ঢাকা, মঙ্গলবার, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২০ মে ২০২৫, ২২ জিলকদ ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

বেক্সিমকো মডেলে ব্যাংক লুটে নাবিল গ্রুপ

মো. জয়নাল আবেদীন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:৪৪, মে ২০, ২০২৫
বেক্সিমকো মডেলে ব্যাংক লুটে নাবিল গ্রুপ

নতুন ঋণের টাকায় পুরনো ঋণের কিস্তি শোধ করা ছিল ‘দরবেশ’ খ্যাত সালমান এফ রহমানের প্রিয় কাজ। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে কইয়ের তেলে কই ভাজতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

এখন সেই ‘দরবেশ বাবা’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন রাজশাহীভিত্তিক নাবিল গ্রুপের এমডি আমিনুল ইসলাম স্বপন। বড় কোনো উৎপাদনমুখী শিল্প না থাকা কিংবা ঋণ নেওয়ার জন্য জামানত হিসেবে পর্যাপ্ত সম্পদ না থাকলেও দেদার ঋণ পাচ্ছেন তিনি।

এই প্রক্রিয়ায় ইসলামী ব্যাংক থেকে আরো ৮০০ কোটি টাকার নতুন ঋণ নিয়ে পুরনো ঋণের কিস্তি পরিশোধের অভিযোগ পাওয়া গেছে গ্রুপটির বিরুদ্ধে।

তথ্য-উপাত্ত বলছে, অভিনব কায়দায় জালিয়াতির মাধ্যমে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে নাবিল গ্রুপ। এর বেশির ভাগই বেনামি। আরো চার হাজার কোটি টাকা ঋণের মধ্যেও আছে নানা ধরনের অনিয়ম।  

এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জামানত জালিয়াতি। সাধারণত জামানত বন্ধকের পর ঋণ দেওয়া হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আগে ঋণ দেওয়া হয়েছে, পরে নেওয়া হয় জামানত। ঋণের টাকায় খোলা এফডিআর ওই ঋণের জামানত হিসেবেই বন্ধক রাখা হয়েছে।

ঋণখেলাপি হলে এফডিআর ভেঙে ডাউন পেমেন্টের মাধ্যমে নবায়ন করা হয়েছে—এমন অবিশ্বাস্য জালিয়াতি করেছে নাবিল গ্রুপ। এতে সহায়তা করেছেন ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ঋণের বিপরীতে জামানতের মূল্য খুবই কম। ঋণ জালিয়াতির টাকায় গ্রুপটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেআইনিভাবে এক হাজার একর জমি কিনেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী ঋণের টাকায় জমি কেনা নিষিদ্ধ।

অভিযোগ আছে, তিনটি ব্যাংক থেকে নেওয়া এসব ঋণের টাকা কয়েক হাত ঘুরে এস আলমের হিসাবে গেছে, যা পরে বিভিন্নভাবে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘নামে-বেনামে যে ঋণগুলো নেওয়া হয়েছে তারা সব শক্তিশালী ব্যক্তি ছিল। কাজের বুয়া, অফিসের কর্মচারী, ড্রাইভারের নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেছে ওই শক্তিধর ব্যক্তিরা। যেহেতু কর্মচারীদের ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা ছিল না, সুতরাং এই ঋণ জালিয়াতির জন্য শক্তিশালী ব্যক্তিরাই দায়ী। তাদের ইশারা ছাড়া এই ঋণগুলো পেত না। এখন ড্রাইভার বা কাজের লোক নয়, ওই শক্তিধর ব্যক্তির কাছ থেকেই ঋণগুলো আদায় করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকও তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেনি। সুতরাং তদন্তের ভিত্তিতে চক্রের সবাইকে দায় গ্রহণ করতে হবে। তাদের কাছ থেকেই এসব অর্থ আদায় করতে হবে। ’

নাবিল গ্রুপের নানা ধরনের জালিয়াতির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও সিআইডি তদন্ত করছে।

গত ২৪ মার্চ নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম, তাঁর স্ত্রী ইসরাত জাহান এবং তাঁদের চার প্রতিষ্ঠানের ১৭৮ বিঘা জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। এসব সম্পদ রাজশাহীর পবা উপজেলার তেকাটাপাড়ায় রয়েছে।

