় বসবাস করছেন। তিনি প্রাথমিকভাবে লেগুনাসহ বিভিন্ন সিএনজিচালক হিসেবে কাজ করছেন। গত ৮-১০ বছর ধরে তিনি পুরাতন মোটরসাইকেল কেনাবেচাসহ বিআরটিএ ও নির্বাচন অফিসের সামনে থেকে গ্রাহক সংগ্রহ, যোগাযোগ ও কার্ড তৈরির পর সরবরাহসহ বিভিন্ন প্রতারণার কাজ করতেন।

চক্রের অপর সদস্য জালাল গত ১৫ বছর ধরে ঢাকা বসবাস করছেন। তিনি প্রথমে প্রেসে কাজ করতেন। পরে আদালতের সামনে দালালি করতেন। গত ৫-৭ বছর ধরে তিনি এই প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত হয়। গ্রাহক সংগ্রহ, যোগাযোগ ও কার্ড তৈরির পর সরবরাহসহ বিভিন্ন প্রতারণার কাজ করতেন। এদিকে চক্রের অপর সহযোগী তারেক এক বছর ধরে এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত হয়। আগে তিনি ২-৩ বছর ধরে বিভিন্ন চিপস্ কোম্পানির মার্কেটিংয়ের কাজ করতেন। তবে, প্রতারক চক্রে তিনি গ্রাহক সংগ্রহ, যোগাযোগ ও কার্ড তৈরির পর সরবরাহসহ বিভিন্ন প্রতারণার কাজ করতেন।  

গ্রেফতার আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান খন্দকার আল মঈন।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৩ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২২
এসজেএ/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।