ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জলবায়ু ও পরিবেশ

বিশ্ব পানিদিবস: পানির দুঃখ বারো মাস

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২৩
বিশ্ব পানিদিবস: পানির দুঃখ বারো মাস

পাথরঘাটা (বরগুনা): পড়ন্ত বিকেল, রাস্তার পাশে লম্বা লাইন। যাদের বেশিরভাগই নারী।

তাদের পাশেই লাইন ধরে রাখা সিলভারের খালি কলসি, পাতিল, প্লাস্টিকের ড্রাম।

হঠাৎ দেখলে মনে হবে ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এটা হলো পানির দেশের মানুষের পানির জন্য দীর্ঘ লাইন, পানির জন্য যুদ্ধ; এখানকার বাসিন্দাদের মতে পানির দুঃখ বারো মাস...।

সূর্য ওঠার আগে আর সূর্য ডোবার আগ মুহূর্তে প্রান্তিক জনপদের নারীরা সারিবদ্ধভাবে পুকুর ও বিলের ডোবা থেকে পানি আনেন। কখনো কখনো এক কলসি পানির জন্যও দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়। উপকূলীয় উপজেলা পাথরঘাটার বিভিন্ন গ্রামের চিত্র এটি।  

বছরের পর বছর ধরে এভাবেই চলছে এখানকার বাসিন্দাদের পানির কষ্ট।

গ্রামগুলোতে গেলে দেখা যায়, এসব অঞ্চলের মানুষের পানির জন্য হাহাকারের চিত্র। এক কলসি পানি সংগ্রহের জন্য নারী-পুরুষ আর শিশুদের ছুটতে হয় সেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। অনেক সময় পানির অভাব পূরণ করতে না পারায় দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়। প্রতি বছরই বিভিন্ন এলাকায় মিঠা পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সুপেয় পানির অভাব দিন দিন বাড়ছে।  

শুকনো পুরো মৌসুমে পানির সংকট তীব্র থাকে। বিশেষ করে পাথরঘাটায় গভীর নলকূপ না থাকায় এখানকার মানুষের দুঃখের শেষ নেই।  

স্থানীয় সচেতন ব্যক্তিদের মতে, পানির ঘাটতি পূরণে বিকল্প ব্যবস্থা করা উচিত। এরই মধ্যে সরকারি এবং বেসরকারিভাবে বিকল্প উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে পাথরঘাটায়। সরকারের অর্থায়নে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পানির ট্যাংক দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের পাশাপাশি ২০২২ সাল থেকে বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশনের (বন্ধু) সুপেয় পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় ‘সৌর বিদুৎ পানির প্লান্ট’র মাধ্যমে সুপেয় পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। সিসিডিবি পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের তিনটি গ্রামের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ৬০০ পানির ট্যাংক ও পাঁচটি পিএসএফ ফিল্টার নির্মাণ করে।  

কথা হয় চরদুয়ানী ইউনিয়নের ছহেরাবাদ গ্রামের আবদুল করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, মোগো পানির অভাবে জন্মের পর থেইকাই দেখতাছি। ঘোলা পানি, পচা পানি খাওয়া মোগো অভ্যাস হইয়া গ্যাছে। মোরা ডেইলি কাজ কইরা খাই। এক কলসি পানি আনতেই যদি চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা যায়, তাইলে মোগো সংসার ক্যামনে চলবে।  

একই গ্রামের আলেয়া বেগম শিশুপুত্র নিয়ে পানির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বলেন, চরদুয়ানীর ছহেরাবাদের একটি পুকুর থেকে সৌর বিদ্যুৎ পানির প্লান্ট থেকে ওয়াপদার পাশে একটি ট্যাব থেকে পানি আনতে হয়। প্লাস্টিকের এক ড্রাম পানি নিতে আইয়া লাইনে দাঁড়াইতে হয়। পানির ড্রাম নিতেও অনেক কষ্ট হয়। কষ্ট তো সহ্য করা যায়, পানির অভাব তো আর সহ্য করা যায় না।