দুদকের আবেদন সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ থাকায় তাঁদের সম্পদগুলো জব্দের আবেদন করে দুদক। পরে বিচারক সেটি মঞ্জুর করেন।

সম্পদগুলোর মধ্যে রয়েছে আমিনুল ইসলামের নামে ১৩২ বিঘা জমি, তাঁর স্ত্রী ইসরাত জাহানের নামে ২৩ বিঘা জমি, নাবিল ফার্মা লিমিটেডের নামে ১৩ বিঘা জমি, আনোয়ার ফিড মিলস লিমিটেডের নামে প্রায় এক বিঘা জমি, নাবিল গ্রেট হোমস লিমিটেডের নামে প্রায় ৯ বিঘা জমি এবং নাবিল নাবা ফুডসের নামে ৮ শতক জমি রয়েছে।

নাবিল গ্রুপের ১৪ কর্মী ও সুবিধাভোগীর নামে খোলা ৯টি কম্পানিকে ৯ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। এই ১৪ জনের সবাই নাবিল গ্রুপ থেকে প্রতি মাসে বেতন ও সম্মানী পান। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা নিশ্চিত হয়েছেন, এই বেনামি ঋণের সুবিধাভোগী মূলত নাবিল গ্রুপ। এর মধ্যে নাবিল গ্রেইন ক্রপস নামের একটি কম্পানির মালিক গ্রুপটির কর্মী শাকিল হোসেন ও রায়হানুল ইসলাম। নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও এ কম্পানিতে আছেন। কম্পানির নামের সঙ্গে নাবিল শব্দটি থাকলেও গ্রুপের ওয়েবসাইটে কম্পানিটির নাম রাখা হয়নি। এই কম্পানিকে এক হাজার ৭৭ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক।

রাজশাহীভিত্তিক দেশের অন্যতম ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নাবিল গ্রুপ। ইসলামী ব্যাংকে প্রতিষ্ঠানটির নামে-বেনামে মোট ঋণের পরিমাণ ১৩ হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। এই ঋণের প্রায় পুরোটা দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, বিশেষত ২০২২ সালে। এসব ঋণ ফেরত আসছে না; আবার নানা কৌশলের কারণে খেলাপিও হচ্ছে না।

নাবিল গ্রুপের কর্ণধার আমিনুল ইসলাম স্বপন। বর্তমান সরকারের সময়ে গ্রুপটি দেশের চতুর্থ বৃহত্তম ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ২০২২ ও ২০২৩ সালে ভোগ্যপণ্য আমদানিতে এর অবস্থান ছিল পঞ্চম।

সন্দেহজনক লেনদেনের কারণে গত সেপ্টেম্বরে নাবিল গ্রুপের এমডি আমিনুল ইসলাম, স্ত্রী মোছা. ইসরাত জাহান, পিতা নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যান জাহান বক্স মণ্ডল, মা ও গ্রুপের পরিচালক আনোয়ারা বেগম, দুই সন্তান এজাজ আবরার ও আফরা ইবনাথের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

ইসলামী ব্যাংক সূত্র জানায়, নাবিল গ্রুপের এসব প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেকের বর্তমান ঋণ স্থিতি অনুমোদিত সীমার ওপরে চলে গেছে। ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখায় এসব কম্পানির ঋণসীমা আট হাজার ১১২ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ২০ মার্চ পর্যন্ত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা।

ব্যাংক কম্পানি আইন অনুযায়ী, একটি ব্যাংক তার মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ একক ব্যক্তি বা গ্রুপকে ঋণ দিতে পারে। এর মধ্যে ফান্ডেড তথা সরাসরি ঋণ দেওয়া যায় ১৫ শতাংশ। ইসলামী ব্যাংক এখন মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। এর আগে ব্যাংকটির ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি মূলধন ছিল। ওই সময় একক গ্রাহককে সর্বোচ্চ আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সুযোগ ছিল। নাবিল গ্রুপকে নামে-বেনামে এর পাঁচ গুণের বেশি ঋণ দেওয়া হয়।

