ঢাকা, সোমবার, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

দিন কাটছে কর্মহীন, চড়া সুদে নিতে হচ্ছে ঋণ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৪৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৩
দিন কাটছে কর্মহীন, চড়া সুদে নিতে হচ্ছে ঋণ

Rofiqulগঙ্গারামপুর (খলিলনগর, তালা, সাতক্ষীরা) থেকে: কপোতাক্ষের উপচে পড়া পানিতে ডুবে থাকায় গ্রামের মানুষের হাতে কোনো কাজ নেই। কৃষিকাজে মাঠে যেতে পারছেন না কৃষক।

ক্ষুদ্র দোকানিরা বসতে পারছেন না দোকানে। ভ্যান চালক তার ভ্যানটি কোথাও ফেলে রেখে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন। কর্মহীন অলস সময়ে কেউ ঘরে মজুদ খাবার দিয়ে দিন পার করছেন, কেউবা চড়া সুদে ঋণ নিচ্ছেন মহাজনদের কাছ থেকে।

এচিত্র জলাবদ্ধ এলাকা সাতক্ষীরার তালা উপজেলার খলিলনগর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের। ঘোষনগর, গঙ্গারামপুর, প্রসাদপুর, হরিশ্চন্দ্র কাঠি, গোনালী, নলতা, যে গ্রামেই চোখ যায় একই চিত্র ভেসে ওঠে। বাড়িঘর, ফসলি মাঠ, পুকুর, ডোবা, রাস্তাঘাট সবকিছুই পানির নিচে।

এলাকার মানুষের কষ্টের শেষ নেই। রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে থাকায় বাইরে বের হওয়ার সুযোগ নেই। পানির কারণে ঘরেও থাকা যাচ্ছে না।
Upakul
কার্তিকের শুরুতে শীতের আগমনী মুহূর্তে এই এলাকার যে জমিতে আমনের শীষ দোল খাওয়ার কথা, যেখানে ভোরের শিশিরের ছোঁয়ায় শীতকালীন সবজি বেড়ে ওঠার কথা, সেখানে থই থই পানি। জলাবদ্ধতায় সব হারানো কপোতাক্ষ তীরের মানুষগুলো সেই জমির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নি:শ্বাস ফেলে। বছরের পর বছর জলাবদ্ধতায় এলাকা ডুবে যাওয়ার কারণে এককালের কৃষকেরা দিনমজুরে পরিণত হচ্ছেন। অনেকে এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে ছুটেছেন অন্যত্র।    

সরেজমিন ঘুরে গঙ্গারামপুরে পিচঢালা সড়কের পাশে ছোট্ট চায়ের দোকানে দেখা মেলে এমনই কিছু ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের। কাজের ভরা মৌসুমেও হাতে কাজ নেই বলে অলস সময় কাটিয়ে দিন পার করছেন তারা। গ্রামের বিভিন্ন পেশার কয়েকজন মানুষ আড্ডা দিচ্ছিলেন। কেউবা সময় কাটাচ্ছিলেন তাস খেলে। তালা-পাইকগাছা বিধ্বস্ত সড়ক দিয়ে দু’একটি বাস চলছে অতিকষ্টে। চলছে কিছু ভ্যান। সড়কের দু’ধারে পানিতে প্লাবিত। এই এলাকার মানুষগুলোর যেন কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। আর তাই গঙ্গারামপুরের প্রতিটি দুপুর এভাবেই কেটে যায়।
Upakul-1
দুপুরে কর্মহীন বসে থাকা একজন দিলীপ রায়। গঙ্গারামপুরের বাসিন্দা। সংসারে মানুষ চারজন। জুয়েলারির ব্যবসা আছে। জলাবদ্ধ এলাকার বাসিন্দারা তার ক্রেতা। তাই দোকান বন্ধ করে বাড়িতেই আছেন। জমির ফসল শেষ হয়ে গেছে। ধারদেনা করে চলছেন। দিন কাটছে অতি কষ্টে।

