ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ ভাদ্র ১৪৩২, ২৬ আগস্ট ২০২৫, ০২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

আন্তর্জাতিক

তিব্বতে চীনের বিশাল বাঁধ প্রকল্প, পানিযুদ্ধের শঙ্কায় ভারত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:০১, আগস্ট ২৫, ২০২৫
তিব্বতে চীনের বিশাল বাঁধ প্রকল্প, পানিযুদ্ধের শঙ্কায় ভারত

তিব্বতে চীন তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী বাঁধ নির্মাণ করলে শুষ্ক মৌসুমে প্রধান একটি নদীর পানিপ্রবাহ ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে ভারত।

রয়টার্সের হাতে পাওয়া সরকারি বিশ্লেষণ এবং চারটি নির্ভরযোগ্য সূত্রও একই সতর্কবার্তা দিয়েছে।

এই উদ্বেগের জেরে দিল্লি দ্রুত নিজেদের একটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে, যেন সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবিলা করা যায়।

ভারত সরকার ২০০০ সালের পর থেকেই তিব্বতের আংসি হিমবাহ থেকে নেমে আসা পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিভিন্ন প্রকল্প বিবেচনা করে আসছে। এই হিমবাহ থেকে প্রবাহিত পানি চীন, ভারত ও বাংলাদেশের ১০ কোটিরও বেশি মানুষের জীবনধারায় ভূমিকা রাখে।

তবে ভারতের এসব পরিকল্পনা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে অরুণাচল প্রদেশের সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের তীব্র এবং কখনও কখনও সহিংস প্রতিবাদের কারণে। তাদের আশঙ্কা, যেকোনো বাঁধ তাদের গ্রামগুলো ডুবিয়ে দেবে এবং জীবনধারা ধ্বংস করে দেবে।

গত ডিসেম্বরে চীন জানায়, তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ বাঁধ তৈরি করবে সীমান্তের কাছের একটি জেলায়, যেখান দিয়ে ইয়ারলুং জ্যাংবো নদী ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে।

এতে নয়াদিল্লির আশঙ্কা বেড়েছে, চীন হয়তো অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে তাদের পুরোনো ভূখণ্ডের দাবি মাথায় রেখে নদীর প্রবাহকে চাপের হাতিয়ার বানাতে পারে। আংসি হিমবাহ থেকে উৎপত্তি হওয়া এ নদী ভারতে এসে সিয়াং ও ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিতি পেয়েছে।

ভারতের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ কোম্পানি গত মে মাসে সশস্ত্র পুলিশের পাহারায় জরিপ সরঞ্জাম পাঠায় অরুণাচল প্রদেশের সিয়াং নদীর উজান অঞ্চলে (আপার সিয়াং জেলা), যেখানে বহুমুখী সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এটিই হবে ভারতের সবচেয়ে বড় বাঁধ।  

একইসঙ্গে দ্রুত নির্মাণকাজ শুরু করতে দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তারা ধারাবাহিক বৈঠক করছেন। এর মধ্যে একটি বৈঠক গত জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দপ্তরের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বলে জানিয়েছে দুটি সরকারি সূত্র। তবে বিষয়টির সংবেদনশীলতার কারণে তারা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছে।

চীনা বাঁধের প্রভাব নিয়ে দিল্লির উদ্বেগ উঠে এসেছে ভারত সরকারের এক বিশ্লেষণ প্রতিবেদনে। রয়টার্স এ বিশ্লেষণের নির্দিষ্ট তথ্য চারটি আলাদা সূত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে প্রথমবারের মতো প্রকাশ করেছে।

বেইজিং এখনও বাঁধ নির্মাণের বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রকাশ করেনি। তবে ভারত সরকারের অধিভুক্ত সংস্থা যেমন সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের আগের কাজের ওপর ভিত্তি করে এই বিশ্লেষণ তৈরি করা হয়েছে। এতে জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রায় ১৭০ বিলিয়ন ডলারের চীনা প্রকল্পের সম্ভাব্য আকার বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

দিল্লির হিসাব অনুযায়ী, এই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে চীন বছরে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি সরিয়ে নিতে পারবে, যা সীমান্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ভারতে প্রবেশ করা মোট পানির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। সূত্র এবং নথি বলছে, এর প্রভাব সবচেয়ে ভয়াবহ হবে খরা মৌসুমে, যখন তাপমাত্রা বেড়ে যায় এবং ভারতের বিস্তীর্ণ জমি অনুর্বর হয়ে পড়ে।