এদিকে চরলাঠিমারা গ্রামের আব্দুস ছাত্তার খান বলেন, প্রতিদিন চার কিলোমিটার দূর থেকে পানি আনতে হয়। কখনো কলসিতে করে আবার কখনো কনটেইনারে করে। বৃষ্টির মৌসুমে বৃষ্টির পানিই ভরসা আর শুকনো মৌসুমে প্রতিনিয়তই এ রকমের কষ্ট করতে হয়।
 
বাদুরতলার সাবেক ইউপি সদস্য সোহরাব হোসেন বলেন, চারদিকেই পানি, কিন্তু খাবার পানি নেই। সুপেয় পানির অভাব। প্যাডেল ভ্যান, রিকশা আর বাইসাইকেলে করে মিঠা পানি আনতে হয় দূর থেকে। তিন কিলোমিটার দূরে চরলাঠিমারা গ্রামের খাস পুকুর থেকে পানি আনতে হয়। আবার চৈত্রের খড়ায় পুকুরগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় অবস্থা আরও দুর্বিসহ হয়।  

রুহিতা গ্রামের লাইলী বেগম বলেন, মোগো প্রতিদিন অনেক দূর থেকে পানি আনতে হয়। রান্না, খাবারের কাজে ব্যবহার করি। অনেক কষ্ট হয় আনতে।

উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, এ উপজেলায় ৪২টি মিঠা পানির পুকুর পুনরায় খনন করা হয়েছে। উপজেলায় সুপেয় পানির জন্য পন্ড স্যান্ড ফিল্টার (পিএসএফ) রয়েছে ১৭০টি। সবকটিই সচল রয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি ফিল্টার সোলারের মাধ্যমে চলে। এছাড়া পাথরঘাটায় রিভার্স অসমোসিস (আরও) প্রকল্পের আওতায় অত্যাধুনিক ওয়াটার টিটমেন্ট প্লান্ট রয়েছে সাতটি।  

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মেহেদী বলেন, এ উপজেলায় মাটির নিচে পাথরের মতো পাওয়া যায়, ফলে গভীর নলকূপ বসানো যায় না। এজন্য পানির সংকট থাকে। বিশেষ করে চৈত্রের খড়ায় আরও তীব্র হয়। মিঠা পানির পুকুরগুলো পুনরায় খনন এবং সোলারের মাধ্যমে ফিল্টারগুলো সচল রাখায় অভাব অনেকাংশে পূরণ হচ্ছে।  

বাংলাদেশ বন্ধু ফাউন্ডেশনের (বন্ধু) পাথরঘাটা উপজেলা প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার মো. শামীম বলেন, প্রথমে জিআইজেটের মাধ্যমে ২০১২ সালে এ কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২২ সাল থেকে বন্ধু ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পাথরঘাটা উপজেলায় ১০টি সৌর বিদুৎ সোলার প্লান্ট বসানো হয়েছে। যার মাধ্যমে জনপ্রতি পাঁচ লিটার এবং দৈনিক ৫০ হাজার লিটারের বেশি পানি বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে পুকুর থেকে পানি তুলে তা চার ধাপে পরিষ্কার করে সাধারণের মধ্যে বিতরণ করা হয়।

সিডিবির পাথরঘাটা উপজেলা ব্যবস্থাপক সুব্রত কুমার মিস্ত্রী বলেন, পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের তিনটি গ্রামের বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য ৬০০ পানির ট্যাংক ও পাঁচটি পিএসএফ ফিল্টার নির্মাণ করা হয়েছে। আশা করছি, অন্তত এ ৬০০ পরিবার পানির সংকটে পড়বে না।

পাথরঘাটা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তফা গোলাম কবির বলেন, জনস্বাস্থ্যের মাধ্যমে পানি সংরক্ষণের জন্য প্রতি বছরই কমবেশি ট্যাংক দেওয়া হচ্ছে। এ বছর তিন হাজার লিটারের ১৫ হাজার ৫০০টি ট্যাংক বরাদ্দ হয়েছে। তাতে অনেকাংশে পানির ঘাটতি পূরণ হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৩৯ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২৩
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।