কর্মহীন আরেকজন আসাদুল গাজী। বাড়ি গঙ্গারামপুর গ্রামে। কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এখন বেকার। প্রায় তিন মাস ধরে হাতে কাজ নেই। দোকান থেকে বাকিতে মালামাল নিয়ে দেনা হয়েছেন প্রায় ২০ হাজার টাকা। ইরি মৌসুমে ঘরে মজুত চাল দিয়ে কোনমতে আটজনের সংসার টেনে নিয়ে যাচ্ছেন।

ফিরোজা বেগম। স্বামী মোমিন গাজী। থাকেন গঙ্গারামপুর সড়কের পাশে। দুই ছেলে ভ্যান চালিয়ে সংসারের বোঝা বইছে। রাস্তা খারাপ থাকায় ভ্যানে রোজগার কমে গেছে। পঙ্গু স্বামীর কাজ করতে পারেন না। সংসার চলছে অতিকষ্টে। বেলা গড়িয়ে গেলেও তার জানা নেই দুপুরে কী রান্না হবে। হয়নি চালের যোগাড়।

জলাবদ্ধ এলাকা ঘুরে জানা গেলো, পানিতে ডুবে থাকায় এলাকায় কোনো কাজকর্ম নেই। ফলে বহু মানুষ কাজের সন্ধানে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। কেউবা অন্য এলাকায় শ্বশুড়বাড়ি ঘর জামাই হিসাবে থাকছে। বর্ষাকাল থেকে এই এলাকায় পানি জমতে শুরু করে। প্রায় ছয় মাস এই পানি স্থায়ী হয়। এরমধ্যে তিনমাস খুবই খারাপ অবস্থা থাকে।               
Upakul-2
জলাবদ্ধ এলাকায় ঘুরে এমন হাজারো মানুষের সঙ্গে দেখা মেলে। অতি কষ্টে এক একটি দিন পার করছেন তারা। এলাকাবাসীর অভিযোগ, জনপ্রতিনিধিরা দুর্যোগের সময় এলাকায় আসেন না। নিয়মিত সরকারি সেবাসমূহ বন্টনে নানা অনিয়মের খেসারত দিতে হয় জলাবদ্ধ এলাকার মানুষকে। গ্রামবাসীর সুবিধা বিবেচনায় সুবিধাজনক স্থানে গভীর নলকূপ বসানোর নিয়ম থাকলেও নলকূপ বসে প্রভাবশালীদের বাড়িতে। ফলে জলাবদ্ধতার সময়ে বিশুদ্ধ পানির জন্য এই এলাকার মানুষদের ছুটতে হয় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার।     

খলিলনগরের একাধিক এলাকার বাসিন্দারা জানান, কপোতাক্ষ দিয়ে পানি সরতে না পারার অন্যতম কারণ দখল। এই ইউনিয়নের নিকটবর্তী কপোতাক্ষ এক সময় প্রায় ৫০০ ফুট প্রশস্থ ছিল। এখন কমে এসে ১৫-২০ ফুটে দাঁড়িয়েছে। খলিলনগর অংশে কপোতাক্ষের চর বেদখল হয়ে নদের প্রশস্থতা কমে গেছে। এর সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীরা। তাদের মধ্যে চরের জমি দখল নিয়ে লড়াই চলে, আর জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগ পোহায় এই মানুষগুলো।

খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, খলিলনগর ইউনিয়নের বেশকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার, সড়কসহ বিভিন্ন স্থাপনা প্রায় তিন মাস ধরে পানিতে ডুবে আছে। এরমধ্যে রয়েছে গঙ্গারামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঘোষনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, তালা টেনকিক্যাল কলেজ, কপোতাক্ষ দাখিল মাদ্রাসা, গোনালী বাজার, তালা-পাইকগাছা ১৯ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ১১ কিলোমিটার, প্রধান সড়ক থেকে বাড়িঘরে প্রবেশের সব রাস্তা।

খলিলনগর ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র বলছে, ইউনিয়নের ছয়টি গ্রাম জলাবদ্ধতায় ডুবে আছে। পানিবন্দি প্রায় এক হাজার পরিবার। কিন্তু এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কোন সাহায্য মেলেনি।    
 
বাংলাদেশ সময়: ০৪৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১৩
আরআইএম/এসএইচ/আরকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।