বিশ্বব্যাপী রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে মনোযোগ কমে আসছে—এমন প্রেক্ষাপটে শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় সমবেত হন সাংবাদিক, কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তারা আহ্বান জানান, সংবাদকর্মীদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে গল্প বলা ও অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে সংকটকে তুলে ধরতে—যাতে শুধু মানবিক সহায়তা, প্রত্যাবাসনের অচলাবস্থা কিংবা নিরাপত্তা উদ্বেগের খবরে সীমাবদ্ধ না থেকে ‘শিরোনামের বাইরে’ গিয়ে বাস্তব চিত্র ও সম্ভাব্য সমাধান বিশ্বকে জানানো যায়।
প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি), অক্সফাম ইন বাংলাদেশ এবং ডেভেলপমেন্ট মিডিয়া ফোরাম যৌথভাবে আয়োজন করে ‘শিরোনামের বাইরে: নতুন চোখে রোহিঙ্গা সংকট’ শীর্ষক সিম্পোজিয়াম। অনুষ্ঠানে অংশ নেন ঢাকা ও কক্সবাজারের ৪০ জনের বেশি সাংবাদিক। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আসন্ন উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের আগে হওয়া এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য ছিল গণমাধ্যমের সহায়তায় রোহিঙ্গা সংকটের বৃহত্তর দিকটিকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা যাতে তা আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ ও বৈশ্বিক আলোচনায় সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।
সিম্পোজিয়ামের উদ্বোধনী বক্তব্যে পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, রোহিঙ্গারা কোনো পরিসংখ্যান নয়। তারা ইতিহাস, সংস্কৃতি, টিকে থাকার সংগ্রাম ও স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষ। সাংবাদিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো তাদের মর্যাদা যেন হারিয়ে না যায় এবং তাদের কণ্ঠস্বর যেন নীরব না হয়, তা নিশ্চিত করা। প্রতিটি মানবিক মর্যাদা এবং ন্যায়বিচারের ওপরে ভিত্তি করে যে সংবাদ শিরোনাম তৈরি হয়, তা সমস্যার স্থায়ী পরিবর্তনের পথকে সুগম করে দেয়।
অক্সফাম ইন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর আশীষ দামলে বলেন, রোহিঙ্গা সংকট কেবল বাংলাদেশের দায়িত্ব নয়; এটি একটি বৈশ্বিক সংকট। নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন সম্ভব না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এই গল্পকে জীবিত রাখতে হবে নৈতিকতা ও সমাধানমুখী সাংবাদিকতার মাধ্যমে। গণমাধ্যমের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা জনমত গঠনে যেমন প্রভাব ফেলে, তেমনি আন্তর্জাতিক পদক্ষেপেও।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ফরেন সার্ভিস একাডেমির রেক্টর ড. মো. নাজরুল ইসলাম সাংবাদিকতার সঙ্গে কূটনীতির যোগসূত্র তুলে ধরে বলেন, ঢাকা ও কক্সবাজার থেকে যা রিপোর্ট করা হয়, তা নিউইয়র্ক ও জেনেভার নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারে। ক্লান্তিকর বর্ণনার বাইরে গিয়ে এমনভাবে প্রতিবেদন তৈরি হওয়া উচিত যাতে তা বৈশ্বিক পদক্ষেপে প্রভাব ফেলতে হবে। সাংবাদিকরা কেবল পর্যবেক্ষক নন, তারা ন্যায়বিচার, প্রত্যাবাসন ও দায়বদ্ধতা নিয়ে আন্তর্জাতিক আলোচনার অংশগ্রহণকারীও বটে।
দিনব্যাপী আয়োজনে ছিল তিনটি টেকনিক্যাল সেশন। ‘কনটেম্পোরারি ইস্যুজ অব দ্য রোহিঙ্গা ক্রাইসিস: জাস্টিস, রেপ্যাট্রিয়েশন অ্যান্ড পলিটিক্স’ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওবায়দুল হক এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. বুলবুল সিদ্দিকী বলেন, মিয়ানমারে নাগরিকত্ব স্বীকৃতি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া প্রত্যাবাসন কার্যত অচলাবস্থায় থাকবে। প্রত্যাবর্তন যত পেছাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের প্রতি স্থানীয় জনগোষ্ঠী তত সহনশীলতা হারাচ্ছে এবং সাহায্য কমে আসায় ওই অঞ্চলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকিও বাড়ছে।
দ্বিতীয় সেশন ‘দ্য ফরগটেন অ্যান্ড প্রট্র্যাক্টেড ক্রাইসিস: রিপোর্টিং ফ্রম দ্য গ্রাউন্ড’-এ অংশ নেন ওসমানী সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটির চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাহফুজুর রহমান, ওসমানী সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল ড. মো. নাঈম আশফাক চৌধুরী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক খাজা মাঈন উদ্দিন এবং সাংবাদিক রাহীদ এজাজ। তারা বলেন, রোহিঙ্গা সংকটকে আর শুধু মানবিক সংকট হিসেবে দেখা যাবে না, এটি জাতীয় নিরাপত্তা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলছে। বক্তারা সাংবাদিকদের অনুরোধ করেন, যেন তারা কেবল সাহায্য বিতরণ বা ক্যাম্পের অপরাধকেন্দ্রিক পুনরাবৃত্ত সংবাদ থেকে বেরিয়ে এসে রোহিঙ্গাদের টিকে থাকার সংগ্রাম, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে তুলে ধরেন।
শেষ সেশন ‘রোহিঙ্গা কনফারেন্স অ্যাট দ্য ইউএন: কানেক্টিং লোকাল ন্যারেটিভস উইথ গ্লোবাল অ্যাডভোকেসি থ্রু রিপোর্টিং’-এ বক্তব্য দেন রয়টার্সের প্রতিনিধি স্যাম জাহান।
সমাপনী অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের প্রেস সচিব শফিকুল আলম আসন্ন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বৈঠকের প্রেক্ষাপটে জোরালো আহ্বান জানান: বাংলাদেশ তার দায়িত্বের চেয়েও বেশি করেছে। এখন বিশ্বকে পদক্ষেপ নিতে হবে—অর্থায়ন, দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ব ভাগাভাগির মাধ্যমে। সাংবাদিকদের দায়িত্ব হলো ঘটনাবলীর নিখুঁত ও বাস্তব উপস্থাপন জারি রাখা এবং নিশ্চিত করা যে, রোহিঙ্গাদের কণ্ঠস্বর সেই জায়গায় পৌঁছায় যেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সিম্পোজিয়ামটি পরিচালনা করেন অক্সফাম ইন বাংলাদেশের হেড অব ইনফ্লুয়েন্সিং, কমিউনিকেশনস, অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড মিডিয়া মো. শরিফুল ইসলাম এবং পিআইবির সিনিয়র প্রশিক্ষক গোলাম মুর্শেদ। দিনব্যাপী আলোচনায় স্পষ্ট হয় যে, ২০১৭ সালের পর থেকে গণমাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বারবার কেবল হতাশার চিত্রে তুলে ধরা হয়েছে, যার ফলে তাদের টিকে থাকার সংগ্রাম ও আকাঙ্ক্ষা আড়ালে পড়ে গেছে। বক্তাদের মতে, সমাধানমুখী সাংবাদিকতা কেবল আন্তর্জাতিক মনোযোগ টিকিয়ে রাখবে না, বরং কূটনৈতিক আলোচনায় প্রভাব ফেলবে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে দায়বদ্ধ রাখবে।
টিআর/আরবি