ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২, ২৭ জুন ২০২৫, ০১ মহররম ১৪৪৭

আইন ও আদালত

প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে আইনি নোটিশ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:০৩, জুন ২৬, ২০২৫
প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে আইনি নোটিশ

ঢাকা: প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা ২০ জন প্রবাসী।

বৃহস্পতিবার (২৬ জুন) প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশন সচিব, আইন ও বিচার বিভাগের সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সচিব বরাবর এ নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

 

নোটিশ পাওয়ার পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে কার্যকর ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলা হয়েছে। অন্যথায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, ফিনল্যান্ড, পর্তুগাল, তুরস্ক, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর প্রবাসী ২০ জন বাংলাদেশির পক্ষে এ নোটিশ পাঠান আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।  

নোটিশে বলা হয়, নোটিশ দাতা প্রত্যেকেই বাংলাদেশের নাগরিক। তারা দেশের বিদ্যমান আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তারা রেমিট্যান্স যোদ্ধা। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি, যা দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ। অভিবাসী পাঠানোয় বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। বিশ্বের প্রায় ১৭৬টি দেশে বাংলাদেশি প্রবাসীরা বসবাস করছে। রেমিট্যান্স আয়ের দিক থেকে ২০২৪ সালে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল সপ্তম। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী বিগত ৫ বছরে প্রবাসীদের দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের সমীক্ষা হচ্ছে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ২৬৬১.৪৪ বিলিয়ন টাকা। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ২১৫০.৭৪ বিলিয়ন টাকা। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ১৮১৫.৮০ বিলিয়ন টাকা। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ২১০১.৩১ বিলিয়ন টাকা ও ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ১৫৪৩.৫২ বিলিয়ন টাকা। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসীদের আয়ের অবদান ৬ থেকে ৭ শতাংশ। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে প্রবাসীরা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়নক হওয়া সত্ত্বেও তারা তাদের ভোটদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত।

এতে আরও বলা হয়, ভোটাধিকার নাগরিকের একটি রাজনৈতিক অধিকার। এটি আমাদের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত। একজন নাগরিকের সাময়িক অবস্থানের পরিবর্তন সংবিধান স্বীকৃত এই অধিকার ক্ষুণ্ন করতে পারে না। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেক্টরাল অ্যাসিন্ট্যান্স (আইডিইএ) এর তথ্য অনুযায়ী  বিশ্বের ১২৬টি দেশ তাদের প্রবাসে অবস্থানরত নাগরিকদের ভোটাধিকার দেওয়ার সুযোগ প্রদান করে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণামূলক জার্নাল ‘sage’ এর সমীক্ষা অনুযায়ী প্রায় ১৪১টি দেশ নন-রেসিডেন্ট নাগরিকদের ভোটাধিকার দেওয়ার সুযোগ রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইনস, মেক্সিকো, ইতালি, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড, পর্তুগালসহ বিশ্বের অনেক দেশেই প্রবাসীরা ডাকযোগে, ই-মেইলে, প্রতিনিধি বা দূতাবাসের মাধ্যমে ভোট দিতে পারেন। সম্প্রতি ভারত, পাকিস্তান, আয়ারল্যান্ডসহ অনেক দেশ প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে।

‘বাংলাদেশের সংবিধানের বিদ্যমান কাঠামোতে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতে সংশোধনীর প্রয়োজন নেই। ১৯৮২ সালের একটি অর্ডিন্যান্সের ধারা ৮-এর কঠোর ব্যাখ্যার কারণে প্রবাসীরা ভোটদান থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। উল্লিখিত বিধানের সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৭ সালে হাইকোর্ট বিভাগে একটি রিট মামলা দায়ের করা হয়। ওই মামলার রায়ের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটদানের পথ উন্মুক্ত হয়। পরে সরকার ২০০৯ সালে ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশটি বাতিল করে। ২০১৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সংসদে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করা হবে মর্মে আশ্বাস দেন। কিন্তু সেই সংশোধন প্রবাসীদের ভোটাধিকারের উদ্দেশে করা হয়নি। ফলে বিষয়টি আবারও উপেক্ষিত হয়। যদিও ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ধারা ২৭ এ বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের ডাকযোগে ভোট দেওয়ার অধিকার দেয়, তবে বিদ্যমান জটিল প্রক্রিয়া ও তথ্যের অভাবে তা সম্ভব হয় না। নির্বাচন কমিশন ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আউট-অব-কান্ট্রি ভোটিংয়ের বিধান চালু করলেও আবেদন, ব্যালট গ্রহণ এবং ফেরত পাঠানোর জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া এটিকে বাস্তবে অসম্ভব করে তুলে। এমনকি নির্বাচন কমিশন ২০২০ সালে মালয়েশিয়ায় পরীক্ষামূলকভাবে প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন শুরু করলেও তা কোভিড-১৯ মহামারির কারণে স্থগিত হয়ে যায়। ’

