ঢাকা, বুধবার, ২৫ ভাদ্র ১৪৩২, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

অর্থনীতি-ব্যবসা

ব্যবসায়ীরা এতিমের মতো অবস্থায়

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০:৩৬, সেপ্টেম্বর ৯, ২০২৫
ব্যবসায়ীরা এতিমের মতো অবস্থায়

বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বর্তমানে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিকেলস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি আবদুল হক।

তিনি বলেন, রপ্তানি কাঠামোর দুর্বলতা, শুল্ক কোটা বাধা, অবকাঠামো সংকট ও প্রশাসনিক জটিলতায় ব্যবসায়ীরা আজ ‘এতিমের মতো’ অবস্থায় রয়েছেন।

অন্যদিকে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ছদ্মবেশী বেকারত্ব মহামারি পর্যায়ে চলে গেছে। তরুণদের মধ্যে হতাশা এই সংকটের বাস্তব চিত্র তুলে ধরছে। ’

গতকাল সোমবার রাজধানীর  ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম (বিবিএফ) আয়োজন করে ‘বাণিজ্যযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের করণীয় ও এফবিসিসিআইয়ের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনার। সেখানে তাঁরা এসব কথা বলেন। সেমিনারে অংশ নেন অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা ও নীতিনির্ধারকরা। আলোচনায় উঠে আসে একদিকে সম্ভাবনা, অন্যদিকে ভয়াবহ দুর্বলতা ও নীতি ঘাটতির কথা।

আবদুল হক বলেন, দেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৬৫ শতাংশ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। বাজার বৈচিত্র্য না থাকায় চলমান বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধ বাংলাদেশের জন্য বড় ঝুঁকি হয়ে উঠছে। ‘আমরা কার কাছে যাব, কোথায় যাব, কী করব বুঝতে পারছি না। হঠাৎ করে পোর্টচার্জ বাড়ানো হচ্ছে, নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।

তাঁর মতে, নতুন বাজারে প্রবেশের পথে শুল্ক-কোটা সীমাবদ্ধতা, মান নিয়ন্ত্রণের কঠোরতা এবং কার্যকর দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির অভাব বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট, দুর্বল অবকাঠামো এবং নীতিগত অনিশ্চয়তা বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহ করছে। তিনি আরো বলেন, ‘যদি বাজার বৈচিত্র্য ও নীতিগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরো ঝুঁকিতে পড়বে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান সেমিনারে বলেন, ‘বাংলাদেশ এগোচ্ছে, এই বয়ান যথেষ্ট নয়। মূল বিষয় হলো, অর্থনীতিতে ও ব্যবসায় গতি আনা। ’ তাঁর মতে, দুর্নীতির পাশাপাশি হয়রানি এখন রাষ্ট্রীয় ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ সমানভাবে এই হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেমন লড়াই করতে হবে, তেমনি হয়রানির বিরুদ্ধেও একই শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। ’ হোসেন জিল্লুর মনে করেন, বিগত ১৫ বছরে গোষ্ঠীতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদ ব্যাবসায়িক পরিবেশকে অকার্যকর করেছে। অথচ অর্থনীতির চাকা সচল করবে বেসরকারি খাতই। তাই তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি আরো বলেন, ২০০৪ সালে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম একই স্তরে ছিল, আজ ভিয়েতনাম বহুদূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশকে পোশাক খাতের বাইরে কৃষি, ওষুধ, তথ্য-প্রযুক্তি, চামড়া ও অন্যান্য উদীয়মান খাতকে নতুন প্রবৃদ্ধির চালক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।

বৈশ্বিক সুযোগ: চায়না প্লাস ওয়ান কৌশল : পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, চীন থেকে আমেরিকার আমদানি সরে যাচ্ছে, ফলে কম্পানিগুলো বিকল্প বাজার খুঁজছে। নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সেই তালিকায় জায়গা করতে পারে।

তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বৈশ্বিক জরিপে দেখা গেছে, ৩২ শতাংশ ফার্ম এখন ‘চায়না প্লাস ওয়ান’ কৌশল গ্রহণ করছে। অর্থাৎ তাঁরা চীনের পাশাপাশি অন্যত্রও উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলছে। একই সঙ্গে ৭২ শতাংশ গ্লোবাল ফার্ম মনে করছে, নন-অ্যালাই দেশগুলো (যারা খোলাখুলি কোনো রাজনৈতিক শিবিরে নেই) হবে সবচেয়ে নিরাপদ গন্তব্য। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘সুযোগ থাকলেই যে আমরা তা কাজে লাগাতে পারব, তা নয়। ’

বাংলাদেশের প্রধান দুর্বলতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এগুলো হলো—গ্লোবাল কম্পিটিটিভনেস ইনডেক্সে খুব নিচে অবস্থান (১০৫তম); ট্রেড ফ্যাসিলিটেশনে ঘাটতি; শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা; পোশাক খাতে অতিরিক্ত নির্ভরতা; প্রমাণভিত্তিক নীতি বিশ্লেষণের অক্ষমতা। মাসরুর রিয়াজ আরো জানান, চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের অভিঘাতে ২০২৫ সালে বাংলাদেশের বৈশ্বিক বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশ থেকে কমে ২ শতাংশে নামবে, আর ২০২৬ সালে তা হবে ২.৫ শতাংশ ।

ট্রেড সংগঠন ও নীতিগত দুর্বলতা : বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করতে হবে। নইলে তারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান বলেন, দেশে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও মূল্যস্ফীতি বড় চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। শ্রমশক্তি থাকা সত্ত্বেও আনুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান সীমিত এবং দক্ষতার ঘাটতির কারণে প্রবাসী শ্রমিকরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন।

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি শফিউল্লাহ চৌধুরী বলেন, পূর্ববর্তী সরকারের আমলে এফবিসিসিআই কার্যত অকার্যকর ছিল। গণ-অভ্যুত্থানের পর সংগঠনের নেতৃত্বে একজন সাবেক আমলা বসানো হয়েছে, যার ব্যাবসায়িক অভিজ্ঞতা নেই। এতে সংগঠনটি ব্যবসায়ীদের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি বাংলাদেশ: আলোচনায় বক্তারা আরো জানান, বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল কূটনীতি, জলবায়ু কূটনীতি, জ্বালানি নিরাপত্তা—সব কিছুই বৈশ্বিক রাজনীতির কেন্দ্রে চলে এসেছে। নতুন বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশকে যোগ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, তৈরি পোশাক ও রেমিট্যান্স বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ থাকবে, তবে নতুন প্রবৃদ্ধির চালক খুঁজে বের করতে হবে। কৃষি, ওষুধ, তথ্য-প্রযুক্তি, চামড়া, ই-কমার্স ও অন্যান্য উদীয়মান খাতকে অগ্রাধিকার দিলে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে।

সূত্র: কালের কণ্ঠ

এনডি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।