ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩১ ভাদ্র ১৪৩২, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

বাংলানিউজ স্পেশাল

৩৩ বছর ছাত্র সংসদ নেই বিএল কলেজে, অবিলম্বে নির্বাচনের দাবি

মাহবুবুর রহমান মুন্না, ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:৩৯, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২৫
৩৩ বছর ছাত্র সংসদ নেই বিএল কলেজে, অবিলম্বে নির্বাচনের দাবি সরকারি ব্রজলাল কলেজ (বিএল কলেজ) ফটক। ছবি: বাংলানিউজ

খুলনা: বৃহত্তর খুলনার উচ্চশিক্ষার প্রথম বাতিঘর, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ বিদ্যাপীঠ সরকারি ব্রজলাল কলেজ (বিএল কলেজ)। এ কলেজে দীর্ঘ ৩৩ বছর থেকে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নেই।

সাধারণ শিক্ষার্থীসহ ছাত্র সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানানো হয়েছে।

শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের অনেক শীর্ষ নেতা কিংবা প্রয়াত অনেক জাতীয় নেতা এ কলেজ থেকে তাদের সোনালি রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে ছাত্র সংসদ না থাকার ফলে শিক্ষাঙ্গনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ছাত্র সংসদ পুনরায় চালু হলে শিক্ষার্থীরা নতুন নেতৃত্বের সুযোগ পাবে এবং গণতান্ত্রিক চর্চার ঐতিহ্য ফিরে আসবে।

১২৩ বছরের কলেজ
খুলনা নগর থেকে আট কিলোমিটার দূরে দৌলতপুরের ভৈরব নদের তীরে ১৯০২ সালের ২৭ জুলাই কলকাতার হিন্দু কলেজের আদলে প্রতিষ্ঠিত হয় বিএল কলেজ। শুরুতে এর নাম ছিল ‘হিন্দু অ্যাকাডেমি’।

এটির প্রতিষ্ঠাতা বৃহত্তর খুলনার বাগেরহাটের বাউডাঙ্গার জমিদার ও তৎকালীন কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী ব্রজলাল চক্রবর্তী (শাস্ত্রী)। তিনি ছিলেন সংস্কৃত, ইংরেজি সাহিত্য ও আইন বিষয়ের পণ্ডিত। এই বিদ্যানুরাগীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং খুলনাসহ বিভিন্ন স্থানের মানুষের আর্থিক সহায়তা ও সমর্থনে কলেজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।

১৯০২ সালের ৩ জুলাই কলেজের দাপ্তরিক কার্যক্রম শুরু হলেও পাঠদান শুরু হয় ২৭ জুলাই। ১৯০৩ সালে ‘চতুষ্পাঠী’ এবং ১৯০৭ সালে বি-গ্রেডের কলেজ হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করে প্রতিষ্ঠানটি। পরে চতুষ্পাঠী বন্ধ হয়ে গেলে শুধু কলেজের কার্যক্রম চলতে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে ৪৯ জন ছাত্র নিয়ে এফএ (ফার্স্ট আর্টস) ক্লাস শুরু হয়। আবাসিক কলেজ হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং এটি ছিল অবিভক্ত বঙ্গদেশের প্রথম আবাসিক কলেজ। তখন শিক্ষকের সংখ্যা ছিল অধ্যক্ষসহ চারজন। প্রথম সাত বছর এখানে শুধু উচ্চবর্ণের হিন্দু ছাত্ররা লেখাপড়ার সুযোগ পেয়েছে। শুরুতে এই হিন্দু অ্যাকাডেমিতে মুসলিম ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ভর্তি হওয়ার সুযোগ ছিল না।

১২৩ বছরে পা দেওয়া এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী এখন ৩৩ হাজার। বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক পাস, ২১টি বিষয়ে স্নাতক সম্মান এবং ২০টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স চালু আছে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য সাতটি ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস রয়েছে। রয়েছে ছাত্র সংসদ ভবনও।

৩৩ বছর ধরে নেই ছাত্র সংসদ
এক সময় কলেজটিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে বিএল কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচন। নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় একদিকে যেমন নতুন নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না, অন্যদিকে শিক্ষার্থীরাও তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরার মাধ্যম পাচ্ছেন না, ফলে হচ্ছেন অধিকারবঞ্চিত।