আপার সিয়াং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পিত ১৪ বিলিয়ন ঘনমিটার সংরক্ষণক্ষমতা ভারতের জন্য বড় সহায়ক হতে পারে। এর ফলে শুষ্ক মৌসুমে অতিরিক্ত পানি ছাড়া সম্ভব হবে। সরকারি নথি ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এতে গুয়াহাটি শহরে পানির ঘাটতি ২৫ শতাংশের পরিবর্তে কমে দাঁড়াবে মাত্র ১১ শতাংশে। কৃষি ও শিল্পে পানিনির্ভর এ শহরের জন্য বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রকল্পটি চীনের সম্ভাব্য পদক্ষেপও মোকাবিলা করতে পারবে। বিশেষ করে হঠাৎ অনেক পানি ভাটির দিকে ছেড়ে দিয়ে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হলে ভারতের বাঁধ সেটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করবে।

নথি অনুযায়ী, যদি বাঁধে সংরক্ষিত পানি ন্যূনতম মাত্রায় থাকে, অর্থাৎ ধারণক্ষমতার অর্ধেকেরও কম থাকে, তাহলে চীনের অবকাঠামোয় কোনো ভাঙন ঘটলে ছেড়ে দেওয়া অতিরিক্ত পানির পুরোটা শোষণ করতে পারবে ভারতীয় বাঁধ। এজন্যই দেশটি সবসময় বাঁধের অন্তত ৩০ শতাংশ খালি রাখার প্রস্তাব বিবেচনা করছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

এ বিষয়ে রয়টার্সকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, তাদের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো নিরাপত্তা ও পরিবেশ সুরক্ষার জন্য কঠোর বৈজ্ঞানিক গবেষণার মধ্য দিয়ে গেছে। এসব প্রকল্প ভাটির দেশগুলোর পানি, পরিবেশ কিংবা ভূতাত্ত্বিক অবস্থার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে না।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, চীন সবসময় সীমান্ত পেরোনো নদীগুলোর উন্নয়ন ও ব্যবহার নিয়ে দায়িত্বশীল মনোভাব বজায় রেখেছে। ভারত ও বাংলাদেশসহ ভাটির দেশগুলোর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই যোগাযোগ ও সহযোগিতা চলছে।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দপ্তর, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পানি মন্ত্রণালয় রয়টার্সের প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়নি। রাষ্ট্রায়ত্ত জলবিদ্যুৎ কোম্পানি এনএইচপিসিও মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ১৮ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তার চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বাঁধ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একই মাসে জয়শঙ্করের এক সহযোগী সংসদে জানান, ভাটি এলাকায় মানুষের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে, যার মধ্যে বাঁধ নির্মাণও রয়েছে।

তবে পানিকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগে ভারতকেও অভিযুক্ত করেছে পাকিস্তান। গত মে মাসে ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র পাকিস্তানের। চলতি বছরই দিল্লি ১৯৬০ সালের পানি বণ্টন চুক্তি থেকে সরে এসেছে। তারা আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীর প্রবাহ ভাটির দেশ পাকিস্তানের দিকে না দিয়ে অন্যদিকে সরানোর পরিকল্পনাও করছে।

এক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছে, ভারতকে চুক্তি মেনে চলতেই হবে। তবে দিল্লি বলছে, এ বিষয়ে ওই ট্রাইব্যুনালের কোনো এখতিয়ার নেই। ।

উন্নয়ন নাকি ধ্বংস?

গত মে মাসে এনএইচপিসি কর্মীরা অরুণাচল প্রদেশের পারং গ্রামে জরিপের সরঞ্জাম আনতে গেলে স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। তারা জরিপের যন্ত্রপাতি ভাঙচুর করে, পাশের একটি সেতুর ক্ষতি করে এবং নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশের তাঁবুও লুট করে।

এই বিক্ষোভ-আন্দোলনে অংশ নেওয়া অধিকাংশই অরুণাচলের আদিবাসী ‘আদি’ সম্প্রদায়ের মানুষ। তারা সিয়াং নদীর পানি ও পাহাড়ি কুয়াশাচ্ছন্ন উপত্যকার জমিতে ধান, কমলা ও মিষ্টি লেবুর চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে।  

