বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে কী উদ্যোক্তারা আস্থাহীনতায় রয়েছেন? আস্থা ফেরাতে সরকারের করণীয় কী? এই সময় ব্যবসায়ীদের কী রকম নীতি সহায়তা দেওয়া উচিত? অর্থনীতি মোটাদাগে আর কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে? এসব নানা বিষয়ে কথা বলেছেন সিনিয়র ব্যাংকার ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ।
প্রশ্ন : গ্যাস ও জ্বালানির দামের পাশাপাশি সুদের হার বেশি।
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ: আগের থেকে পরিস্থিতিটা এখন বেশ ভালো। আগে তো কথা বলা যেত না মন খুলে।
এখন তো বলা যাচ্ছে। জুলাই বিপ্লবের পর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ ছিল। পুলিশ ও আনসার কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারেনি। এখন পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছে।
শতভাগ ঠিক হয়েছে এটা বলব না। ছোটখাটো কয়েকটা ঘটনা ঘটছে। এগুলো হতে পারে, অসম্ভব কিছু না। কিন্তু তাই বলে ঘাবড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা না।
বৈদেশিক এবং স্থানীয় বিনিয়োগের জন্য যেটা প্রয়োজন সেটা হলো ব্যবসাবান্ধব নীতি ও পরিবেশ। গ্যাস ও জ্বালানি অপরিহার্য। এসব খাতে আগে ভর্তুকি দিতে হবে। আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসক্রিপশন মেনে রাতারাতি তা তুলে দেওয়া যাবে না। জ্বালানির দাম বাড়তে পারে; তবে আস্তে আস্তে।
ডলারের সঙ্গে টাকার একটা বড় অবমূল্যায়ন হয়েছে। এটা অস্বাভাবিক। এতে সবাই সাফার করছে। এটা যদি এক-দুই টাকা করে বাড়ত তাহলে কোনো সমস্যা হতো না। বিনিয়োগকারীরা এই বাড়তি খরচটা আর নিতে পারছেন না। ব্যবসায়ীদের সাপোর্ট করতে হবে। যাঁরা দেশে আছেন, দেশে বিনিয়োগ করেছেন, দেশেই তাঁদের সব কিছু, তাঁদের সহায়তা দিতে হবে।
প্রশ্ন : বিজনেস হাউসগুলোকে আরো ব্যবসাবান্ধব নীতি সহায়তা দেওয়া যায় কি না?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ: এটা তো উইন উইন সিচুয়েশন। সবাই যাতে সমভাবে উপকৃত হয় সেটা দেখতে হবে। তাহলে কোনো সমস্যা হয় না। আমরা সিঙ্গেল ক্লায়েন্ট বরোয়ারকে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে বলেছি। ধরা যাক, আমার ব্যবসা আমী আমার ছেলেকে দিলাম। এখন আমার এই ছেলেকে দেওয়া ব্যবসাটা কি আমার ব্যবসা ধরব, না তার ব্যবসা ধরব? এটা তো আসলে ব্যাংক এবং ক্লায়েন্ট নিজেরা আলোচনা করে ঠিক করবে। এখন আমারও দশটা কম্পানি থাকতে পারে, আমার ছেলেরও দশটা কম্পানি থাকতে পারে। আমার ছেলের দশটার মধ্যে একটা বা দুটি একটু খারাপ হতে পারে। কোনো প্রতিষ্ঠান ১০%, কোনো প্রতিষ্ঠান ১৫% বা ৫% লাভ করতে পারে। সমস্যা হয়ে যায় যখন এক কম্পানির টাকা অন্য কম্পানিতে বিনিয়োগ দেখানো হয়। কিন্তু একটা কম্পানি খারাপ করার জন্য অন্য সব কম্পানিও খারাপ করে ফেলবে—এটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। আমি মনে করি এটা ঠিক না। এটা আসলে রেগুলেটর ব্যাংক এবং ক্লায়েন্ট একসঙ্গে বসে আলোচনা করে একটা পলিসি করা যেতে পারে। অনেক সময় গভর্নমেন্ট যাদের কাছ থেকে বরো///// করছে তাঁদের অনেক শর্ত থাকে। এসব শর্তের কারণেই কিন্তু সমস্যাটা তৈরি হয়। আমাদের ঠিক করতে হবে, আমরা কি ওই শর্তটা মানব নাকি আলোচনা করে একটা পলিসি করব? বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লেন্ডারে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা থাকে। শর্ত এবং সুদের হার কী হবে সেটা লেন্ডারই ঠিক করে। যখন কিস্তি দেওয়ার সময় আসে তখন যে কিস্তির পরিমাণ নির্ধারিত হয় তার চেয়ে বরং ক্যাশ ফ্লোর ওপর কিস্তির পরিমাণ ঠিক করা উচিত। আমাদের দেশের যে নিয়ম-নীতিগুলো রয়েছে, এসব নিয়ম-নীতির একটু রিভিউ প্রয়োজন, পর্যালোচনা প্রয়োজন।
