ঢাকা, রবিবার, ৩১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ১৫ জুন ২০২৫, ১৮ জিলহজ ১৪৪৬

ফুটবল

জিয়ান্নি ইনফান্তিনো: ফিফার সংস্কারক নাকি অলিখিত সম্রাট?

স্পোর্টস ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০:২৯, জুন ১৩, ২০২৫
জিয়ান্নি ইনফান্তিনো: ফিফার সংস্কারক নাকি অলিখিত সম্রাট? জিয়ান্নি ইনফান্তিনো/সংগৃহীত ছবি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষায় জিয়ান্নি ইনফান্তিনো , "ক্রিসমাসের সকালে খেলনা দেখে হাসিখুশি শিশুর মতো। "

ওভাল অফিসে দাঁড়িয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প মিষ্টি হেসে বললেন,

"ওয়াও! ও তো দেখি যেন ক্রিসমাসের সকালে ঘুম ভেঙে গাছের নিচে খেলনা দেখে মেতে ওঠা এক শিশু! এই উচ্ছ্বাস দেখে মুগ্ধ হতে হয়।

"

ফিফা প্রেসিডেন্ট ইনফান্তিনো মাথা হেলিয়ে হাসতে হাসতে ট্রাম্পের বর্ণনায় সায় দিলেন। এর কয়েক মাস আগে ২০২৬ বিশ্বকাপের প্রস্তুতি কমিটির সভায় ট্রাম্প তাকে "আমার প্রিয় বন্ধু" এবং "ফুটবলের রাজা... এক অর্থে" বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।  

কথাটা একদিক দিয়ে সত্য। ফিফার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইনফান্তিনোই বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তার হাতেই জন্ম নিয়েছে ৩২ দলের ক্লাব বিশ্বকাপ, ৪৮ দলের বিশ্বকাপের মতো বৈপ্লবিক আইডিয়া। কাতারের প্রাইভেট জেটে চড়ে তিনি ঘুরে বেড়ান বিশ্বজুড়ে—খেলোয়াড়, রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে ছবি তোলেন, ৩০ লাখ ইন্সটাগ্রাম ফলোয়ারকে শেয়ার করেন অভিযানের গল্প। তার এই উচ্ছ্বাস ট্রাম্পের বর্ণনার শিশুটিকেই মনে করিয়ে দেয়।

"সূর্য রাজা" থেকে ফিফার রক্ষক!

ইনফান্তিনো নিজেকে বর্ণনা করেন "ফুটবলের মাধ্যমে বিশ্বকে একত্রকারী" হিসেবে। ফিফাকে বলেন "মানবতার জন্য আনন্দের যোগানদাতা"। সুইস সাংবাদিকরা তার নাম দিয়েছেন 'সূর্য রাজা'—ফ্রান্সের দাম্ভিক রাজা চতুর্দশ লুই-এর মতো। নতুন ক্লাব বিশ্বকাপ ট্রফিতেও তার নাম খোদাই করা হয়েছে (দুই বার!)। তার প্রতিটি পদক্ষেপ ক্যামেরাবন্দি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা হয়।  

ইউরোপীয় ফুটবল সংস্থা উয়েফার প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার সেফেরিন একদিন ঠাট্টা করে বলেছিলেন,

"কোনো ফুটবল প্রশাসকেরই ভাবা উচিত নয় যে আমরা খেলার নায়ক—কারণ আমরা নই। "

অপ্রত্যাশিত উত্থান

এক দশক আগেও ইনফান্তিনো ছিলেন উয়েফার এক নিরীহ আইনজীবী—চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ড্রয়ে গৎবাঁধা বক্তৃতা দেওয়া লোক ("গালাতাসারাই... নিশ্চয়ই তুরস্কের চ্যাম্পিয়ন, ১৯৮৯-এর সেমি-ফাইনালিস্ট")। ২০১৫-এ সেপ ব্লাটারের পতনের সময় কেউ ভাবেনি এই মানুষটিই ফিফার হাল ধরবেন। উয়েফার সহকর্মীরা আজও অবাক। তাদের ভাষায়,

