ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ শ্রাবণ ১৪৩২, ২২ জুলাই ২০২৫, ২৬ মহররম ১৪৪৭

ভারত

বিজেপি শাসিত রাজ্যের ভারতীয় বাঙালিদের বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করা হচ্ছে

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৩৬, জুলাই ৮, ২০২৫
বিজেপি শাসিত রাজ্যের ভারতীয় বাঙালিদের বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করা হচ্ছে ভারতীয় নাগরিক পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার বাসিন্দা উত্তম কুমার ব্রজবাসীকে আসাম রাজ্য সরকার নোটিশ পাঠিয়েছে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী অভিযোগ করে।

ভারতে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোয় বাংলা ভাষায় কথা বলাই যেন অপরাধ! তাদের বাংলাদেশে পাঠানোর গভীর চক্রান্ত চালানো হচ্ছে, এমনই অভিযোগ করেছে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিক উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান সামিরুল ইসলাম। তার দাবি, ভারতীয় হওয়া সত্ত্বেও বীরভূম জেলার ছয়জনকে বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করা হয়েছে।

অপরদিকে এনআরসি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জি) আতঙ্কে ঘুম উড়েছে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার দিনহাটার বাসিন্দা উত্তম কুমার ব্রজবাসীর। তাকে দেশটির আসাম রাজ্যের সরকার নোটিশ পাঠিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, আগামী ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে উপযুক্ত নথি (ভারতীয় পরিচয়পত্র) দেখাতে না পারলে তাকে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হিসেবেই চিহ্নিত করা হবে। তবে এমন চিঠি সামনে আসতেই সরব হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যটির বীরভূম এবং কোচবিহার জেলায় একাধিক ঘটনা সামনে আসতেই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে।

গত কয়েক দশক ধরে বংশপরম্পরায় কোচবিহারের দিনহাটার চৌধুরীহাটে বসবাস করছেন উত্তম কুমার ব্রজবাসী। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই ব্যক্তি আজ পর্যন্ত কোচবিহারের বাইরে যাননি। আসাম রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে দিনহাটার চৌধুরীহাটের সাদিয়াল কুঠি এলাকার উত্তম কুমার ব্রজবাসীকে পাঠানো হয়েছে অবৈধ অনুপ্রবেশের নোটিশ। তাকে সময় দেওয়া হয়েছর চলতি মাসের ১৫ জুলাই পর্যন্ত।

নোটিশ পেয়েই মাথায় বাজ ভেঙে পড়েছে উত্তমের। তিনি বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারির দিকে পুলিশ মারফত আমার বাড়িতে একটি এনআরসি সংক্রান্ত চিঠি আসে। এরপর আমি প্রতিবেশীদের সেই চিঠিটি দেখালে জানতে পারি, সেটা আসাম সরকার অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আমাকে চিহ্নিত করে নোটিশটি পাঠিয়েছে। নোটিশটি আসামের গুয়াহাটি থেকে এসেছে।

উত্তমের দাবি, আসাম তো দুরস্ত, তিনি আজ পর্যন্ত কোচবিহারের বাইরে কোনোদিন যাননি। এমনকি আসামে তার কোনো আত্মীয় নেই। আসামের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, অথচ সেই রাজ্যের প্রশাসনের তরফে এনআরসি নোটিশ পেয়েছেন উত্তম।

তিনি বলেন, এরপরে আমি এক আইনজীবীর সহযোগিতায় আমার সমস্ত নথি আসামে পাঠিয়েছিলাম। পরবর্তী চিঠিতে আমার থেকে ১৯৬৩ সালের নথি চায়। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন (পশ্চিমবঙ্গ) আমাকে সেই কাগজ দিতে পারেনি।

এ নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সামাজিক মাধ্যমে তিনি লিখেছেন, আমি হতবাক ও অত্যন্ত বিচলিত হয়েছি জেনে যে, কোচবিহারের দিনহাটার বাসিন্দা রাজবংশী সম্প্রদায়ের উত্তম কুমার ব্রজবাসীকে আসামের ফরেনার্স ট্রাইবুনাল, এনআরসি নোটিশ জারি করেছে। গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি এই বাংলার বাসিন্দা। তার বৈধ পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও, তাকে ‘বিদেশি/অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ সন্দেহে হয়রানি করা হচ্ছে।

