ঢাকা, শুক্রবার, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ মে ২০২৪, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

হরতাল-অবরোধে কেমন আছেন শ্রমজীবী মানুষ?

জাফর আহমদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২২৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০২৩
হরতাল-অবরোধে কেমন আছেন শ্রমজীবী মানুষ?

ঢাকা: গাবতলী বাস টার্মিনালের কোচের কলারম্যান হিসাবে কাজ করেন আব্দুল কাদের। তার কাজ যাত্রীদের ডেকে কাউন্টারে নিয়ে আসা।

হরতাল-অবরোধে তার কাজ না থাকায় মেলেনি বেতন।

অবরোধের মধ্যে মন খারাপ ছিল আব্দুল কাদেরের। তার কাছে পরিবারের খরচ চালানোর মত টাকা ছিল না। অবরোধের পর শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) গাবতলীতে থেকে বাস ছেড়ে যাবে। এ জন্য টার্মিনালে যান তিনি। যাত্রী আসতে শুরু করে। মজুরি মিলবে বলে এখন কাদেরের মন ভালো।

অবরোধের মধ্যে এমন পরিস্থিতি হয় হাজার হাজার পরিবহন শ্রমিকের। রাজধানীর একাধিক টার্মিনালে খোঁজ নিয়ে পাওয়া যায় এমন অনেক গল্প। বিশেষ করে যারা দূরপাল্লার বাস টার্মিনালে কাজ করেন তাদের মধ্যে প্রভাবটা বেশি পড়ে। সেখানের দোকানদার, হকার, চা বিক্রেতা এমনকি ভিক্ষুকদের পর্যন্ত আয় বন্ধ হয়ে যায়। অবরোধের মধ্যে তাদের ধার-দেনা করে চলতে হয়, নইলে উপোস থাকতে হয়।

গাবতলীর রোজিনা এন্টারপ্রাইজ কোচের কাউন্টার সহকারী আকমত উল্লাহ বলেন, অবরোধ মানেই হলো, যেন গাড়ি ঢাকা থেকে না ছেড়ে যায় এমন নির্দেশনা। যদি গাড়ি বের করি তাহলে গাড়ি পুড়িয়ে দিতে পারে। সরাসরি পুড়িয়ে না দিলেও হুমকি থাকে। এজন্য আমরা গাড়ি বের করি না।

তিনি আরও বলেন, গাড়ির চাকা না ঘুরলে বেতন নেই, টার্মিনালে এলে খোরাকি দেয়। খোরাকি  মানে ১০০-১৫০ টাকা। মালিক গাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য এ টাকা দেয়। যা চা-বিস্কুটেই শেষ হয়ে যায়। পরিবারের জন্য বাজার করার কোনো টাকা থাকে না। জমানো থাকলে তা দিয়ে বাজার করতে হয় নইলে ধার-দেনা করতে হয়। সেটাও না পারলে না খেয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না।

মহাখালি বাস টার্মিনালের ড্রাইভার আব্দুস সামাদ বলেন, আমাদের কাজটাই হচ্ছে এমন যেখানে শুধু গালি দেওয়ার লোক আছে, সুখ-দুঃখ দেখার কেউ নেই। না আছে মালিক, না আছে সরকার। আমরা যাত্রীদের সময়, জীবন ও সম্পদ রক্ষা করে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে শতভাগ সতর্ক থাকি। আর ওই যাত্রার ভাড়া নেওয়ার মধ্য দিয়ে সব সম্পর্ক শেষ। হরতাল-অবরোধ বা কোনো দুর্ঘটনাতেও আমাদের দেখার কেউ নেই।

আগের দিন বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) বিএনপি-জামায়াতের পঞ্চম ধাপের অবরোধ ও অন্যান্য দল হরতাল ডাকে। এদিন মহাখালি টার্মিনালের একটি কাউন্টারের কথা হয় সামাদের সঙ্গে।

তিনি বলেন, যারা হরতাল অবরোধ ডাকছে তারা আমাদের সুখ-দুঃখ দেখছে না। সরকারও দেখছে না। যেদিন গাড়ির চাকা চলবে না, সেদিন মালিকও দেখবে না।

আব্দুস সামাদ কথা বলার সময় সেখানে তার গাড়ির হেলপার উপস্থিত হন। তিনি জানতে চান, আজ গাড়ি ছেড়ে যাবে কিনা! সামাদ দুইজনকে দেখিয়ে বলেন, দেখছেন চোখ মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছে, কেমন আছে। রাজ্যের হতাশা।

পরিবহন শ্রমিকরা জানান, তাদের জন্য একটি নির্দিষ্ট খোরাকি থাকে। মজুরি নির্ধারণ হয় গাড়ির চাকা ঘোরার ভিত্তিতে। গাড়ি না চললে, বেতনও থাকে না।