"২০১৬-তে ক্ষমতায় এসে ইনফান্তিনো আমূল বদলে গেছেন। এই রূপান্তরিত মানুষটাকে চিনতে পারছি না। "

শৈশব: 'পিকোলো' থেকে ফুটবল জাদুকর

শৈশবে সবাই ডাকত 'পিকোলো' (ছোট্টটি)। ১৯৭০ সালে সুইজারল্যান্ডে জন্ম নেওয়া ইনফান্তিনো শৈশবে গুরুতর অসুস্থ ছিলেন—ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল ও যুগোস্লাভিয়ার বেলগ্রেড থেকে রক্ত নিয়ে বাঁচানো হয় তাকে। ইতালীয় অভিবাসী বাবা ভিঞ্চেনজো ও মা মারিয়ার সন্তান হিসেবে তিনি সুইজারল্যান্ডে বড় হয়েও নিজেকে ইতালিয়ান ভাবতেন। পারিবারিক আর্থিক সংগ্রাম ছিল চরমে—বাবা রাতের ট্রেনে কাজ করতেন, মা স্টেশনে সিগারেট বিক্রি করতেন।

"সুইসরা আমাদের প্রতি বর্ণবিদ্বেষ দেখাত,"

—সে সময়ের কথা স্মরণ করে বলেন ইনফান্তিনোর চাচাত ভাই ডানিয়েল নেলেনে। ইনফান্তিনোর শখ ছিল ফুটবল, কিন্তু খেলায় প্রতিভা না থাকায় তিনি হয়ে উঠলেন সংগঠক। স্থানীয় ক্লাব এফসি ব্রিগ-গ্লিসে তরুণ অভিবাসীদের দলকে সংযুক্ত করার প্রস্তাব দিয়ে বোর্ডকে রাজি করিয়েছিলেন মাত্র ২০ বছর বয়সেই!

ক্ষমতার দৌড়: ব্লাটারের ছায়া থেকে ফিফার সিংহাসন

আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে ফিফার ১২১ বছরের ইতিহাসে মাত্র ৯ জন প্রেসিডেন্ট—তাদের মধ্যে দুই প্রেসিডেন্টের জন্মস্থান মাত্র ১০ কিমি দূরে! (ব্লাটার: ভিস্প; ইনফান্তিনো: ব্রিগ-গ্লিস)। উয়েফার আইন বিভাগে যোগ দেওয়ার পর ফরাসি কিংবদন্তি মিশেল প্লাতিনির ছত্রছায়ায় তার ক্যারিয়ার জোরে এগোয়। কিন্তু ২০১৫-এ প্লাতিনি দুর্নীতির দায়ে সাসপেন্ড হলে "ফিফা পরিষ্কার করার" প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে লড়েন ইনফান্তিনো।

তার জয়ের মূল হাতিয়ার ছিল আর্থিক লোভ।

"ফিফার টাকা তোমাদের টাকা!"

—বলেই তিনি প্রতিটি সদস্য দেশকে ৪ বছরে ৫০ লাখ ডলার দেওয়ার ঘোষণা দেন। এই টাকা আসবে বিশ্বকাপের দল বাড়িয়ে (৪০ থেকে ৪৮) টেলিভিশন রাইটসের দাম চড়িয়ে। তবে খেলোয়াড়দের বাড়তি চাপের প্রশ্ন এড়িয়ে যান তিনি।

ক্ষমতায় ইনফান্তিনো: সংস্কারক নাকি নতুন সম্রাট?

ইতিবাচক দিক

ইনফান্তিনোর হাত ধরে ফিফার রাজস্ব চার বছরে ১০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে (২০১৮-এর দ্বিগুণ!)। নিউজিল্যান্ড ফুটবল ফেডারেশনের সিইও অ্যান্ড্রু প্র্যাগনেলের মতে:

"গরিব দেশগুলোতে ফুটবলের উন্নয়নে টাকা পৌঁছানোয় ইনফান্তিনো যুগান্তকারী। "

এছাড়া তিনি নারী ফুটবলে সৌদি আরবের মতো রক্ষণশীল দেশকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন।

বিতর্ক ও সমালোচনা

১. স্বাধীনতা হরণ: 

