ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

শিক্ষা

আশ্রয়কেন্দ্রের পিইসি পাস ১১ শিশুর স্বপ্ন পূরণ হবে?

তুষার তুহিন, স্টাফ করেসপন্ডেট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১, ২০১৮
আশ্রয়কেন্দ্রের পিইসি পাস ১১ শিশুর স্বপ্ন পূরণ হবে? পুনর্বাসন কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে পিইসি পাস ১১ শিশু। ছবি: বাংলানিউজ

কক্সবাজার: ছয় বছর বয়সে বাবা মারা যান। সংসারের হাল ধরতে দুই বছর পর নিজেও মায়ের সঙ্গে শুরু করে গৃহকর্মীর কাজ। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে এলাকায় কমিউনিটি সভা করতে যান একটি শিশু প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের উপ-পরিচালক জেসমিন আকতার। সেখানে জানতে পারেন ফুটফুটে ছোট্ট মেয়েটির দুর্বিষহ জীবনের কথা। এরপর মাকে বলে তাকে নিয়ে আসেন পুনর্বাসন কেন্দ্রে।

এরপরের গল্প আনন্দের, মানুষের মতো মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখার। শত দুঃখ-দুর্দশার দিন কাটিয়ে এখন এ স্বপ্ন দেখছে কক্সবাজারের রামু উপজেলার গর্জনিয়ার  পূর্ব ভোমাকিং গ্রামের মেয়ে শামীমা আক্তার (১০)।

প্রয়াত হানিফ আনসারী ও ফাতেমা বেগমের এ মেয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষায় পাস করেছে জিপিএ ৩.৫ পেয়ে। শামীমাকে টেকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে স্বপ্ন দেখার এই সুযোগ দেওয়া প্রতিষ্ঠানটির নাম কক্সবাজারের খুরুশকুল রোডের শেখ রাসেল শিশু প্রশিক্ষণ ও পুর্নবাসন কেন্দ্র।

শামীমা বাংলানিউজকে বলে তার সংগ্রামের গল্প, ‘বাড়িতে থাকতে মানুষের বাসায় ঝিয়ের কাজ করতাম। আর রাতের বেলা মা আমাকে অ, আ, ১, ২ এবং নামতা শিখাতেন। এর বেশি কিছুই জানতাম না। এখানে আসার পর স্যার ও ম্যাডামরা আমাকে বাল্যশিক্ষা দেন। তারপর টেকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। ’

শামীমা আক্ষেপ করে জানায়, স্কুলে ড্রেসের কারণে, পরীক্ষার ফি ও মাঝেমধ্যে স্কুল উন্নয়নের জন্য টাকা দিতে না পারায় অনেক কটূ কথা শুনতে হয় তাকে। পুনর্বাসন কেন্দ্রেও পড়ার জন্য আলাদা রুম নেই, চেয়ার টেবিল নেই, গৃহ শিক্ষকও নেই।  

তবে কেন্দ্রের মাদার সাবিনা, এডুকেটর শাহ আলম ও উপ-পরিচালক জেসমিনের দেখভালের কারণে শামীমা পিইসিতে ৩.৫ পেয়েছি বলে জানায় বাংলানিউজকে। সে বড় হয়ে তার মতো দুস্থ শিশুদের জন্য কাজ করতে চায় বলেও জানায়। শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায়ও পিছিয়ে নেই এই শিশুরা।  ছবি: বাংলানিউজকেবল শামীমা নয়, পুনর্বাসন কেন্দ্রটি থেকে তার মতো এমন আরও ১১ অবহেলিত শিশু এবার পিইসিতে পাস করেছে। কেন্দ্রটি বর্তমানে ২১১ শিশুকে লালন-পালন করছে। এদের মধ্যে ৮৮ জনই স্কুলে যায়। সবাই চায় শামীমার মতো আনন্দের কোনো উপলক্ষ বয়ে আনতে।