নোটিশে বলা হয়, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা, প্রয়োজনীয় লজিস্টিকস গ্রহণে অনীহা, জনবলের অভাব, তহবিল স্বল্পতা, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা সর্বোপরি অহেতুক রাজনৈতিক বিতর্ক বিদ্যমান সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। তাই প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতকল্পে কয়েকটি পদক্ষেপ জরুরিভিত্তিতে গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি-

ক. জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র নেই এমন নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া: জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। বিদেশে বসবাসকারী বাংলাদেশি এমন নাগরিকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। তাদের ভোটদান নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

খ. জাতীয় পরিচয়পত্রপ্রাপ্ত সব প্রবাসীদের হালনাগাদকৃত তালিকা প্রকাশ: আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্রপ্রাপ্ত সব প্রবাসীদের সর্বশেষ অবস্থান (বসবাসকারী দেশ) উল্লেখপূর্বক নির্বাচন কমিশন একটি হালনাগাদকৃত ভোটার তালিকা প্রকাশ করবে।

গ. নির্বাচন সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন: নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা অনুপাতে নির্বাচন কমিশন প্রতিটি দেশে এক বা একাধিক নির্বাচন সহায়তা কেন্দ্র স্থাপন করবে। এসব কেন্দ্র থেকে ওই দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে।

ঘ. ভোটকেন্দ্র স্থাপন ও ভোটগ্রহণ: নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধায়নে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় নির্বাচন সহায়তা কেন্দ্রগুলোতে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করে প্রবাসীদের সরাসরি ভোটগ্রহণ করতে হবে। দূতাবাসের কর্মকর্তাদের থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা যেতে পারে। প্রবাসীদের সংখ্যা ও দূরত্ব অনুসারে নির্বাচন কমিশন এক বা একাধিক ভোটকেন্দ্র স্থাপন করবে। ভোটদানের গোপনীয়তা রক্ষা করে কমিশন ভোট কার্যক্রমের ভিডিও রেকর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করবে।

ঙ. ভোট গণনা এবং ফলাফল ঘোষণা: ভিডিও রেকর্ডিং সহকারে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন কমিশনের নিযুক্ত প্রতিনিধির উপস্থিতিতে প্রবাসীদের দেওয়াকৃত ভোট গণনা ও ফলাফল প্রকাশ করবে। নির্বাচনের ফলাফল একাধিক নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য মাধ্যমে (ই-মেইল, নিবন্ধিত ডাক ইত্যাদি) নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠাবে।

চ. গণনাকৃত ভোট, ফলাফল এবং ভোট দেওয়া প্রক্রিয়ার ধারণকৃত ভিডিও নির্বাচন কমিশনে দ্রুততম সময়ে পাঠানো: ভোট কার্যক্রম সমাপ্তি অন্তে গণনাকৃত ভোট, ঘোষিত ফলাফল ও ভোট দেওয়া প্রক্রিয়ার ধারণকৃত ভিডিও নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত সময়ে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যমে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন বরাবর পাঠানো নিশ্চিত করবে।  

এমতাবস্থায় এই আইনি নোটিশ প্রাপ্তির পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে উপরোক্ত বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে কার্যকর এবং দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। অন্যথায় নোটিশদাতাদের সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য এবং যথাযথ প্রতিকার পাওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়।

ইএস/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।