ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ব্যাংকিং

সাউথ-বাংলা ব্যাংকের অতিরিক্ত ঋণ সুবিধা পেল ৭ প্রতিষ্ঠান

শাহেদ ইরশাদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৮
সাউথ-বাংলা ব্যাংকের অতিরিক্ত ঋণ সুবিধা পেল ৭ প্রতিষ্ঠান

ঢাকা: পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে সাতটি প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে ঋণ সীমা অতিক্রম করে অর্থ ছাড় করেছে সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের প্রিন্সিপাল শাখা। 

ঋণের পুরো অর্থ আদায় না হওয়ায় এসব এখন মন্দমানে শ্রেণীকরণ যোগ্য বলে মতামত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বা দায়ী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে। সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক লিমিটেড সবশেষ লাইসেন্স পাওয়া তিনটি ব্যাংকের মধ্যে একটি।  

২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল  অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গর্ভনর ড. আতিউর রহমান ও প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আর্ন্তজাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ব্যাংকটির কার্যক্রম উদ্ধোধন করেন।  

এরপর কয়েকবছর মোটামুটি ভালো চললেও সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের কার্যক্রম নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।  

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখা থেকে সজল জুট ট্রেডিংয়ের অনুকূলে ১০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করা হলেও ৪ কোটি টাকা অতিরিক্ত বিতরণ করা হয়েছে। অতিরিক্ত অর্থ উত্তোলনের পরও ঋণ হিসাবটি নবায়ন করা হয়েছে।  

এছাড়া সজল জুট ট্রেডিংয়ের মালিক এস্কান্দার আলী খলিফার স্ত্রীর মালিকানাধীন সেতু জুট ট্রেডিংয়ের অনুকূলে ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে তা সজল জুট ট্রেডিংয়ের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। সেতু জুট ট্রেডিংয়ের নামে ঋণ নিয়ে সজল জুট ট্রেডিংয়ের ঋণ নবায়ন করা হয়েছে।  

স্ত্রীর নামের প্রতিষ্ঠানে ঋণ নিয়ে স্বামীর প্রতিষ্ঠানের ঋণ নবায়ন করায় এই ঋণটি বিরূপমানে শ্রেণীকরণ হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।  

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিবেদনে বলছে, মেসার্স সিয়ারস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা শুরুর মাত্র চারদিনের মাথায় ৩৮ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করে সাউথ বাংলা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। মঞ্জুর করার দুইমাস বাড়িয়ে ঋণ সীমা ৯০ কোটি টাকা করা হয়। গ্রাহকের অনুকূলে ফান্ডেড ঋণসীমার ৭৫ কোটি বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৬ কোটি টাকায়।  

অর্থাৎ গ্রাহকের অনুকূলে সীমা অতিরিক্ত ঋণ সুবিধা ছিল ২১ কোটি টাকা। ৩০ জুন ২০১৮ পর্যন্ত ব্যাংকের মোট মূলধন ছিল ৬১৮ কোটি টাকা। একক বৃহত্তম ফান্ডেড ঋণ সীমা ছিল ৯৩ কোটি টাকা। ফান্ডেড বকেয়ার পরিমাণ ছিল ৯৫ কোটি টাকা। যা ব্যাংকটির ফান্ডেড ঋণসীমা থেকে অতিরক্তি ৩ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়েছে।  

‘গ্রাহকের অনুকূলে সীমা অতিরিক্ত উত্তোলন সুবিধা বিদ্যমান থাকা সত্বেও গ্রাহককে অনৈতিক সুবিধা দিতে পরিচালনা পর্ষদ ঋণসীমা পুনরায় বৃদ্ধি ও নবায়ন করেছে,’ প্রতিবেদনে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।  

প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ইনল্যান্ড ডকুমেন্টারি বিল পার্চেজডের (আইডিবিপি) সুবিধার নামে মেসার্স তাহমিদ এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে ২৭ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। কাগজ রপ্তানির বিল কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই ব্যাংক এই অর্থছাড় করেছে। তাহমিদ এন্টারপ্রাইজের মালিক একেএম আমিনুল ইসলাম।  

