ঢাকা: আধুনিক পৃথিবী এক দিনে সৃষ্টি হয়নি। ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’।
ভৌগলিক সীমারেখা টানলে, বাংলাদেশেও এমন ইতিহাস সৃষ্টি করা নারী জন্ম নিয়েছেন। তারা প্রাচীনকাল থেকেই তাদের কৃতিত্বের মাধ্যমে বদলে দিয়েছেন সমাজ, সংস্কৃতি ও মানুষের চিরাচরিত ধ্যানধারণা।
০৮ মার্চ ১০৫তম আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নিজেদের অবদানের মাধ্যমে যারা ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন, সেসব বাংলাদেশি নারীর গল্প নিয়েই এবারের আয়োজন।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
১.
বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া নারীর স্বাধীনতার জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। তিনি ১৮৮০ সালের ০৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলায় জন্ম নেন। সমাজের অন্ধকার পথকে পেছনে ফেলে নারীর এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে তিনি লিখেছেন অসংখ্য অনুপ্রেরণামূলক লেখা।
বিশেষ করে মুসলিম নারীকে উন্মুক্ত সৃজনশীল পরিসরে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা অসীম। নারী-পুরুষের ভেদাভেদ দূর করে একই সঙ্গে সমাজ গড়ার প্রেরণা হিসেবে যুগে যুগে মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছেন এ মহিয়সী নারী।
তার গ্রন্থগুলোর মধ্যে সুলতানার স্বপ্ন, অবরোধবাসিনী, পদ্মরাগ ও মতিচূর উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও শিক্ষা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীদের এগিয়ে নিতে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল ও আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩২ সালের ০৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া মারা যান।
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
২.
মেয়েটির ছদ্দনাম ফুলতার। আর ডাক নাম রানি। বিশ্বের কাছে পরিচিত ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম বিপ্লবী নারী হিসেবে। ১৯১১ সালের ০৫ মে চট্টগ্রামে জন্ম নেন প্রীতিলতা।
স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় সূর্যসেনের নেতৃত্বে স্বশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দেন এবং ১৫ জনের একটি দলও পরিচালনা করেন তিনি। পাহাড়তলী ইউরোপীয়ানের ক্লাব দখলের সময় পুলিশ প্রীতিলতার দলটিকে আটক করে। পুলিশের কাছে ধরা দেওয়ার চাইতে বিপ্লবের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করাটাই বুঝি তার কাছে মহৎ ছিল। তাই সেদিন ঘটনাস্থলে (১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর) পটাশিয়াম সায়ানাইড বিষ খেয়ে আত্মাহুতি দেন প্রীতিলতা।
সুফিয়া কামাল
৩.
নারী সমাজ তখনও উন্নত হয়নি। শিক্ষার আলো দ্বারপ্রান্তে তো দূরে থাক, বাড়ির ত্রি সীমানায়ও উঁকি দেয়নি। ঠিক সেসময় জ্ঞানের অগ্রদূত হিসেবে জন্ম নেন বেগম সুফিয়া কামাল। তিনি ১৯১১ সালের ২০ জুন বরিশালের এক মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন নারী শিক্ষার পথিকৃত এ লেখক।
সেসময় স্কুলে যাওয়ার সুযোগ না থাকলেও, ঘরে বসেই পড়াশুনা শুরু করেন সুফিয়া কামাল। সাহিত্য চর্চার পাশাপাশি লেখালেখিও চালিয়ে যান পুরোদমে। সাহিত্যক্ষেত্রে পদচারণা ছাড়াও তিনি শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ও নারীদেরও অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেন।
সুফিয়া কামাল ১৯৫৬ সালে শিশুদের ‘কচি কাঁচার মেলা’ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন ও গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় মারা যান। বাংলাদেশী নারীদের মধ্যে তাকেই প্রথম পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়।
নূরজাহান বেগম
৪.
১৯২৫ সালের ০৪ জুন চাঁদপুরে জন্ম নেন কলমযোদ্ধা নূরজাহান বেগম। জীবনে পড়াশোনার প্রথম হাতেখড়ি হয় তার মায়ের কাছেই। বাবার হাত ধরে প্রবেশ করেন সাংবাদিকতায়। আর তার হাত ধরেই খবরের কাগজ সম্পাদনায় পা রাখেন বাংলাদেশের নারীরা।
ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন নূরজাহান বেগম। স্বামী বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই। তার বাবা মোহাম্মাদ নাসিরুদ্দিন ছিলেন ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক। পরে তিনিও সেখানে যোগ দেন। তার অসীম অাগ্রহ দেখে পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে তার বাবার উদ্যোগে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকা। প্রথমা দিকে সুফিয়া কামাল ছিলেন ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক। আর তিনি ছিলেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক।
তিনি লেখালেখি ছাড়াও ছিলেন বিভিন্ন সামজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হিসেবে নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠ চক্রের সম্মাননা লাভ করেন। এছাড়াও তার অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি ক্রেস্ট, রোকেয়া পদক ও পত্রিকা শিল্পে তার অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক নারী সংগঠন ইনার হুইল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮ সম্মাননা এবং আরও কিছু সাহিত্য পুরস্কার।
জাহানারা ইমাম
৫.
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম একাধারে কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। মুক্তিযুদ্ধে তার বড় ছেলে শফি ইমাম রুমী শহীদ হন। যুদ্ধের পর তিনি সব মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে স্বীকৃতি পান এবং তাকে শহীদ জননী হিসেবে ভূষিত করা হয়। একাত্তরের ঘাতক দালাল রাজাকারদের নির্মূলে তিনি রেখেছেন অসামান্য ভূমিকা।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম দলিল ‘একাত্তরের দিনগুলি’ গ্রন্থের এ লেখক ১৯২৯ সালে ০৩ মে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে জন্ম নেন। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি ছিলেন স্কুলের সহকারী শিক্ষক। জীবনের শুরুটা শান্তিময় হলেও ১৯৭১ সালে তাকে যেতে হয় নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে।
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে গোলাম আজম জামায়াতের আমীর ঘোষণা হলে তিনি পরের বছরই ১০১ সদস্যের একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করেন। এছাড়াও গণআদালতে গোলাম আজমের ফাঁসির রায়ও তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৮২ সালে তিনি মুখের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন ও দীর্ঘদিন ধরে দুরারোগ্য এ রোগে ভুগে বাংলাদেশের শহীদ জননী ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৯ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০১৫