-২০১৬ সালে নিজের বিরুদ্ধে তদন্ত এড়াতে নৈতিকতা কমিটির প্রধানদের সরিয়ে দেন।
-সুইস আইন বিশেষজ্ঞ মার্ক পিথের অভিযোগ: "ইনফান্তিনো সংস্কার চাননি—ক্ষমতাকে সুসংহত করেছেন। "

২. সম্রাট সুলভ আচরণ: 

-কাতারের প্রাইভেট জেটে ভ্রমণ, ব্যক্তিগত খরচ ফিফার খাতায় তোলা (গদি, ফুল কিনতে টাকা নেওয়া!)।
-ট্রাম্প ও সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের (মোহাম্মদ বিন সালমান) সঙ্গে বৈঠক করতে গিয়ে প্যারাগুয়েতে অনুষ্ঠিত ফিফা কংগ্রেসে ৩ ঘণ্টা দেরি—সভা মুলতবি!

৩. নৈতিক সমঝোতা:

-সৌদি আরবকে "মধ্যম মানবাধিকার ঝুঁকি" বলে ২০৩৪ বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ দেওয়া।
-কাতার বিশ্বকাপের প্রাক্কালে মানবাধিকার সমালোচনাকে "ইসলামভীতি" বলে উড়িয়ে দেওয়া।
-রাশিয়ার পুতিনের হাত থেকে "বন্ধুত্বের পদক" গ্রহণ—অবশ্য ইউক্রেন যুদ্ধের পর রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করেন।

৪. আত্মম্ভরিতা:

-মাইকেল লাউবারের গোপন বৈঠক, "পানামা পেপার্স" কেলেঙ্কারিতে জড়ানো।
-নিজের মেয়াদ ২০৩১ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর কৌশল: "আমার প্রথম মেয়াদ ছিল অসম্পূর্ণ!"
-বেতন বেড়ে বছরে ৫০ লাখ ডলার (২০১৬-এ ২৫ লাখ ছিল)।

"আজ আমি কাতারি, আজ আমি অভিবাসী শ্রমিক..."

২০২২ বিশ্বকাপের আগের রাতের সেই বিখ্যাত বক্তৃতায় ইনফান্তিনো বলেছিলেন,

"আজ আমি কাতারি... আজ আমি আফ্রিকান... আজ আমি সমকামী... আজ আমি অভিবাসী শ্রমিক। কারণ শৈশবে আমিও বৈষম্যের শিকার হয়েছি!"

এই বক্তব্যকে কেউ বলেন "সাহসী", কেউ "বেমানান"। তবে এরপর থেকেই তিনি প্রচারমাধ্যম এড়িয়ে চলেন—ইনস্টাগ্রামেই শুধু সক্রিয়। সম্প্রতি আমেরিকান স্ট্রিমার 'স্পিড'-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি নতুন ট্রফির চাবি ঘুরিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, "দেখো, এটা যাদুর মতো!" স্পিডের প্রতিক্রিয়া: "হোয়াট দ্য হেল? এটা তো অসাধারণ!" —ঠিক যেমন ট্রাম্প বলেছিলেন, "ওয়াও, তুমি ঠাট্টা করছ!"

চূড়ান্ত প্রশ্ন: তিনি কে?

ফুটবল-পাগল শিশু? যিনি ইতালীয় অভিবাসী পরিবারে জন্ম নিয়ে বৈষম্য জয় করে বিশ্ব ফুটবলের শীর্ষে পৌঁছালেন?

নাকি ক্ষমতালোভী? সংস্কারের মুখোশ পরে ফিফাকে আবারও রাজনীতির খেলার গুটি বানালেন?

"ক্ষমতা মানুষকে বদলে দেয়—কিংবা প্রকৃত রূপ উন্মোচন করে," —মন্তব্য এক ফুটবল প্রশাসকের, যিনি উয়েফায় ইনফান্তিনোর সহকর্মী ছিলেন। আজও সেই "ক্রিসমাসের সকালের শিশু" টিকে আছেন, কিন্তু তার হাতের খেলনা এখন পুরো ফুটবল বিশ্ব।  

দ্য অ্যাথলেটিক থেকে অনূদিত এবং ঈষৎ সংক্ষেপিত।

এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।