মেসার্স আল আমিন পোল্ট্রি ফিডের অনুকূলে একক ঋণ সীমা অতিক্রম করে ১৫০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের মূল অনুযায়ী একক ঋণ সীমা ছিল মাত্র ৮৭ কোটি টাকা। সীমা অতিক্রম করে অতিরিক্ত বিতরণ করা হয়েছে ৬৩ কোটি টাকা।

মাহবুব ব্রাদাস (প্রা.) লিমিটেডের অনুকূলে ৫৭ কোটি টাকা ঋণ মঞ্জুর করা হলে পরবর্তীতে তা ৭১ কোটি টাকা করা হয়। সেখান থেকে ৩০ কোটি আবার কমানো হলেও পরে ৪৭ কোটি টাকার এসওডি ঋণ মঞ্জুর করে পরিচালনা পর্ষদ। (এসওডি হলো এক ধরনের ঋণ, যার বিপরীতে ১০০ শতাংশ নগদায়ন করার মতো অর্থ থাকে। যেমন সঞ্চয়পত্র বা এফডিআর জাতীয় আমানত। )

এছাড়া মেসার্স গেটকো অ্যাগ্রো ভিশন লিমিটেডের অনুকূলে ২২ কোটি টাকা মঞ্জুর করার পরের দিন ২১ কোটি ৯৪ লাখ টাকা উত্তোলন করেন গ্রাহক। একদিনে ঋণ সুবিধার পুরো অর্থ উত্তোলন করায় ঋণের সদ্ব্যবহারের বিষয়টি ব্যাংক নিশ্চিত করতে পারেনি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষে স্থিতি প্রায় ২৬ কোটি টাকা অর্থাৎ প্রায়  ৪ কোটি টাকা অতিরিক্ত স্থিতি ছিল।  

এসব প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত ঋণ সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে উঠে এসেছে। তাই এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বা দায়ী কর্মকর্তাদের চিহ্নিতদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এদিকে গত বছর সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের (এসবিএসি) চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে মেসার্স আলফা এক্সেসরিজ অ্যান্ড অ্যাগ্রো এক্সপোর্ট লিমিটেডের নামে ঋণ নিয়ে ৫৭ কোটি ২০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠে।

কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেখানো হয়েছে আমজাদ হোসেনের ছোট ভাই মো. আরজান আলীকে। চেয়ারম্যান  আমজাদ হোসেনের মেঝো ভাই মো. রুহুল কুদ্দুসের ১৯ বছরের মেয়ে মাহফুজা খাতুন রিশাকে এই কোম্পানির ৭৫ শতাংশ শেয়ারধারী দেখানো হয়েছে।  আর বাকি ২৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক এমডি আরজান আলী।  

কোম্পানি গঠনের দুই মাসের মধ্যে নিজের ব্যাংকে প্রভাব খাটিয়ে তিনি এই ঋণ নিয়েছেন বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরির্দশনে উঠে এসেছে। প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদন ছাড়াই কোম্পানির প্রকল্প কাজের জন্য তাইওয়ান ও চীন থেকে প্রায় ১৮ কোটি টাকার এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) স্থাপন করা হয়। ছাড় করা হয় ঋণের ১০ কোটি ৫৬ লাখ টাকাও।  

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, সর্বশেষ অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কর্মাস ব্যাংকের প্রিন্সিপাল শাখা ছাড়াও ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বেশ কয়েকটি শাখায় গ্রাহককে ঋণ সীমার অতিরিক্ত সুবিধা দিয়েছে পরিচালনা পর্ষদ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব বিষয় নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।  

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কর্মাস ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) গোলাম ফারুক।  

যোগাযোগ করা হলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, সবগুলো ঋণ হিসাবই এখন নিয়মিত আছে। এসব ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া নির্দেশনা যথাযথভাবে পরিপালন করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১৮
এসই/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।