ঢাকা, সোমবার, ১৪ আশ্বিন ১৪৩২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৬ রবিউস সানি ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

দ্বন্দ্বে জড়াবে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়

ইসমাইল হোসেন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২:০৩, সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৫
দ্বন্দ্বে জড়াবে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়

প্রস্তাবিত ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’র খসড়া অধ্যাদেশ প্রকাশের পর সরকারি সাত কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং কর্মচারীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। ঢাকার সাতটি কলেজ নিয়ে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয় হলে শিক্ষকদের চাকরি, কলেজের সম্পত্তি, কলেজভিত্তিক বিষয় বিলুপ্তি, নারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা তৈরিসহ ধর্মীয় শিক্ষার বিষয় বাদ পড়া নিয়ে জটিলতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রকাশিত খসড়া অধ্যাদেশ বাস্তবায়িত হলে সাত কলেজ স্বাতন্ত্র্য হারাবে। এজন্য তারা সাত দিনের মধ্যে একটি কমিশন গঠন করে তারা অধ্যাদেশ প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ওয়েবসাইটে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া প্রকাশ করা হয় গত ২৪ সেপ্টেম্বর। সাত কর্মদিবসের মধ্যে অনলাইনে ই-মেইলে এবং সচিবালয়ে একজন সিনিয়র সহকারী সচিবের কাছে মতামত পাঠাতে বলেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

খসড়া অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সাতটি কলেজ হবে সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির একেকটি ক্যাম্পাস। আর একেক ক্যাম্পাসে একেক স্কুলের অধীন বিষয়গুলো পড়ানো হবে। মোটা দাগে চারটি স্কুলে ভাগ করে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে। স্কুলগুলো হলো—স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড হিউম্যানিটিজ, স্কুল অব বিজনেস স্টাডিজ, স্কুল অব ল অ্যান্ড জাস্টিস।

খসড়া অধ্যাদেশ প্রকাশের পরপরই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। আর তিন দিনের মাথায় ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তারা। শিক্ষার্থীরা স্কুল পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে বলছে, এই স্কুলিং (হাইব্রিড) সিস্টেমের মাধ্যমে ক্যাম্পাসগুলোর স্বাতন্ত্র্য ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা জন্ম দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে ক্যাম্পাসগুলোর স্থাবর-অস্থাবর সকল প্রকার সম্পত্তি অর্জন করার অধিকার এবং হস্তান্তর করার ক্ষমতা রাখার প্রস্তাব নিয়ে শিক্ষার্থীরা বলছেন, এই ধারা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, ভবিষ্যতে কলেজগুলোর এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

ঢাকার ইডেন ও বদরুন্নেছা কলেজ নারী শিক্ষার্থীদের ঐতিহ্যবাহী উল্লেখ করে শিক্ষার্থীরা বলছেন, এই ক্যাম্পাসগুলোয় সহশিক্ষা চালু করা হবে। যার মাধ্যমে শত বছর ধরে নারীদের জন্য ডেডিকেটেড মহিলা কলেজগুলোয় নারীদের অগ্রাধিকার হ্রাস পাবে। পাশাপাশি ধর্মীয় বিষয়গুলোর অধিকাংশই বাদ পড়া এবং ইন্টারমিডিয়েট শিক্ষার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় উদ্বেগ জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীরা হাইব্রিড পদ্ধতি বাতিল করে একটি কমিশন গঠন করে সবার মতামত নিয়ে অধ্যাদেশ তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন।

ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী পিয়াস আলী বাংলানিউজকে বলেন, প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া অধ্যাদেশ নিয়ে সরকার, শিক্ষক, শিক্ষার্থী সবার মধ্যে একটা ত্রিমুখী সমস্যা তৈরি হয়েছে। সাত কলেজে এক লাখ ৭০ হাজার শিক্ষার্থী এবং ১৫০০ শিক্ষক রয়েছেন। তাদের কথা চিন্তা করে খসড়া অধ্যাদেশ হয়নি।

তিনি বলেন, সংবাদ সম্মেলনে আমাদের দাবিগুলো জানিয়েছি। আমরা ইউজিসি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও আলোচনা করবো। এরপরও কোনো সমাধান না পেলে অন্যান্য কলেজের সঙ্গে সমন্বয় করে পরবর্তী করণীয় চিন্তা করা হবে।

