ঢাকা, বুধবার, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২২ মে ২০২৪, ১৩ জিলকদ ১৪৪৫

অর্থনীতি-ব্যবসা

শুক্রবারের সরেজমিন

ফুলকপির বাম্পার ফলনেও বিপাকে কৃষক!

শাহজাহান মোল্লা ও শামীম হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৫
ফুলকপির বাম্পার ফলনেও বিপাকে কৃষক! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

শুক্রবারের সরেজমিন, বাংলানিউজের নিয়মিত উদ্যোগ। প্রতি শুক্রবার বাংলানিউজের একটি টিম চলে যাচ্ছে কোনো বিশেষ ঘটনাস্থল বা সাইটে।

সেখানে ঘুরে কথা বলে, বিষয়ের গভীরে ঢুকে তুলে আনছে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলের রিপোর্ট ও ফিচার। থাকছে ছবি-ভিডিও। যা প্রকাশিত হচ্ছে পরবর্তী রোববারে। ‘শুক্রবারের সরেজমিন’র এবারের স্পট ছিলো নরসিংদীর সবজি বাজারগুলো। বাংলানিউজ টিম গত শুক্রবার এ জেলার বিভিন্ন বাজার-মাঠ ঘুরে কৃষকের কর্ম-চাঞ্চল্য দেখেছে। আশেপাশে এ পেশায় জড়িত মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে। যার মধ্য থেকে উঠে এসেছে কৃষকের মানুষের চাওয়া-পাওয়ার গল্প। এবারের টিমে ছিলেন চিফ অব করেসপন্ডেন্টস সাজেদা সুইটি, সিনিয়র ফটো করেসপন্ডেন্টস দেলোয়ার হোসেন বাদল, নিউজরুম এডিটর শামীম হোসেন ও শুভ্রনীল সাগর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট শাহজাহান মোল্লা ও আবু খালিদ।

নরসিংদী থেকে ফিরে: রাজধানী ঢাকা-সিলেটসহ বেশ কিছু বড় শহরে সবজির উল্লেখযোগ্য যোগান যায় নরসিংদী থেকে। প্রতিবছর এখানকার সবজি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা, ফেনী ও এর আশপাশের জেলাতে যায়।

নিজ জেলা ও আশপাশের জেলার চাহিদা মিটিয়ে এখন দেশের বাইরেও যাচ্ছে এখানকার সবজি। অন্য সবজির তুলনায় ফুলকপি চাষ লাভজনক হওয়ায় নরসিংদীর অনেক কৃষকই এখন এর চাষ করেছেন।

কৃষকরা আশায় থাকেন সবজি চাষ করে নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের। সেই ভাগ্য নামের সুখ পাখিটা কোনো বছর ধরা দেয়, আবার কোনো বছর থাকে অধরা। এ বছরও ভাগ্যদেবী তাদের দিকে মুখ তুলে তাকায়নি। আর তাইতো প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি মনুষ্য সৃষ্ট কারণে ক্ষতির শিকার হচ্ছেন কৃষকরা।

ঘন কুয়াশা, হরতাল, অবরোধ এসবই তাদের ভাগ্যে বিড়ম্বনার প্রধান কারণ বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। ভৌগলিক কারণে এ অঞ্চলে ধান চাষ হয় ইরি মৌসুমে। বছরের অন্য সময়টা কৃষকদের সবজি চাষের উপর নির্ভর করতে হয়। তাই সবজিই এ অঞ্চলের প্রধান অর্থকরি ফসল বলা চলে।

নরসিংদীর বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে এখন চলছে সবজির মহোৎসব। এখানে চাষ হয়, ফুলকপি, বাধাকপি, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, সিম, ধনেপাতা, পেঁয়াজ, আলু, কাঁচামরিচসহ প্রায় অধিকাংশ সবজি।  

সবজিচাষ করে আশায় বুক বেঁধেছিলেন নরসিংদীর কৃষকরা। কিন্তু তাদের সেই আশায় গুড়েবালিতে পরিণত হয়েছে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা। পাশাপাশি কাঙ্খিত দাম না পেয়ে ফুলকপি, বাধাকপি, সিম নিয়ে অনেকটাই বিপাকে পড়েছে এ অঞ্চলের কৃষক।

শুক্রবার (৯ জানুয়ারি) সরেজমিনে শিবপুর উপজেলার সিঅ্যান্ডবি বাজার, পালপাড়া, ইটাখোলা বাজার, বেলাবোর বারৈচা বাজার ঘুরে নরসিংদীর কৃষকদের দুঃখ-গাথা জীবনের চিত্র পাঠকদের কাছে তুলে ধরেছে বাংলানিউজটিম।

