ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশসহ পশ্চিমা দেশসমূহ সম্প্রতি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইউরোপ দীর্ঘদিন ধরেই বিভক্ত। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ের মতো দেশগুলো মনে করে, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া মানে দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রতি সমর্থন জানানো। তাদের মতে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন— উভয় জাতিরই সমানভাবে নিরাপত্তা ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার রয়েছে।
সমালোচকরা বলছেন, এ ধরনের স্বীকৃতি অনেক সময় কেবল প্রতীকী পর্যায়ে থেকে যায়। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলেও ইউরোপের অধিকাংশ দেশ এখনও ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখছে। ফলে এই স্বীকৃতির বাস্তব প্রভাব কতটুকু, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আলম ভূইয়া বাংলানিউজকে বলেন, ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরও তো গাজায় গণহত্যা বন্ধ হচ্ছে না। তাই এখন স্বীকৃতি শুধু নয়, জরুরি ভিত্তিতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। গাজায় জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ সহায়তা পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এ ছাড়া ফিলিস্তিনকে এই মূহুর্তে স্বীকৃতি ইসরাইলের যুদ্ধারপরাধকে স্বাভাবিকতা দেওয়ার নতুন কোনো কৌশল কি না তাও বিবেচনায় রাখতে হবে।
পশ্চিমা স্বীকৃতি প্রতীকী নাকি বাস্তব?
এখন প্রশ্ন উঠেছে তাহলে এই স্বীকৃতির মানে কি? ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য নতুন স্বীকৃতিদানকারী দেশের সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ফিলিস্তিনকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তিশালী করেছে। তবে অধ্যাপক রাশেদ আলম ভুইয়া মনে করেন, বাস্তবে একটি কার্যকর ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হলে ইসরায়েলের বসতি সম্প্রসারণ বন্ধ করতে হবে। ফিলিস্তিনের জনগণের মধ্যেও অভ্যন্তরীণ ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না।
তিনি বলেন, এখন গাজায় মানুষের বসবাসের উপযোগী কিছু অবশিষ্ট নেই। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শক্তহাতে ইসরায়েলের এই আগ্রাসী নীতি বন্ধ করতে পারতো তাহলে এই স্বীকৃতি অর্থপূর্ণ হতো। এখন কার্যত এই স্বীকৃতি মূল্যহীন। তবে, নৈতিকভাবে ইসরায়েলকে একা করে দিয়েছে পশ্চিমা কিছু দেশের এই স্বীকৃতি। এখানেও খেয়াল রাখতে হবে, পশ্চিমা দেশগুলো কিন্তু সেদেশের জণগণের চাপেই এই স্বীকৃতি দিচ্ছে। সারা পৃথিবীতে যেভাবে বিক্ষোভ হচ্ছে সেখানে ঐসকল দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশসহ অনেক দেশ বহু আগেই ফিলিস্তিনকে পূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘেও ফিলিস্তিন বর্তমানে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হিসেবে রয়েছে। তবে পূর্ণ সদস্যপদ লাভ ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন ছাড়া ফিলিস্তিনকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা কঠিন। যেটা যুক্তরাষ্ট্রের কারনে বার বার হোঁচট খাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউরোপের স্বীকৃতি যদিও তাৎক্ষণিকভাবে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে না, তবে এটি ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক বৈধতা ও ন্যায়সঙ্গত দাবিকে জোরদার করবে। দুই-রাষ্ট্র সমাধানের ধারণা বাস্তবায়নে এটি কূটনৈতিক চাপ হিসেবেও কাজ করতে পারে।
জাতিসংঘে নতুন করে স্বীকৃতি
জাতিসংঘ সদরদপ্তরে ২২ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠক ও ঘোষণায় ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, পর্তুগাল, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, মোনাকো ও অ্যান্ডোরা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এই সিদ্ধান্ত দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নতুন অঙ্গীকারকে প্রতিফলিত করে।
জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত ১৫৭টি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে ১৫টির বেশি দেশ এখন ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মধ্যে স্পেন, আয়ারল্যান্ড, সুইডেন, স্লোভেনিয়া, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা ও সর্বশেষ ফ্রান্স অন্যতম।
এ ছাড়া ২২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ফ্রান্স ও সৌদি আরবের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন। এতে গৃহীত নিউইয়র্ক ঘোষণায় বলা হয়, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে পশ্চিম তীর ও গাজার প্রশাসন পুনর্গঠনের দায়িত্ব নিতে হবে এবং হামাসকে রাজনৈতিক ক্ষমতা ছাড়তে হবে।
এর আগে, ১২ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অনুষ্ঠিত ভোটে ১৪২টি দেশ এ ঘোষণাকে সমর্থন করে। রেজল্যুশনে দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করা হয়। যদিও এ সিদ্ধান্ত বাধ্যতামূলক নয়, তবুও এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্পষ্ট অবস্থানকে সামনে আনে।
এ ছাড়া ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবারের জাতিসংঘ সম্মেলনে ঘোষণা দেন, ফ্রান্স এখন ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ফ্রান্স বলছে, ন্যায়সংগত শান্তির পথ কেবলমাত্র দ্বি-রাষ্ট্র কাঠামোর মাধ্যমেই সম্ভব। একইভাবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ঘোষণা দেন, ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি ব্রিটিশ পররাষ্ট্রনীতির এক বড় পরিবর্তন।
ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি
ফিলিস্তিন ইস্যুতে ১৯৭৮ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি ছিল এক বড় মোড়। সেসময় ধরেই নেওয়া হয়েছিল অন্তত দ্বিরাষ্ট্রীয়ভাবে হলেও ফিলিস্তিন ইস্যুর সমাধান হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের মধ্যস্থতায় মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের মধ্যে এই চুক্তি হয়। এর ফলে মিশর ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়, আর ইসরায়েল সিনাই উপদ্বীপ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে।
চুক্তিতে বলা হয়েছিল, পশ্চিম তীর ও গাজায় ফিলিস্তিনিদের জন্য স্বশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। কিন্তু চার দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। বিশ্লেষকদের মতে, দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান আন্তর্জাতিকভাবে জনপ্রিয় হলেও ইসরায়েল কখনোই এই সমাধান বাস্তবায়ন করবে না।
কেন দুই রাষ্ট্র তত্ত্ব কার্যকর হয়নি?
বিশ্লেষকদের মতে, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ার পেছনে রয়েছে ইসরায়েলের বসতি সম্প্রসারণ ও চুক্তির প্রতি অসম্মান প্রদর্শন। পশ্চিম তীরে নতুন নতুন বসতি গড়ে ওঠায় ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড খণ্ডিত হয়েছে। সবশেষ এখন তো গাজা মাটির সঙ্গেই মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নির্বিচারে সেখানে চলছে গণহত্যা। রাষ্ট্র গঠনের মূল উপাদান জনগণ। জনগণই যদি না থাকে, তাহলে রাষ্ট্র কীভাবে হবে, গাজা হামলার পর সেটাই এখন প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে।
এ ছাড়া ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রগঠনের ব্যর্থতার জন্য ইসরায়েল যেমন দায়ী তেমনি দেশটির রাজনৈতিক বিভাজনও কম দায়ী নয়। পশ্চিম তীর শাসনের দায়িত্বে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও গাজায় হামাস। এই দুই ভাগে বিভক্ত রাজনীতিও রাষ্ট্র গঠনের পথে বড় বাধা ছিল। এ ছাড়া ইসরায়েলের হাতে ফিলিস্তিনের সীমান্ত, আকাশপথ ও বন্দরের নিয়ন্ত্রণ থাকায় ফিলিস্তিন কার্যত কখনোই সার্বভৌম হয়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী কিছুদেশ দীর্ঘদিন ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছে। এবারও জাতিসংঘের সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছে। এ ছাড়া বারবার সংঘাত ও সন্ত্রাসবাদ উভয় পক্ষের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।
আরএইচ