সাত কলেজের শিক্ষকরাও নানা শঙ্কায়

প্রস্তাবিত সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির কাঠামো কেমন হবে, তা নিয়ে আমরা সাত কলেজে কর্মরত শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে স্মারকলিপি দিয়েছেন। শিক্ষকরা তাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন। অথচ দুঃখজনকভাবে দেখা গেল যে আমাদের উদ্বেগ ও প্রস্তাবকে কোনো গুরুত্ব না দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া প্রস্তাব প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকাশিত খসড়ায় সাত কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী, কলেজে কর্মরত শিক্ষক ও কর্মচারীদের স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষকরা।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর শিক্ষকরা বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে আট দফা দাবি নিয়ে স্ব স্ব ক্যাম্পাসের সামনে মানববন্ধন করেন।

সাত কলেজের নাম (সাইনবোর্ড) বা কাঠামো পরিবর্তন করে কোনো অনুষদে অথবা স্কুলে রূপান্তর না করা; কলেজের লোগোসহ স্থাবর ও অস্থাবর সকল সম্পত্তি স্ব-স্ব কলেজের নামে অক্ষুণ্ন রাখা; সাত কলেজকে পরীক্ষাগার বা গিনিপিগ বানিয়ে কোনো পরীক্ষামূলক বিশ্ববিদ্যালয় মডেল চাপিয়ে না দিয়ে সাতটি সরকারি কলেজকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রেখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে সকল পদে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের নিয়োগ নিশ্চিত করার দাবি জানান শিক্ষকরা। এছাড়াও, বিদ্যমান কোনো বিষয় বিয়োজন না করা; ঢাকা কলেজসহ পাঁচটি কলেজের উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম স্বার্থবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত না নেওয়া; ইডেন মহিলা কলেজ ও বেগম বদরুন্নেছা কলেজে নারী শিক্ষার সুযোগ সংকোচন না করা; সাত কলেজে কর্মরত কোনো কর্মচারীর চাকরি বা অন্য কোনো স্বার্থ ক্ষুণ্ণ না করা; বিভিন্ন স্তরের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন রিভিউ কমিটির মাধ্যমে অধ্যাদেশ পর্যালোচনা করার দাবি জানান তারা।

এ ব্যাপারে কবি নজরুল সরকারি কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলানিউজকে বলেন, এতবার বসেছে কিন্তু আমাদের মতামত নেওয়া হয়নি। এই কলেজে ১৮টি বিষয়ে অনার্স পড়ানো হয়। সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি করা হলে এখানে আইন এবং সোহরাওয়ার্দী কলেজে পড়ানো হবে ক্রিমিনোলজি। ফলে স্কুলভিত্তিক করা হলে এক ধরনের সংকোচন হবে।

এমন খসড়া অধ্যাদেশের ফলে শিক্ষকরা যেমন শঙ্কায় তেমনি শিক্ষার্থীরাও শঙ্কায় আছেন। আর এখানে যে কর্মচারীরা আছেন তাদেরকে সেমিস্টার ফি থেকে পাওয়া বেতন দেওয়া হয়। তারাই বা কোথায় যাবেন? আবার কোনো পর্যায়ে উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোনো ঝামেলা হলে আবার উচ্চমাধ্যমিক বিলুপ্তির প্রশ্ন আসতে পারে। এসব বিবেচনায় আমরা চাই বিদ্যমান সনাতন কাঠামো বহাল থাকুক, বলেন মামুন।

প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া অধ্যাদেশ নিয়ে শিক্ষা সংকোচনের আশঙ্কা করছেন ঢাকা কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ, সাত কলেজের প্রাক্তন সমন্বয়ক এবং বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সাত কলেজ বিলুপ্ত করে সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি গঠনের প্রস্তাব করেছে। এতে সাধারণের সন্তানদের শিক্ষা সংকোচনের পাশাপাশি নারী শিক্ষার পথ রুদ্ধ হবে। এটি গভীর ষড়যন্ত্র। এতে প্রাইভেট শিক্ষা ব্যবসায়ী ও তাদের এজেন্টদের যোগসাজশ রয়েছে। সময় ফুরিয়ে যায়নি, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সঙ্গে বসুন। আমরা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে নই, তবে সাত কলেজের স্বাতন্ত্র্যবোধ বিলোপ করে অবশ্যই নয়।

এমআইএইচ/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।