মমতা বলেন, এটি আমাদের গণতন্ত্রের ওপর একটি পরিকল্পিত আক্রমণ ছাড়া আর কিছুই নয়। এটিই প্রমাণ করে যে, আসামে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, যেখানে তাদের কোনো ক্ষমতা বা অধিকার নেই। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ভয় দেখানো, ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া এবং নিশানা করার একটি পূর্বপরিকল্পিত নোংরা চক্রান্ত চলছে। এই অসাংবিধানিক আগ্রাসন জনবিরোধী এবং এটি বিজেপির বিপজ্জনক ষড়যন্ত্রকে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট করে দিচ্ছে যে, গণতান্ত্রিক সুরক্ষাকে ধ্বংস করে বাংলার মানুষের পরিচয় মুছে ফেলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বিজেপি।

এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে সমস্ত বিরোধী দলগুলির একজোট হওয়া এবং বিজেপির বিভাজনমূলক ও দমন পীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো অত্যন্ত জরুরি। ভারতবর্ষের সাংবিধানিক কাঠামোকে ধ্বংস করা হলে, বাংলা চুপ করে থাকবে না, বলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।

এ বিষয়ে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহ বলেছেন, বাংলার স্থানীয় নাগরিককে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করছে। কী করে তাকে বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করা হয় আমরা সেটা দেখতে চাই।

ভারতীয়দের বাংলাদেশে পুশ ইন করা নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিক উন্নয়ন পর্ষদের চেয়ারম্যান সামিরুল ইসলাম। তার অভিযোগ, বাংলায় কথা বলার অপরাধে পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের বাংলাদেশে পাঠিয়েছে বিজেপি শাসিত রাজ্যের পুলিশ।

তিনি জানান, সম্প্রতি বীরভূম জেলার মুরারই ও পাইকর থেকে দুটি পরিবারকে বাংলাদেশ সীমান্তে পুশ ইন করা হয়েছে বলে, তাদের কাছে পরিবারের তরফে অভিযোগ এসেছে।

এ নিয়ে মুরারই গ্রাম প্রশাসন (পঞ্চায়েত) প্রধান নিতু রবিদাস জানিয়েছেন, আমাদের এলাকার বাসিন্দা, যাদের আটক করে নাগরিকত্ব প্রমাণের চিঠি চেয়ে পাঠায় দিল্লি প্রশাসন। সেসব দিলেও তার কোনো উত্তর আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

নিতু রবিদাসের অভিযোগ, বিজেপি শাসিত রাজ্যে পরিকল্পনা মাফিক এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে দেশের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে।

উড়িষ্যা, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশের মতো দিল্লি থেকেও এবার বাংলাদেশে পুশ ইন করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার পাইকর ও মুরারই থানার দুই পরিবারকে। দুই পরিবারের সদস্যরা হলেন পাইকর থানার সুইটি বিবি (৩৩), কুরবান শেখ (১৫), ইমাম শেখ (৫) এবং মুরারই থানার ধীতোরা গ্রামের দানিস শেখ (২৯), সোনালী বিবি (২৬) ও সাবির শেখ (৫)।

এ দুই পরিবার দিল্লিতে বহু বছর ধরে ইট ভাঙার কাজে যুক্ত। এ বছর দিল্লিতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরই মুসলিম পরিবারদের বাংলা ভাষায় কথা শুনলেই নথি চাইছে। তাদের ভারতীয় ডকুমেন্ট থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশি বলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। ওই দুই পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ তাদের গাড়িতে নিয়ে বাংলাদেশ সীমন্তে ছেড়ে দিয়েছে।

এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিক পর্ষদের চেয়ারম্যান সামিরুল ইসলাম জানিয়েছে, বিজেপি শাসিত রাজ্যে এই ধরনের ঘটনা প্রশাসন জেনে বুঝে ঘটাচ্ছে। ওই দুই পরিবারকে কলকাতায় ডাকা হয়েছে। মঙ্গলবার (৮ জুলাই) দিল্লি প্রশাসনের বিরুদ্ধে কলকাতা উচ্চ আদালতে মামলা করা হবে।

ভিএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।