কথা হয় নরসিংদীর কুন্দারচরের কৃষক মমিন মিয়ার (২২) সঙ্গে। তিনি কুন্দারচরের ইসমাইল হোসেনের ছেলে। ফুলকপি খেতেই বাংলানিউজ টিমের কথা হয় যুবক মোমিনের সঙ্গে। তিনি জানিয়েছেন, এ মৌসুমে ফুলকপি চাষ করে পথে বসার অবস্থা।

তার দাবির স্বপক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে মোমিন বলেন, একটা কপি চারা থেকে বড় করা পর্যন্ত বীজ, সার, ওষুধ, লেবার, পানিসহ সব মিলেয়ে খরচ ৮-১০ টাকা। সেই ফুলকপি এখন বিক্রি করতে হচ্ছে ১ টাকা থেকে ২ টাকা। তাও আবার ঠিকমতো ক্রেতা পাওয়া যায় না।

কত টাকা লোকসান হবে এমন প্রশ্ন করতেই উপযুক্ত দাম না পাওয়া চিত্র তার চেহারায় ফুটে উঠেছে। বিষন্ন মনে মোমিন জানালেন, পরিবারের ৬ সদস্যের মধ্যে তারা দুই ভাই খেতে কাজ করে, দুই বোনের মধ্যে একজনের বিয়ে দিয়েছে। অন্যজন পড়াশুনা করছে।

তিনি বলেন, বাজার দর ভাল না থাকায় খেতেই অনেক ফুলকপি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিক্রির অভাবে এসব ফুলকপি এখন খেতেই পঁচাতে হচ্ছে। এজন্য টানা অবরোধও দায়ী বলে মনে করেন এ কৃষক।

কৃষক মোমিন ৩ কানি (এক কানি সমান ২৬ শতাংশ) জমি ফুলকপি চাষ করেছেন বলে জানান। তার কাছে রয়েছে ৩ জাতের ফুলকপি। এরমধ্যে ‘হ্যামা’ আকারে বড় বলে বাজারে এর চাহিদাও বেশি। এছাড়া রয়েছে ‘সিরাজী’, ও ‘৭৭’ জাতের কপি। বীজ থেকে শুরু করে একটা ফুলকপি বিক্রির উপযোগী হতে সময় লাগে ৬০ থেকে ৬৫ দিন।  

মোমিন মিয়ার সঙ্গে সুর মিলিয়ে আরেক কৃষক ফিরোজ আলী জানান, এবার ফুলকপির যে দাম পাচ্ছি তাতে বীজের টাকাও উঠবে না। এরকম হলে আগামীতে আর ফুলকপি চাষই করবেন না। তার মতে, কৃষক যদি কষ্ট করে তার উৎপাদিত পণ্যে সঠিক দাম না পায়, তাহলে বাঁচবে কি করে।

তবে প্রথম দিকে ফুলকপির দাম কিছুটা হলেও ছিলো বলে আশায় বুক বেঁধেছিলেন, মৌসুমের শুরুর দিকে একটি কপি ১০ টাকা হতে ১৫ টাকাও বিক্রি হয়েছে। এখন সেই কপিই এক টাকা হতে দুই টাকা।

কৃষকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে আমরা যাই শিবপুরের সিঅ্যান্ডবি বাজারে। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই, শীতে জুবুথবু হয়ে অনেক কৃষকই তাদের উৎপাদিত সবজি নিয়ে এসেছেন, একটু ভাল দামের আশায়। তবে তাদের সবার মুখই মলিন হয়ে রয়েছে। বুঝতে বাকী রইলো না, মোমিন, ফিরোজ আলীদের দেওয়া তথ্যের সত্যতা।

সবজির যোগান বেশি হলেও কেনার মতো পাইকার নেই। আর যারা রয়েছে তাদের কাছে অনেকটা বাধ্য হয়ে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

সোলায়মান নামে এক কৃষক জানালেন, প্রতি কানি ফুলকপি ক্ষেত চাষ করতে খরচ পড়ে সব মিলিয়ে ২০ হাজার। কিন্তু দুঃখজনক এবং বেদনাদায়ক হলেও সত্যি, কৃষকরা এর দাম পাচ্ছে মাত্র ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা।  

সারের দাম বেশি হওয়ায় একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ বেড়েছে, তেমনি অবরোধের কারণে ঢাকার বড় পাইকাররা ঠিকমতো না আসাতেই তাদের এ ক্ষতির সম্মুখিন হতে হচ্ছে বলে জানান সোলায়মান।

তিনি বলেন, হরতাল অবরোধ না থাকলে বড় আড়ৎদার আসে, দাম পাই। এবার সব যাবে। ছেলে-মেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকাই দায়।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৬, জানুয়ারি ১১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।