ঢাকা, সোমবার, ১০ আষাঢ় ১৪৩২, ২৩ জুন ২০২৫, ২৬ জিলহজ ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

বিশেষ লেখা

খাদের কিনারে ব্যবসায়ীরা উৎকণ্ঠায় প্রবাসীরা

মোস্তফা কামাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮:৫৩, জুন ২২, ২০২৫
খাদের কিনারে ব্যবসায়ীরা উৎকণ্ঠায় প্রবাসীরা মোস্তফা কামাল

দেশে বড়-মাঝারি-ছোট ব্যবসা-বিনিয়োগের কোনো সূচকেই সুখবর নেই। কোনো কোনো খাতে টিকে থাকার সম্ভাবনাও এরই মধ্যে ‘ক্ষীণ’ হয়ে গেছে।

এই পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা বহুদিন ধরে বহুমুখী সংকটের মধ্যে আছেন। অন্যদের  মতো দল বা জোট বেঁধে রাস্তায় নেমে তাঁদের পক্ষে মিছিল-মিটিং করে কষ্টের কথা জানান দেওয়াও সম্ভব নয়।

শব্দ করে বিলাপ করাও তাঁদের মানায় না। ফলে নিয়তির মতো বোবাকান্না হজম করতে হচ্ছে তাঁদের। আবার এই কষ্টের মাঝেও ব্যবসায়ীদের নিজেদের শক্ত-সামর্থ্যবান দেখাতে হয়।
কঠিন এই বাস্তবতা ও সুদাসলের পাটিগণিতে দেশে ঋণখেলাপি এবং টাকার অঙ্ক অনেক বেড়েছে।

সর্বশেষ এক হিসাবে এর পরিমাণ ৪.২ লাখ কোটি টাকা। ধারণা করা যায়, তা আরো বাড়বে। বর্তমানে ব্যাংকঋণের সুদহার (+/-) ১৫ শতাংশ। একে ধরে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের অঙ্ক নির্ধারণ করা হচ্ছে।

স্বাভাবিকভাবেই এতে সুদাসল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। যথারীতি এভাবে ডিফল্টার (ঋণখেলাপি) চিহ্নিত হচ্ছেন ব্যবসায় বিনিয়োগকারীরা।

৫ আগস্টের পর একদিকে যেমন বেশ কিছু শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, অন্যদিকে সম্ভাবনাময় কিছু মিল-কারখানার উৎপাদন দুমড়েমুচড়ে গেছে। তার ওপর অর্থায়ন সংকট, ঋণ সহায়তা না থাকা, সুদহার বৃদ্ধি মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৫ আগস্টের আগের সংকটের সঙ্গে পরবর্তী সময়ের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির যোগফলে তৈরি হয়েছে স্থবিরতা।

কিন্তু ব্যবসা-বিনিয়োগের এই স্থবিরতা কাটাতে এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো সহায়ক পদক্ষেপ না নেওয়ায় সব শ্রেণির ব্যবসায়ীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। কোনো মতে যাঁরা টিকে আছেন, তাঁদের পক্ষে লোনের টাকা পরিশোধ, কর্মচারীর বেতন, নিয়মিত খরচ টানা কঠিন হয়ে পড়েছে। তার ওপর কমেনি ঘুষ-দুর্নীতি। হিডেন, আনসিন বা আন্ডার টেবিল লেনদেন ঠিকই রাখতে হচ্ছে।

এসব করতে গিয়ে দেশের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর টিকে থাকাই এখন চ্যালেঞ্জ। নতুন করে বিনিয়োগের চিন্তার সুযোগ নেই। ফলে হচ্ছে না নতুন কর্মসংস্থান। বিনিয়োগ হলেই তো সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থান। অন্তরালের এসব কথা প্রকাশ্যে বলা হবে ব্যবসায়ীদের জন্য আপদের ওপর বিপদের। ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে কজন গণমাধ্যমের সঙ্গে সচরাচর কথা বলেন, তারাও সতর্ক। কী বলতে কী বলে ফেলেন এই ভয়ে থাকেন। কথা পছন্দ না হলেই নতুন উত্পীড়ন, মব আতঙ্ক। তার পরও তথ্য আটকে থাকে না। যে পরিবেশ-পরিস্থিতিতে একটা দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে, বিনিয়োগ বাড়ে, কর্মসংস্থান তৈরি হয়, বর্তমানে সেটা যে অনুপস্থিত, তা যে কারোর কাছেই বোধগম্য। কর্মসংস্থান, মূল্যস্ফীতি, প্রবৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সূচকের লাগাম টানতে হলে করণীয় কী, সেটি সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের মানুষেরও জানার বাইরে না। দেশি-বিদেশি ব্যবসা-বিনিয়োগ সবার জন্য একই। দেশি বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন থাকলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও স্বস্তিতে থাকেন না। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, ডলারের উচ্চমূল্য, জ্বালানি খাতে অস্থিতিশীলতা, ঋণের উচ্চ সুদহারের তথ্য বিদেশিদের কাছেও অজানা নয়।

দেশের যে প্রায় ৬০ শতাংশ কারখানা উৎপাদনহীনতায় ভুগছে, প্রয়োজনীয় গ্যাস মিলছে না, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কী হাল, তা বিদেশিদের কাছে দেশের কেউ গিয়ে কানে কানে বলে আসতে হয় না। ব্যবসা-শিল্পবিনিয়োগবিরোধী যেসব কর্মকাণ্ড চলমান রয়েছে তা এক অর্থে ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছে। যে রোগ দেশীয় ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকায়, সেই রোগে কি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের পিঠে মালিশের মতো লাগবে?

