লর্ডসের সবুজ গালিচায় কাইল ভেরেইন মিচেল স্টার্কের ফুলটস বল ঠেলে দিলেন সিঙ্গেল নেওয়ার উদ্দেশ্যে। এবং সেই এক রানেই উল্লাসে ফেটে পড়ল পুরো দক্ষিণ আফ্রিকা।
দক্ষিণ আফ্রিকার এই ফাইনালে ওঠা নিয়েই ছিল নানা সংশয়, সমালোচনা। গত দুই বছরের চক্রে তারা খেলেইনি অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। নিজেদের মাঠে ভারতের সঙ্গে ১-১ এ ড্র করেছিল ঠিকই, কিন্তু কেপটাউনের ভয়ানক উইকেটে মাত্র দুই দিনে হেরে গিয়েছিল এক ম্যাচে। অনেকেই মনে করছিলেন, তারা ‘সিস্টেম প্লে’ করে ফাইনালে উঠেছে—ছোট ছোট দুই ম্যাচের সিরিজ খেলে পয়েন্ট জোগাড় করে।
কিন্তু এই দলের ধারাবাহিকতা আর লড়াকু মনোভাবকে অস্বীকার করা যায় না। ফাইনালের আগে টানা সাতটি টেস্ট জিতেছিল তারা। আর এই সাফল্যের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন যে মানুষটি, তার নাম টেম্বা বাভুমা—একজন আত্মপ্রত্যয়ী, নির্লিপ্ত অথচ নেতৃত্বগুণে অনন্য অধিনায়ক, যিনি প্রমাণ করেছেন ‘মানসিক শক্তিই আসল শক্তি’।
এই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ চক্রে আট ম্যাচে বাভুমার ব্যাট থেকে এসেছে ৭১১ রান, গড় ৫৩.১৩, সঙ্গে দুইটি শতক। কিন্তু সব কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে ছিল লর্ডসের ফাইনালে খেলা তার এক পায়ে দাঁড়িয়ে লেখা ৬৬ রানের মহাকাব্য। ম্যাচের শুরুতেই হ্যামস্ট্রিং চোটে পড়েছিলেন তিনি। তখন স্কোর ছিল মাত্র ৬। চাইলে অবসর নিতে পারতেন, কেউ দোষ দিত না। কিন্তু না—তিনি টিকে রইলেন, ব্যথা সহ্য করলেন, একের পর এক রান করলেন আর গড়লেন ১৪৭ রানের জুটি আইডেন মারক্রামের সঙ্গে। সেই জুটিই এনে দিল জয়, আর সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের অন্যতম বড় মুহূর্ত।
টেম্বা বাভুমা প্রথমে আলোচনায় এসেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার ‘অ্যাফারমেটিভ অ্যাকশন’ নীতির ফল হিসেবে। দেশের ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান ব্যাটার হিসেবে টেস্ট দলে জায়গা পেয়েছিলেন। অনেকেই তাকে ‘নীতিগত সুযোগপ্রাপ্ত’ বলে দেগে দিয়েছিলেন। কিন্তু বাভুমা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার, যিনি দেশের মাটিতে টেস্ট সেঞ্চুরি করেছেন। যে তিন দক্ষিণ আফ্রিকান একদিনের আন্তর্জাতিকের অভিষেকে সেঞ্চুরি করেছেন, বাভুমা তাদের একজন। তিনিই প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার, যিনি দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ক হয়েছেন। আজ তার নেতৃত্বের সামনে ক্রিকেটবিশ্ব নীরব শ্রদ্ধা জানাতে বাধ্য।
অবশ্য ফাইনালের নায়ক শুধু বাভুমা নন। এইডেন মারক্রাম খেলেছেন ১৩৬ রানের এক অনবদ্য ইনিংস। আর কোকেনের জন্য নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরা কাগিসো রাবাদা ছিলেন বল হাতে বিধ্বংসী—৯ উইকেট তুলে নিয়েছেন ম্যাচে। তবুও, সব কিছুর শীর্ষে রয়েছেন বাভুমা, যিনি ব্যথা সহ্য করে নিজের দলকে জয়ের চূড়ায় তুলে এনেছেন, তার শরীর সীমাবদ্ধ হলেও মন ছিল অটুট।
দক্ষিণ আফ্রিকা সর্বশেষ কোনো আইসিসি শিরোপা জিতেছিল ১৯৯৮ সালে, হ্যান্সি ক্রনিয়ের নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি (তৎকালীন ‘নকআউট ট্রফি’)। তারপর ছিল শুধুই ব্যর্থতার মিছিল—১২টি সেমিফাইনাল, ২টি কোয়ার্টারফাইনাল এবং ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের কাছে হার। বারবার ভেঙেছে স্বপ্ন।
ঠিক সেই জায়গা থেকে উঠে এসে এখন টেস্ট ক্রিকেটের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন তারা। ক্রিকেট দেশটিতে প্রথম সারির খেলা নয়, কিন্তু এই দল দেখিয়ে দিয়েছে—মন, সাহস আর নেতৃত্ব থাকলে সব সম্ভব। আর এই পরিবর্তনের চালিকাশক্তি টেম্বা বাভুমা, যিনি আজ দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট ইতিহাসে অবিস্মরণীয় এক অধ্যায় হয়ে উঠেছেন।
তাকে আর শুধু প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান ব্যাটার হিসেবে মনে রাখা হবে না। এখন তিনি সেই অধিনায়ক, যিনি গড়েছেন ইতিহাস। লর্ডসের গ্যালারিতে যখন সাবেক অধিনায়ক পোলক, স্মিথ, ডি ভিলিয়ার্সদের চোখে জল, তখন বোঝা যাচ্ছিল—এই জয় কতটা গভীর, কতটা মূল্যবান।
এমএইচএম