শিশু মর্জিনা আক্তার জানায়, তার বাবা নেই। মা অন্যের বাসায় কাজ করে। ৪ বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় সে। বাড়িতে থাকতে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছিল। এরপর বাজারে বাজারে ঘুরে তরকারি বিক্রি করতো। সেখান থেকেই তাকে এখানে নিয়ে আসেন জেসমিন আকতার। এবারের পিইসিতে সে ৩.১৭ পেয়েছে। বড় হয়ে শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখে মর্জিনাও।

সাফা ইসলাম রাজনার জন্ম সৌদি আরবে। রাজনা তার তিন বোনসহ বাবা-মায়ের সঙ্গে সৌদিতেই থাকতো। একদিন আততায়ীর গুলিতে তাদের বাবা মারা যান। তারপর তারাও দেশে চলে আসে। এখানে আসার পর চাচাদের কাছে সহায়-সম্পত্তি হারাতে হয় তাদের। মা চলে যান নানুর বাড়িতে। নানুদের অবস্থা তেমন ভালো না হওয়ায় রাজনাকে এই কেন্দ্রে রেখে যান মা। এই রাজনাও এবার পিইসিতে ৩.২৩ পেয়ে পাস করেছে।
 
পুনর্বাসন কেন্দ্রটি থেকে এমনভাবে পাস করেছে সিফা আক্তার, আশরাফিয়া, উর্মি সাদিয়া, ইয়াসমিন আক্তার, রুমি সুলতানা সুখী, জান্নাতুল বকেয়া, সিমলক ও চম্পা আক্তারও।

কেন্দ্রটির এডুকেটর শাহ আলম বাংলানিউজকে বলেন, এরা সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত শিশু। আমরা গ্রামে গ্রামে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে এদের পুর্নবাসন কেন্দ্রে নিয়ে আসি। এই যে ১০ জন মেয়ে ও একজন ছেলে এবারের পিইসিতে পাশ করেছে, এটা পুরোপুরিই তাদের মেধার কারণে।  

পুনর্বাসন কেন্দ্রটির সোশ্যাল ওয়ার্কার সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, পুনর্বাসন কেন্দ্রের শিশুদের ভালো নজরে দেখেন না স্কুল শিক্ষকরা, যেন বোঝা। স্কুল ড্রেস, পরীক্ষার ফি দিতে পারে না বলে তাদের মন্দ কথাও শুনতে হয়। এমন আচরণ পরিবর্তন জরুরি।  

পিইসি পাস করে ফেললেও এই ১১ শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত কেন্দ্রের উপ- পরিচালক জেসমিন আকতার বাংলানিউজকে বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী আমরা একজন শিশুকে বেশি দিন কেন্দ্রে রাখতে পারি না। কিন্তু জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে তাদের এখানে রেখে লেখাপড়া করাচ্ছি। কতো দিন পারব জানি না। তবে চেষ্টা করছি।  

তিনি বলেন, শিশুদের লেখাপড়া করানোটা আমার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। বছরের শুরুতে এদের জন্য ভর্তি ফি, স্কুল ড্রেস, পরীক্ষার ফি যোগাড় করা আমাদের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। আমাদের এতো ফান্ডও নেই। গত বছর জেলা প্রশাসকের অনুরোধে স্কুল কর্তৃপক্ষ এদের ভর্তি করে। এক ব্যবসায়ীর আর্থিক সহযোগিতায় স্কুল ড্রেস পায় তারা। এবার কী হবে জানি না।

জেলা প্রশাসক ছাড়া সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করছে না জানিয়ে জেসমিন আকতার বলেন, জেলা পরিষদ, পৌরসভাসহ নানা সরকারি দপ্তরে আবেদন করে রেখেছি। এই ঝরে পড়া শিশুদের জন্য সমাজের বিত্তবান ও সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতাও প্রয়োজন।

এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে ও সরকারিভাবে সাধ্যমত চেষ্টা করি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে থাকার। সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে এলে এই কাজটা আরও সহজ হয়।

বাংলাদেশ সময়: ২৩২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০১৮
টিটি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।