ঢাকা, রবিবার, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

দিল্লি, কলকাতা, আগরতলা

বিচারপতি যেন ফিনিক্স পাখি, ৩৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিলের পথে

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২০১ ঘণ্টা, মে ১২, ২০২৩
বিচারপতি যেন ফিনিক্স পাখি, ৩৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিলের পথে

কলকাতা: এভাবেও যেন ফিরে আসা যায়। এ যেন সেই পৌরাণিক গল্পের ফিনিক্স পাখি, যে পাখি আগুনে ঝাঁপ দিয়েও ফিরে আসে।

সেভাবেই যেন চাকরিপ্রত্যাশীদের ত্রাতা হয়ে ফিরে এলেন হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।  

বেশিদিনে গল্প নয়, গত ২৮ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির আর কোনো মামলা শুনতে পারবেন না বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়।  

যদিও পরে জানা গিয়েছিল, তার এজলাস থেকে দুটি নিয়োগ মামলা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই দুটি, যে দুটিতে কান টানলে অনেকটা মাথা চলে আসছিল। অর্থাৎ মমতার ভাতিজা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সিবিআই বা ইডির তদন্ত সংক্রান্ত কোনো মামলা হলে, সেগুলোও শুনতে পারবেন না বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।

দেশের শীর্ষ আদালতের সেই সেই নির্দেশ সেদিন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল তাকে। হাইকোর্ট থেকে অনেক রাতে বাড়ি পৌঁছানোর সময় সাংবাদিকদের উদ্দেশে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘আজ আমার মৃত্যুদিন’। ২৮ এপ্রিল এই তিন শব্দই জানান দিচ্ছিল তার মানসিক অবস্থা কী ছিল। সুপ্রিম কোর্ট তার বিরুদ্ধে নির্দেশ দেওয়ার দিনই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, যে কাজটা করতে ৬০ বছর সময় লেগে যেত, তা ছয় মাসের মধ্যে করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের রায়ে নিরাশ, নিস্তব্ধ হয়ে পড়েন চাকরিপ্রত্যাশীরা।

তবে বেশিদিন লাগলো না। দু’সপ্তাহর মাথায় বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় যেন সেই পুরনো অবতারে ফিরে এলেন। শুক্রবার (১২ মে) বিচারপতি ফের প্রমাণ করে দিলেন এভাবেও ফিরে আসা যায়। এদিন পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ মামলায় বিচারপতির নির্দেশ, ২০১৪ সালে টেট পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পাওয়াদের মধ্যে যারা প্রশিক্ষিত নন, এমন ৩৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিল করতে হবে। অর্থাৎ একসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে ৩৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি যেতে চলেছে। অবশ্য তাদের সাময়িক স্বস্তি দিয়ে বিচারপতি বলেছেন, তারা আপাতত চার মাস চাকরি করতে পারবেন। তবে বেতন পাবেন পার্শ্ব শিক্ষকের অর্থাৎ প্যারা টিচার হিসেবে।

এক ধাক্কায় ৩৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিল করে দেওয়া ভারতের নিরিখে অতি বড় নির্দেশ। এর অভিঘাত শুধু শিক্ষা ব্যবস্থাতেই পড়বে না। বাংলার বর্তমান রাজনীতি, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থায় এর বড় অভিঘাত পড়তে চলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এর আগে ত্রিপুরায় ২০১৪ সালে হাইকোর্টের রায়ে চাকরি গিয়েছিল প্রায় ১০ হাজার শিক্ষকের।

হাইকোর্টের আইনজীবী সায়ন ব্যানার্জী, যিনি চাকরিপ্রত্যাশীদের হয়ে আদালতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তার অভিমত, ২০১৪-এর প্যানেলের ৩৬ হাজারের চাকরি বাতিল করলো কলকাতা হাইকোর্ট। আমি বিশ্বাস করি, এই ৩৬ হাজার জনের মধ্যে অনেক যোগ্য চাকরিপ্রার্থী আছেন। যারা নিজের যোগ্যতাতেই এ চাকরিটা পেয়েছেন। কিন্তু, আজ এই অপদার্থ, দুর্নীতিবাজ রাজ্য সরকারের জন্য তারাও অযোগ্যদের ভিড়ে মিশে গেছেন। দুর্ভাগ্য আমাদের, যারা যোগ্য তারাও বঞ্চিত হচ্ছেন অযোগ্যদের জন্যে। আমাদের লড়াই অযোগ্যদের বিরুদ্ধে, যোগ্যদের পক্ষে। ন্যূনতম লজ্জাবোধ থাকলে, এই মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত। সরকারের দুর্নীতির খেসারত দিতে হচ্ছে কিছু যোগ্য শিক্ষকদের। এই মামলার অন্যতম আইনজীবী তথা বিজেপি নেতা তরুণজ্যোতি তিওয়ারি বলেছেন, প্রাথমিকের নিয়োগে কী বিপুল পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছিল, হাইকোর্টের রায়ই তার প্রমাণ।

৩৬ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি বাতিল নিয়ে রাজ্যের তৃণমূল সরকারের তীব্র সমালোচনা শুরু করেছে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। সিপিআইএম নেতা সুজন চক্রবর্তী এই চাকরি বাতিলের নেপথ্যে টাকার খেলাকে দায়ী করেছেন। তার কথায়, এতগুলো ছেলেপুলের চাকরি গেল, সত্যিই খারাপ লাগছে। কিন্তু, এই খারাপ লাগার দায় রাজ্য সরকারের।

চাকরিহারাদের জন্য সিপিএম নেতার পরামর্শ, যারা টাকার বিনিময়ে চাকরি দিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে গলায় গামছা দিয়ে টাকা আদায় করুন। একই সঙ্গে রাজ্যের শাসকদলকে কটাক্ষ করে তিনি বলেছেন, শাসকদলের নেতারা প্রস্তুত থাকুন। আপনাদের কাছ থেকে সবাই এবার টাকা চাইবে।

এ প্রসঙ্গে কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী রাজ্য সরকারের সমালোচনা করে বলেছেন, রাজ্যে যেন দুর্নীতির ভূমিকম্প হচ্ছে। দুর্নীতিতে পশ্চিমবঙ্গ গিনেস বুকে নাম তুলবে। হাইকোর্টের নির্দেশে রাজ্যে বিপুল সংখ্যক চাকরি বাতিল নিয়ে তৃণমূল সরকারকে কটাক্ষ করেছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপিও। বিজেপি মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, স্বাধীনতার পর ভারতের ইতিহাসে এত বড় দুর্নীতি কোথাও হয়নি। এরপর তৃণমূলের সরকার চালানোর অধিকার নেই। আমরা বারবার চাকরি বিক্রির অভিযোগ করেছিলাম। আজ আদালতের রায় বুঝিয়ে দিল, আমাদের অভিযোগ ঠিক ছিল। আজকের দিনটা বাংলার জন্য লজ্জার।

তবে বিচারপতির এদিনের রায়ের পর ইতিমধ্যে সোশাল মিডিয়ায় জয়ধ্বনি শুরু হয়ে গিয়েছে। শুরু হয়ে গিয়েছে যেনো বীরপূজা। কেউ কেউ তাকে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেছেন।

বাংলাদেশ সময়: ২১৫৯ ঘণ্টা, মে ১২, ২০২৩
ভিএস/আরএইচ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।