বাংলাদেশ নিয়ে যাদের ভাবনা নেই, নেই কমিটমেন্ট, তাদের কথা ভিন্ন। তারা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, দুবাইসহ অনেক দেশে বাড়ি-গাড়ি ও সম্পদ করবেন। প্রয়োজনে পালাবেন। কিন্তু দেশের প্রতি ভালোবাসা-অঙ্গীকারবদ্ধ যাঁরা তাঁদের কী হবে? তাঁরা তো এ দেশেই ব্যবসা-বিনিয়োগ করে নিজেরা সমৃদ্ধ হতে চান। দেশ গঠনে ভূমিকা রাখছেন, আরো রাখতে চান। কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে এ দেশের মানুষকে কর্মমুখী রাখতে চান। তাঁদের জন্য টিকে থাকার চৌহদ্দী ছোট হয়ে আসতে থাকলে দেশ কোন পরিণতির দিকে যাবে? পেশাদার-কমিটেড-বনেদি এই ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ইরান-ইসরাইল সংঘাত। তা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিলে বিশ্ব অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাবের ঢেউ বাংলাদেশে কোন মাত্রায় আছড়ে পড়বে, তা তাঁদের ভাবাচ্ছে। কোনো যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই ভালো নয়। আদতে কোনো যুদ্ধেই অর্থনীতি জেতে না। ইরান-ইসরায়েল সংঘাত শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতি ও জ্বালানি সরবরাহব্যবস্থায় মারাত্মক প্রভাব ফেলবে, যা থেকে মুক্ত থাকবে না বাংলাদেশও।

আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি বড় অংশ গ্যাস ও তেলের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষত এলএনজি ও পরিশোধিত জ্বালানি তেল। বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার ও ওমান থেকে এলএনজি আমদানি করে। এসব দেশের একাধিক কম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি রয়েছে। কাতার থেকে এলএনজি আমদানির একমাত্র পথ হরমুজ প্রণালি। শুধু জ্বালানি নয়, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিঘ্ন ঘটবে। এই প্রণালি বন্ধ না হলেও যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বিশ্ববাণিজ্য ব্যাহত হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি রপ্তানিনির্ভর। তৈরি পোশাক খাত বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস। পণ্য পরিবহনে বিলম্ব হলে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের কাছে পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে। ফলে ক্রয়াদেশ বাতিলের ঝুঁকি, মূল্যছাড় দিতে বাধ্য হওয়া বা বাজার হারানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ আরো বাড়বে, যার প্রভাব সরাসরি পড়বে শিল্প উৎপাদন, পরিবহন, কৃষি ও খুচরা বাজারে। তখন দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। ভোক্তা পর্যায়ে জীবনযাত্রার ব্যয়ও বাড়তে থাকবে।

তার ওপর শ্রমবাজার তছনছ হয়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্য বাংলাদেশিদের জন্য প্রধান শ্রমবাজার। ইরান ও তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোয় যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে ওই অঞ্চলে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে পড়বে। এরই মধ্যে ইরানে হাজার দেড়েক বাংলাদেশি চাকরি খুইয়েছেন। আশপাশের দেশগুলোতে প্রবাসীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। এর আগেও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সময় বাংলাদেশি শ্রমিকরা দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এই যুদ্ধে যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সমর্থনে এগিয়ে আসছে এবং ইরান মুসলিম দেশগুলোর সহায়তা চাইছে, তাতে এটি শিগগির আঞ্চলিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সে ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশেও কাজের সংকট হবে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম প্রধান উৎস রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ে মারাত্মক ছেদ পড়বে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের নির্মাণ খাত, পরিষেবা খাত ও আবাসন খাত স্থবির হয়ে যেতে পারে। ঘটনাচক্রে ক্রমে তা সংক্রমিত হতে পারে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও।
স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশ থেকে শ্রমিকরা মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের জন্য যেতে শুরু করেন। তখন থেকে প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো আরম্ভ করেন। এই প্রবাসী আয় অর্থনীতির একটি প্রধান খাত হিসেবে জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই প্রবাসী শ্রমিকদের সঠিক সংখ্যা বের করা কঠিন। তবে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে সংখ্যাটি দুই কোটির কাছাকাছি। পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ বছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ প্রায় ১৭ হাজার ৭৫৯ কোটি ডলার।

একদিকে দেশের অর্থনীতি গড়ার সিপাহশালার ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা যন্ত্রণাকাতর। অন্যদিকে এই অর্থনীতির শিরায় রক্তসঞ্চালনকারী প্রবাসীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সামগ্রিকভাবে ভীষণ ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রেমিট্যান্স যোদ্ধারা মাঝেমধ্যে সম্মানের জন্য কান্নাকাটি করেন। কিছুদিন ধরে তাঁরা এ দাবিতে বেশ সোচ্চার। হুমকি-ধমকিও দিচ্ছেন। কিন্তু ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে হুমকি-ধমকি বেমানান। যদিও এফবিসিসিআইসহ ব্যবসায়ীদের বেশ কটি সংগঠন রয়েছে। খাতওয়ারি সংগঠনও আছে। ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে তাঁরা তাঁদের অসম্মান-কষ্ট-অস্বস্তির কথা জানাচ্ছেন। গতিপ্রকৃতিসহ অর্থনীতির হালদশা জানাচ্ছেন। দেশকে সমৃদ্ধিশালী করতে নিজেদের সক্ষমতা জানানোর পাশাপাশি পরামর্শও দিচ্ছেন। এসব শোনার ও পদক্ষেপ নেওয়ার পুরো দায়িত্ব সরকারের।
 
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
সৌজন্যে কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।