ঢাকা, সোমবার, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

উপকূল থেকে উপকূলে

মাচা পেতে ক্লাস, গামছা পরে স্কুল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৩
মাচা পেতে ক্লাস, গামছা পরে স্কুল

ভবানীপুর সাতক্ষীরা থেকে:বিদ্যালয়ের বারান্দা আর শ্রেণিকক্ষে পানি। খেলার মাঠ ডুবে আছে হাটু পানিতে।

কক্ষের ভেতরে কয়েকটি ব্রেঞ্চ একত্রিত করে বানানো পাটাতনের ওপর পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস চলছে। পাশের উঁচু স্থানে বসে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ক্লাস। পানিতে ডুবে থাকা কাঁচা সড়ক পেরিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে বিদ্যালয়ে পৌঁছানই শিক্ষার্থীদের কাছে যুদ্ধের সামিল। এরপর মনোযোগ দিতে হয় ক্লাসের নিয়মিত পড়ায়। আবার সেই পথেই বাড়ি ফেরা ঝক্কি। এটা সাতক্ষীরার তালা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরের ইসলামকাঠি ইউনিয়নের ভবানীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিত্যদিনের হালচিত্র। জলাবদ্ধতায় ডুবে থাকা গ্রামের বাড়িঘর থেকে ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়ে আসছে অতিকষ্ট সহ্য করে।
upkul-bg
কখনো হাটু কিংবা কোমর সমান পানি, কখনো কাদা, আবার কখনো নড়বড়ে সাঁকো পেরিয়ে স্কুলে যাওয়া। এ দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় নিচের শ্রেণির খুদে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যেতে পারছে না।

এ অবস্থায় সামনে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী আর স্কুলগুলোর বার্ষিক পরীক্ষা প্রস্তুতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এ কথা জানালেন শিক্ষক ও অভিভাবকেরা। কোনো বিদ্যালয়ের মাঠে কোমর পানি, কোনো বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষই ডুবে আছে পানিতে।
m120
এ ছাড়াও বেশ কটি বিদ্যালয়ের ক্লাস চালানো হচ্ছে স্কুলের ভেতরে মাচা বানিয়ে, পাশের কোনো বাড়িতে, মক্তবে, মন্দিরে কিংবা বিদ্যালয়ের পাশে উঁচু স্থানে।

তালা সদর থেকে এঁকেবেঁকে পিচঢালা সড়ক চলে গেছে ভবানীপুরে। ইসলামকাঠি ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় থেকে আরো খানিক দূরে ভবানীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু সে অবধি কোনো যানবাহন চলে না।

এক হাটু কাদায় ভরা কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে যেতে হয় বিদ্যালয়ে। পানিতে ডুবে থাকা বিদ্যালয়টির ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডে পত পত করে উড়ছিল জাতীয় পতাকা। বাইরে থেকে বোঝা যায় না বিদ্যালয়ে ক্লাস চলছে। একটু এগিয়ে গেলে চোখে পড়ে প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষে কজন শিক্ষার্থী।

সরেজমিন আলাপচারিতায় জানা যায়, পঞ্চম শ্রেণির লাবনী, রেখা, সবুজ, সুফল, চতুর্থ শ্রেণির ঝুমুর, পুস্পিতা, মনিকা, সুমি, জাকিয়া, অনুপ, তৃতীয় শ্রেণির শিপ্রা, আঁখি, চন্দন ছাড়াও আরো অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসছে নিদারুণ কষ্টে। বিদ্যালয়ের বারান্দায় শুকাতে দেওয়া গামছাগুলো দেখেই বোঝা যায় শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনই কাদাপানি পেরিয়ে স্কুলে আসতে হচ্ছে।

জলাবদ্ধতা সংকটের মাঝেও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মফিজুল ইসলাম একাই বিদ্যালয়ের সব ক্লাস চালাচ্ছেন। শিশু, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি বেলা ১১টা পর্যন্ত। এরপর তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস নেন তিনি।

m2201বিদ্যালয়ের শিক্ষকের চারটি পদের মধ্যে একটি শূন্য। বাকিদের একজন গেছেন হজে। অন্যজন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। বিদ্যালয়ের শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়ের ছয়টি ক্লাসে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯৬ জন। জলাবদ্ধতার কারণে উপস্থিতি কিছুটা কমে এসেছে।

ইসলামকাঠি ইউনিয়নের ইসলামকাঠি আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ ও বারান্দা পানিতে ডুবে আছে। শ্রেণিকক্ষ এক ফুট পানিতে ডুবে আছে। বিদ্যালয়ের কিছু ক্লাস চলছে পাশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।

একই অবস্থা ইউনিয়নের খরাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। শ্রেণিকক্ষ তিন ফুট পানির নিচে। পাশের মন্দির ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বারের বাড়িতে ক্লাস চলছে। একই ইউনিয়নের উত্তর ঘোনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস চলছে বেসরকারি সংস্থা উত্তরণের তৈরি করা টিনশেড ঘরে।

ইসলামকাঠি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. গোলাম ফারুক বাংলানিউজকে বলেন, জলাবদ্ধতায় অন্য সমস্যার সঙ্গে শিক্ষার সংকট ভোগাচ্ছে। শ্রেণিকক্ষ পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণে কয়েকটি বিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। জলাবদ্ধতা এলাকার মানুষের জন্য বিপর্যয় ডেকে এনেছে। জলাবদ্ধ এলাকার মানুষগুলো অতিকষ্টে দিন কাটাচ্ছে। তাদের জন্য নেই পর্যাপ্ত সহায়তা।    

ভবানীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি চিত্তরঞ্জন মন্ডল সরেজমিন বাংলানিউজকে বলেন, বিদ্যালয়ের জন্য ভবন প্রয়োজন। আর বিদ্যালয়ে আস-যাওয়ায় পাকা রাস্তা প্রয়োজন। সমস্যা সমাধানে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে এ অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষা দারুণভাবে ব্যাহত হবে।

3020জলাবদ্ধ এলাকার প্রায় সর্বত্রই পানিতে ডুবে থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চোখে পড়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয় ছাড়াও এ তালিকায় আছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসা। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংকটে আছে। কিন্তু এত সংকট সত্ত্বেও উপজেলার ক্ষতিগ্রস্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা পাওয়া গেলো না কোথাও।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয় মাত্র ৭-৮টি প্রতিষ্ঠানের খবর নিয়ে বসে আছে। একাধিক এলাকা ঘুরে মাঠের সরেজমিন চিত্র ওই কার্যালয়ে জানানো হলে তারা একটি তালিকা তৈরি করেন। ওই তালিকায় বিদ্যালয়ের মাঠে, শ্রেণিকক্ষে ও বারান্দায় পানি ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০-এ।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ মনিরুল ইসলাম বলেন, কিছু বিদ্যালয়ে পানি উঠেছে। তবে কোথাও ক্লাস বন্ধ করা হয়নি। পাশের বাড়ি, অন্য কোনো ভবন, উঁচু স্থান, যেখানেই সম্ভব ক্লাস চালিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সমাপনী ও বার্ষিক পরীক্ষায় যেন কোনো ধরনের অসুবিধা না হয়, সে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।      

বাংলাদেশ সময় ০৩৫১ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩০, ২০১৩   
আরআইএম/এসএইচ/বিএসডি/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।