সূত্র জানায়, ব্যাংকটির ভেতরে নানা পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা রয়েছে। অথচ নাবিলের ঋণ আদায়ে কোনো উদ্যোগ নেই। গত ৫ আগস্টের পর নাবিল গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকে ৩০০ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। এই অর্থ দেওয়া হয়েছে সমপরিমাণ অর্থের এলসি খোলার শর্তে। এর বাইরে কোনো অর্থ জমা দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও ঋণ উদ্ধারে কোনো পদক্ষেপের কথা শোনা যায়নি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘যে কয়েকটি ব্যাংক থেকে ফরেনসিক অডিট করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সে তালিকায় রয়েছে ইসলামী ব্যাংক। সেখানে যার যত ধরনের অনিয়ম হয়েছে, গুরুত্ব বিবেচনায় প্রতি ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যে ঋণের শ্রেণিমান যা, অবশ্যই তা দেখাতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যাংক ছাড় পাবে না। ’

নাবিল গ্রুপ মূলত উত্তরাঞ্চলে ভোগ্যপণ্য সরবরাহের জন্য পরিচিত ছিল। বেশ আগে থেকে গ্রুপটি ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহক হলেও হঠাৎ করে ঋণ বেড়েছে ২০২২ সালের মার্চের পর। ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখায় নাবিল গ্রুপের নামে বর্তমানে ঋণ রয়েছে দুই হাজার ৪৬৩ কোটি টাকা। আর নাবিল গ্রুপের চেয়ারম্যান জাহান বক্সের নামে নিবন্ধিত এ জে ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ঋণ আছে এক হাজার ৬১৭ কোটি টাকা। ঋণটি বর্তমানে সাবস্ট্যান্ডার্ড ও সন্দেহজনক মানে শ্রেণীকৃত হয়ে আছে। নাবিল পরিবারের সদস্যদের নামে এখন ঋণ রয়েছে চার হাজার ৮০ কোটি টাকা।

২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখায় নাবিল গ্রুপের মোট ঋণ ছিল দুই হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ওই বছর শেষে এসে ইসলামী ব্যাংকের ঢাকা ও রাজশাহীর ছয়টি শাখায় বেনামিসহ ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা।

নাবিল গ্রুপের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাদের গ্রুপভুক্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১৫টি। নাবিল ট্রেডিং, এনজিআই ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, নাবিল ফিড মিলস, শিপুল এন্টারপ্রাইজ, আইএনএনএ অ্যাগ্রোটেক, নাবা ক্রপ কেয়ার, নাবিল অটো ফ্লাওয়ার মিলস, নাবিল অটো রাইস মিলস, নাবিল ডাল মিলস, নাবিল এডিবল অয়েল, ফুডেলা ব্র্যান্ডের ভোগ্যগণ্য, নাবিল ট্রান্সপোর্ট, নাবিল কোল্ড স্টোরেজ, রেজা কোল্ড স্টোরেজ ও অনুরা-জাহান বক্স ফাউন্ডেশন।

নাবিল গ্রেইন ক্রপসসহ কর্মচারীদের নামে খোলা কম্পানিগুলোর নাম এই ওয়েবসাইটে নেই। এ কারণে এ কম্পানিগুলোর নামে নেওয়া ৯ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকার ঋণকে বেনামি বলছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা।

ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক বলেন, ‘নাবিল গ্রুপের কর্মচারীদের নামে ঋণ নেওয়ার অভিযোগ এসেছে। তাদের নামে নেওয়া ঋণ সিঙ্গল বোরোয়া এক্সপোজার লিমিট অতিক্রম করেছে। এখন আমরা তদন্ত করে দেখব টাকাগুলোর আলটিমেট বেনিফিশিয়ারি কে। এর মাধ্যমে পরবর্তী পদক্ষেপ বা মামলা করা হবে। ’ নাবিল গ্রুপের ১৪ কর্মী ও সুবিধাভোগীর নামে খোলা ৯টি কম্পানিকে ৯ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক—এই তদন্ত রিপোর্ট সম্পন্ন হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তদন্ত অলমোস্ট শেষের পথে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে পেয়ে যাব। ’

সার্বিক বিষয়ে জানার জন্য নাবিল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিনুল ইসলাম স্বপনের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে মেসেজ করলে কোনো উত্তর দেননি তিনি।

সূত্র: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।