বর্তমান সমাজে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত একটি পাপের নাম হলো গিবত। এটি মানুষের হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক প্রকার বিষ, যা মানুষের নেক আমলগুলো ধ্বংস করে দেয়।
মদ্যপান, ব্যভিচার ও সুদ-ঘুষের ন্যায় গিবতও একটি কবিরা গুনাহ। অন্যান্য কবিরা গুনাহ সম্পর্কে মানুষ যতটুকু সতর্কতা অবলম্বন করে গিবতের ক্ষেত্রে সে রকম সতর্কতা দেখা যায় না। এটি হাক্কুল ইবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যার কারণে অন্যান্য কবিরা গুনাহ তাওবার মাধ্যমে মাফ হলেও গিবতের জন্য তাওবার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি থেকে ক্ষমা চেয়ে নিতে হয়। গিবতের মাধ্যমে অন্যের সম্মান ও মর্যাদা কলুষিত হয়। অথচ অন্যের ইজ্জত-সম্মান হেফাজত করা প্রত্যেক মুসলমানের আবশ্যকীয় কর্তব্য।
গিবতের সংজ্ঞা
গিবত হলো পরনিন্দা ও কুৎসা রটনা করা, সমালোচনা বা অসাক্ষাতে দুর্নাম করা, কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষত্রুটি আলোচনা করা ইত্যাদি। মানুষ সাধারণত বন্ধুবান্ধব ও সহপাঠীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ায়, ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে—এসবই গিবতের অন্তর্ভুক্ত।
তা ছাড়া কারো শারীরিক দোষত্রুটি, অভ্যাস, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে সমালোচনা করাও গিবতের অন্তর্ভুক্ত। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, তোমরা কি জান, গিবত কী? তাঁরা বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসুলই অধিক জ্ঞাত। তিনি বললেন, (গিবত হলো) তোমার ভাইয়ের সম্পর্কে এমন কিছু আলোচনা করা, যা সে অপছন্দ করে। প্রশ্ন করা হলো, আমি যা বলছি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে বাস্তবিকই থেকে থাকে, তবে আপনি কি বলেন? তিনি বললেন, তুমি তার সম্পর্কে যা বলছ তা যদি তার মধ্যে প্রকৃতই থেকে থাকে, তাহলেই তুমি তার গিবত করলে। আর যদি তা তার মধ্যে না থাকে তাহলে তো তুমি তার প্রতি অপবাদ আরোপ করলে। (মুসলিম, হাদিস : ২৫৮৯)
গিবতের বিধান
গিবত একটি জঘন্য পাপ এবং নীরব ঘাতকের মতো। মানুষের অজান্তেই গিবত তার নেকির ভাণ্ডার ধ্বংস করে দেয়। এটিকে আল্লাহ তাআলা মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন, যা একজন সুস্থ বিবেকবান মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমরা বেশি ধারণা হতে বিরত থাকো। নিশ্চয়ই কিছু কিছু ধারণা পাপ। আর তোমরা ছিদ্রান্বেষণ কোরো না এবং পরস্পরের পেছনে গিবত কোরো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করে? বস্তুত তোমরা সেটি অপছন্দ করে থাকো। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বাধিক তাওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু। ’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ১২)
গিবতের ভয়াবহতা
গিবত জঘন্য পাপ। এর পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। এটি এতটা জঘন্য যে যদি গিবতের একটি বাক্য সাগরে ফেলা হয়, তবে সাগরের পানির স্বাদ ও গন্ধ পরিবর্তন হয়ে যাবে।
যেমন—আয়েশা (রা.) বলেছেন, আমি একবার সাফিয়া (রা.)-এর দিকে ইশারা করে বললাম, সে তো বেঁটে মহিলা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি তো তার গিবত করে ফেললে। ’ অপর বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন, ‘তুমি এমন একটি কথা বলেছ, যদি তা সমুদ্রে মিশিয়ে দেওয়া হয়, তবে সমুদ্রের পানির রং পাল্টে যাবে। ’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৫০২)