প্রশ্ন : অর্থনীতিতে গতি এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফেরাতে সরকার কী করতে পারে? সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলতে পারে কি না?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ : আমি মনে করি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলা ভালো। আলাপ-আলোচনা করে বিচার-বিশ্লেষণ করে যে সিদ্ধান্তটা নেওয়া হবে, সেটা সঠিক হবে। সিদ্ধান্ত কী হবে সেটা সরকার নেবে ঠিক আছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বললে অনেক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। যেকোনো সরকারকেই কথা শুনতে হবে। কাস্টমারের কথা না শুনলে সমস্যার সমাধান হবে না। আগের মতো কথা বললেই গুম হয়ে যাবে, সেটা হলে তো হবে না। কথা শুনতে হবে। এটা যদি হয় আমার দেশ শান্তিতে থাকবে, জনগণ শান্তিতে থাকবে। এভাবে আমরা একদিন স্ট্রংগেস্ট কান্ট্রি হয়ে যাব।
প্রশ্ন : এই মুহূর্তে ইকোনমিতে কী কী চ্যালেঞ্জ রয়েছে? এসব চ্যালেঞ্জ কিভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব?
সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ : এখন যদি চ্যালেঞ্জের কথা বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির একটু উন্নতি করা দরকার। এটা হলো সার্বিক বিষয়। দ্বিতীয় হলো, যাঁরা বিনিয়োগকারী তাঁদের গ্যাস এবং বিদ্যুৎ-জ্বালানি নিশ্চিত করতে হবে। দামটাও আলোচনা করে ঠিক করতে হবে। আগের সরকারের সময় সুদের হার নয়ছয় ফিক্স করে দিয়েছিল। এ রকম হলে হবে না। এতে বিজনেস হাউসের যে ক্ষতি হয়, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয় যাঁরা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী তাঁদের। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থও দেখতে হবে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে যেভাবে হয়, বিশেষ করে ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাইয়ের ওপর ভিত্তি করে দামটা ঠিক করতে হবে। এর মানে এই নয়, আমি ২০ শতাংশ বাড়িয়ে দিলাম। এটা করা যাবে না। দাম থাকতে হবে সহনশীল স্তরে। সুতরাং দাম অস্বাভাবিক বাড়ানো যাবে না। একটা ব্যবসা করতে হলে কত শতাংশ দিতে হয়, সেটা চিন্তা করতে হবে। আবার যাঁরা সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করে তাঁদের বিষয়টাও চিন্তা করতে হবে। যাঁরা স্বল্প পরিমাণের সঞ্চয়কারী তাঁদের দিকটাও দেখতে হবে। অর্থনীতিতে যে মিসমেসগুলো রয়েছে সেগুলো সরকারকে দেখতে হবে। করপোরেট হাউসগুলোও বাঁচাতে হবে, আবার স্মল ও মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজকেও টিকিয়ে রাখতে হবে। দেশে এখন অনেক নারী উদ্যোক্তা গড়ে উঠেছে। তাঁদের সহায়তা করতে হবে। তাঁরাও স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতা রাখেন। আমরা আমাদের ব্যাংক থেকে ফান্ডিং করার চেষ্টা করছি। সব মিলিয়ে আমার কথা হলো, সবার কথা শুনতে হবে। এর পরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি গ্যাস প্রাইস কী করব, ইলেকট্রিসিটি প্রাইস কী করব, যে জমিতে ফ্যাক্টরি করছে সেখানে তারা কী করছে, সেটা দেখতে হবে। যেমন শুলশান-বারিধারায় জমির সরকারি খাতায় দাম হলো শতাংশ ৫০ লাখ টাকা। বাস্তবে কী এই দামে জমি পাওয়া যায়? এখানে তো পাঁচ কিংবা ১০ কোটি টাকা কাঠা বিক্রি হয়। কিন্তু আমি নিবন্ধন করার সময় দেখাচ্ছি ৫০ লাখ টাকা। আমি মনে করি, এগুলো সরকারকে সবার আগে দেখা উচিত। সেটা এনবিআরকে দেখতে হবে। না হলে ব্ল্যাকমানি তৈরি হবে।
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