বাঁধ নির্মাণ ঠেকাতে গ্রামবাসী আঞ্চলিক সড়কগুলোতে অস্থায়ী পাহারার ব্যবস্থা করেছে, যাতে এনএইচপিসি কর্মীরা ঢুকতে না পারেন। ফলে নিরাপত্তাকর্মীদের রাতের আঁধারে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে সম্ভাব্য নির্মাণস্থলে পৌঁছাতে হচ্ছে।

দুটি সূত্র জানিয়েছে, প্রস্তাবিত বাঁধের জলাধারেই অন্তত ১৬টি আদি গ্রাম বিলীন হয়ে যাবে। এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রায় ১০ হাজার মানুষ। আর সম্প্রদায়ের নেতাদের দাবি, সামগ্রিকভাবে এর প্রভাব পড়বে লাখেরও বেশি মানুষের ওপর।

স্থানীয় এক মুদি ব্যবসায়ী ও দুই সন্তানের মা ওদোনি পালো পাবিন বলেন, আমরা এই জমিতে এলাচ, ধান, কাঁঠাল আর নাশপাতি ফলাই। এই আয়েই সন্তানদের পড়াশোনা আর সংসার চলে। আমরা জীবন দিয়ে হলেও এই বাঁধের বিরোধিতা করব।  

তবে মোদির দলের সদস্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রকল্পটির পক্ষে রয়েছেন। তার মতে, চীনের পরিকল্পিত বাঁধই অরুণাচলের জন্য অস্তিত্বের হুমকি।

 রাজ্য সরকার এক বিবৃতিতে জানায়, এই প্রকল্প পানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে। তারা আরও জানায়,  ক্ষতিপূরণ নিয়ে স্থানীয় পরিবারগুলোর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আদি সম্প্রদায়ের সদস্য অরুণাচলের বিধায়ক আলো লিবাং বলেছেন, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পেলে স্থানীয়দের স্থানান্তরে রাজি করানো সম্ভব হতে পারে।

তিনটি সূত্রের বরাতে জানা গেছে, গ্রামবাসীরা যেন অন্যত্র সরে যেতে আগ্রহী হয়, সেজন্য শিক্ষা ও জরুরি অবকাঠামোয় এনএইচপিসি প্রায় ৩০ লাখ ডলারের বেশি খরচ করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দপ্তর থেকেই এ ধরনের নির্দেশনা এসেছে বলে জানা গেছে।

অরুণাচল সরকার ও স্থানীয়দের বরাত দিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি ওই অঞ্চলের তিনটি গ্রাম এনএইচপিসি কর্মকর্তাদের বাঁধ-সংক্রান্ত কাজ করার অনুমতি দিয়েছে।

ভারতে বড় বাঁধ নির্মাণ সবসময়ই আন্দোলনের মুখে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব আন্দোলন প্রকল্পকে বছরের পর বছর বিলম্বিত করেছে, আবার কখনও বাধ্য করেছে ছোট করে নির্মাণ করতে।

চারটি সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, আপার সিয়াং বাঁধ অনুমোদন পেলেও নির্মাণ শুরু হওয়ার পর তা শেষ হতে এক দশক পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। অর্থাৎ, চীনের প্রকল্প ভারতের আগেই সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বেইজিং আশা করছে, ২০৩০ সাল থেকে ২০৩৫ সালের মধ্যেই তাদের বাঁধ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।

এই বিলম্বের ফলে ভারতের বাঁধ নির্মাণকাজ চলাকালে চীন যদি বর্ষা মৌসুমে হঠাৎ বিপুল পরিমাণ পানি ছেড়ে দেয়, তবে অস্থায়ী কাঠামো ভেসে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে—বলেছে দুটি সূত্র।

আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ ও আদি আন্দোলনকারীরাও সতর্ক করে বলেছেন, ভূমিকম্পপ্রবণ তিব্বত ও অরুণাচলে বড় বাঁধ নির্মাণ ভাটির মানুষের জন্য অতিরিক্ত ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারত-চীন পানি সম্পর্ক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সায়নাংশু মোদক বলেন, চীনের বাঁধটি এমন এক এলাকায় তৈরি হচ্ছে, যা অত্যন্ত ভূমিকম্পপ্রবণ এবং যেখানে প্রায়ই চরম আবহাওয়া দেখা যায়।

তিনি আরও বলেন, এ ধরনের চরম আবহাওয়া ভূমিধস, কাদা ধস এবং হিমবাহ হ্রদ ভেঙে বন্যার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। ফলে বাঁধের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হওয়াটা খুবই যৌক্তিক। ভারতকে অবশ্যই এ বিষয়ে চীনের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত।

আরএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।