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো গিবত আজ মানুষের স্বভাবসুলভ আচরণে পরিণত হয়েছে। যার কারণে মানুষ চায়ের দোকানে, রাস্তাঘাটে, মজলিসে, এমনকি মসজিদে বসেও গিবত করতে বা অন্যের সমালোচনা করতে দ্বিধা করে না।
গিবত শোনার বিধান
গিবত করা যেমন মহাপাপ, তেমনি গিবত শোনাও পাপ। যখন কেউ অন্য কোনো ব্যক্তির গিবত করতে শুরু করে তখন অবশ্যই তাকে নিষেধ করতে হবে। তা সম্ভব না হলে ওই মজলিস ত্যাগ করাটা ওয়াজিব।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তুমি তাদের দেখ, যারা আমার আয়াতসমূহের ব্যাপারে উপহাসমূলক সমালোচনায় রত আছে, তুমি তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, যতক্ষণ না তারা অন্য কথাবার্তায় লিপ্ত হয়। আর যদি শয়তান তোমাকে ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণের পর জালিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে বোসো না। ’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ৬৮)
গিবতের মতো খারাপ কথাবার্তা শোনা মুমিনের মর্যাদাবিরোধী। মহান আল্লাহ মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন, ‘তারা যখন অসার বাক্য শ্রবণ করে তখন যেন তা উপেক্ষা করে। ’ (সুরা : কাসাস, আয়াত : ৫৫)
গিবতের শাস্তি
গিবত মারাত্মক সামাজিক ও ধর্মীয় ব্যাধি। কোরআন ও হাদিসে গিবতের ভয়াবহতা সম্পর্কে ব্যাপক সতর্ক করা হয়েছে। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, মেরাজের রাতে আমি এমন এক কওমের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম যাদের নখগুলো তামার তৈরি এবং তা দিয়ে তারা অনবরত তাদের মুখমণ্ডল ও বুকে আঁচড় মারছে। আমি বললাম, হে জিবরিল! এরা কারা? তিনি বললেন, এরা সেসব লোক, যারা মানুষের মাংস খেত (গিবত করত) এবং তাদের মানসম্মানে আঘাত হানত। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৮৭৮)
গিবতের কাফফারা
ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় গিবত হয়ে গেলে সর্বপ্রথম করণীয় হলো আল্লাহর কাছে তাওবা করা। তার কাফফারা দেওয়া। গিবতের কাফফারা হলো যার গিবত করা হয়েছে তার জন্য দোয়া করা বা ক্ষমা প্রার্থনা করা। আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, গিবতের কাফফারা হলো গিবতকারী যার গিবত করেছে, তার জন্য মাগফিরাত প্রার্থনা করবে এবং এভাবে বলবে, হে আল্লাহ! আমাকে এবং তাকে ক্ষমা করো। (বায়হাকি)
গিবতের কারণে অন্যের পাপের বোঝা নিজের কাঁধে
আল্লাহ তাআলা নিজেই কিয়ামতের দিন গিবতের বদলা নেবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কি বলতে পারো, অভাবী লোক কে? তারা বলল, আমাদের মাঝে যার দিরহাম (টাকা-পয়সা) ও ধন-সম্পদ নেই সে-ই তো অভাবী লোক। তখন তিনি বলেন, আমার উম্মতের মধ্যে সে প্রকৃত অভাবী লোক, যে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন সালাত, সাওম ও জাকাত নিয়ে আসবে; অথচ সে এ অবস্থায় আসবে যে সে কাউকে গালি দিয়েছে, কাউকে অপবাদ দিয়েছে, অমুকের সম্পদ ভোগ করেছে, অমুককে হত্যা করেছে এবং আরেকজনকে প্রহার করেছে। এরপর সে ব্যক্তিকে তার নেক আমল থেকে দেওয়া হবে, অমুককে নেক আমল থেকে দেওয়া হবে। এরপর যদি পাওনাদারের হক তার নেক আমল থেকে পূরণ করা না যায় সে ঋণের পরিবর্তে তাদের পাপের একাংশ তার প্রতি নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। ’ (মুসলিম, হাদিস : ২৫৮১)
আমাদের উচিত নিজের জবানকে হেফাজত করা, অন্যের দোষত্রুটি খোঁজা থেকে নিজেকে বিরত রাখা।
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা) চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ
এনডি