অবরোধে দূরপাল্লার বাস-মিনিবাসের শ্রমিকদের দুঃখগাঁথা জানালেন ঢাকা জেলা বাস-মিনিবাস সড়ক পরিবহন ইউনিয়নের সহ-সম্পাদক মোতালেব হোসেন। তিনি বলেন, গাড়ি না চলায় কোনো আয় নেই। কিন্তু এসব পরিবহন শ্রমিকের পেট আছে, পরিবার আছে। আমরা অন্য কোনো কাজও জানি না, যে গিয়ে সেগুলো করব। মালিকের গাড়ি পাহারা দিতে এসে বসে থাকতে হবে। ওই দিনের শেষে মিলবে ১০০ টাকা। এটা অমানবিক।

অবরোধকালীন সময়ে পরিবহন শ্রমিকদের সহায়তা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

অবরোধে টার্মিনালের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত। বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে না গেলে যাত্রী আসে না, বিক্রিও নেই। কিন্তু ঠিকই জায়গার ভাড়া ও কর্মচারীকে ধরে রাখার জন্য বেতন দিতে হয়। এখন অবরোধে সপ্তাহে চারদিন বন্ধ থাকে, তিনদিন চলে। এ অবস্থায় অনেকের পুঁজি বাট্টাতে টান পড়েছে।

জয়নাল আবেদন গাবতলীর আন্ডারপাসের পাশ থেকে টার্মিনালে ঢুকতেই ডান পাশে একটি উন্মুক্ত হোটেল চানান। এ জন্য তাকে প্রতিদিন ৫০০ টাকা দিতে হয়। অদৃশ্য লাইনম্যানকে ২০০ টাকা চাঁদাও দিতে হয় প্রতিদিন। নিজের পাশাপাশি একজন কর্মচারী আছে তার। অবরোধের কারণে সমস্যায় পড়েছেন জয়নাল আবেদিন। অবরোধর দিন বিক্রি নেমেছে তিন ভাগের এক ভাগে।

শুক্রবার গাড়ি চলবে। কিন্তু বৃষ্টি বাগড়া দিয়েছে। বাসা থেকে বের হতে হতে তিন ঘণ্টা দেরি হয়ে গেছে। আজ অবরোধ না থাকলেও বিক্রি ভালো হবে না। এ জন্য খুব মন খারাপ জয়নালের।

তার মন খারাপের কারণ অবরোধে-হরতাল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবরোধই তো সব খারাপ করে দিচ্ছে। যাত্রী নেই, বেচা-কেনা অনেক কমে গেছে। আবার যাত্রী না থাকলে পরিবহন শ্রমিকদের বাকিতে খেতে দিতে হয়। তারা আমার নিয়মিত গ্রাহক; তাদের হাতে টাকা নেই। এই বিপদে সব সময় টাকা দিতে পারেন না তারা। কিন্তু আমি কুলাতে পারছি না। এভাবে আর ১৫ দিন চললে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে পালাতে হবে।

এমন অবস্থা পান-বিড়ি-সিগারেট-পানি বিক্রেতা, জুতা স্যান্ডেল বিক্রেতা ও মোবাইলের এক্সসোরিজ বিক্রেতাসহ তৈজসপত্র, মনিহারি, ফল বিক্রেতা থেকে শুরু করে, চানাচুর, ঝালমুড়ি বিক্রেতাদের পর্যন্ত। আয় কমে গেছে হকার, মুটের। এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর যার সঙ্গে কথা হয় প্রত্যেকেই জানান, এখন তাদের প্রতিটি সকাল শুরু হচ্ছে এক বোঝা হতাশা নিয়ে। পুঁজি ভেঙে খেতে খেতে সব হারিয়ে নি:স্ব হওয়ার আতঙ্ক যেন তাদের পেয়ে বসেছে।

মহাখালী থেকে দূরপাল্লার বাস সপ্তাহে চারদিন বন্ধ থাকার কারণে যাত্রী সংখ্যা শূন্যে নামে। সন্ধ্যার পর দুয়েকটি গাড়ি চললেও সারাদিন বন্ধ থাকে। এই সময়ে ষাটোদ্ধ জুতা পালিসকারী লাল মিয়ার কাজ পুরোটাই বন্ধ থাকে। বুধবার তার মাত্র ১০ টাকার কাজ হয়েছিল। একজন স্যান্ডেলের ফিতা সেলাই করিয়ে ১০ টাকা দিয়েছেন। এরপর আর কেউ জুতা পালিস বা জুড়া-সেন্ডেল সেলাই করাতে আসেননি। বাসার জন্য বাজার তো দূরে থাক, তার পুরো দিন কেটেছে উপোস।

পরের দিন লালমিয়ার শরীর খারাপ। তার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। তবু কাজে এসেছেন এই ভেবে, যদি কিছু আয় জুটে!

বাংলাদেশ সময়: ১২২৭ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৮, ২০২৩
জেডএ/এফআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।