বিএল কলেজ ছাত্র সংসদের সর্বশেষ নির্বাচন ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয়। পরের বছর ১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ছাত্র সংসদের জিএস (সাধারণ সম্পাদক) শিবির নেতা মুন্সী আবদুল হালিম এবং সংসদের সাহিত্য সম্পাদক আরেক শিবির নেতা শেখ রহমত আলীকে ক্যাম্পাসের ভেতরে গলা কেটে হত্যা করা হয়। ওই দিনই বিএল কলেজ ছাত্র সংসদ বন্ধ ও ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পরে ছাত্র রাজনীতি চালু হলেও সংসদ আর চালু হয়নি।

ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ছাত্র সংসদের জন্য সোচ্চার হয়েছেন বিএল কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা এখন বিএল কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি তুলছেন।

শিক্ষার্থী ও ছাত্রনেতারা যা বলছেন
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বিএল কলেজ শাখা সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রিফাত ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, দক্ষিণ বঙ্গের বৃহত্তর উচ্চশিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান সরকারি বিএল কলেজ। এখানে ছাত্র সংসদ আছে। সুদীর্ঘ বছর ধরে নির্বাচন হয় না। আমরা মনে করি এই মুহূর্তে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রয়োজন। এতে নতুন নেতৃত্ব আসবে।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের সরকারি বিএল কলেজ শাখার সভাপতি হযরত আলী বাংলানিউজকে বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন এখন সময়ের দাবি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষকে দাবির কথা জানিয়েছি। আবারও এ দাবির কথা তুলবো আমরা।

ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের সরকারি বিএল কলেজ শাখার সভাপতি শোয়াইব আহম্মাদ আলম বলেন, খুলনা বিভাগের ঐতিহ্যবাহী আমাদের এই কলেজে দীর্ঘদিন ছাত্র নেতৃত্ব না থাকার কারণে নানামুখী সংকট তৈরি হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম যাতায়াতের গাড়ির সমস্যা, ছাত্রীদের আবাসন সংকট, আবাসিক হলে খাবারের মান অত্যন্ত নিম্নমানের, কলেজে বহিরাগতদের মাদকসেবনসহ বিভিন্ন সমস্যা। ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে এই সমস্যা অচিরেই কেটে যাবে বলে আমরা মনে করছি। তাছাড়া দীর্ঘদিন ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে কলেজ প্রশাসন ঠিকমতো কাজ করতে পারেনি, একটি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে দ্রুত এই সমস্যা সমাধানের প্রয়োজন।

বিএল কলেজের শিক্ষার্থী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক সাজিদুল ইসলাম বাপ্পি বাংলানিউজকে বলেন, শিক্ষার্থীদের সংখ্যার দিক দিয়ে সরকারি বিএল কলেজ ঢাবি থেকে কোনো অংশে কম নয়। এখানে প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। এই বিপুল শিক্ষার্থীর প্রতিষ্ঠান দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অক্সফোর্ড খ্যাত সরকারি ব্রজলাল কলেজে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ছাত্র সংসদ না থাকার ফলে খুলনার ছাত্রসমাজ অনেকটা উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীদের অভাব-অভিযোগের বিষয়ে বলার কোনো জায়গা নেই। কিছু শিক্ষক ও কয়েকজন পথভ্রষ্ট নেতার হাতে সবকিছু জিম্মি হয়ে আছে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলের আবাসন সিট বণ্টনকে কেন্দ্র করে। তাছাড়া খেলাধুলা, চিত্তবিনোদন, ভ্রমণ অনুষ্ঠান, জাতীয় অনুষ্ঠান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপনসহ কলেজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক ও প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।  

জুলাই অভ্যুত্থানের খুলনার সংগঠক বাপ্পি আরও বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দের ছাত্রনেতাকে বেছে নিতে পারলে ক্যাম্পাসগুলোতে সহিংসতা ও উগ্রতা অনেকাংশেই কমে আসতো। ছাত্র সংগঠনগুলোও দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি থেকে সরে আসতে বাধ্য হতো। দলীয় কমান্ডের চেয়ে শিক্ষার্থীদের ভাবনা ও প্রত্যাশা বেশি গুরুত্ব পেতো। সাধারণ শিক্ষার্থীরাও তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবি-দাওয়া প্রকাশের মঞ্চ খুঁজে পেতো।

তিনি আরও বলেন, সরকারি ব্রজলাল কলেজ ছাত্র সংসদের নেতারা একসময় খুলনা শহরসহ দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নেতৃত্ব দিতেন। অথচ দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র সংসদ না থাকায় একসময়ের শিল্পনগরী খুলনাঞ্চল মৃত নগরে পরিণত হলেও অর্থনীতির এই দৈন্যদশায় দেশ ও দশের জন্য ছাত্রনেতাদের ঝাঁঝালো কণ্ঠ আর শোনা যায় না। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্বশূন্য খুলনায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত তরুণ নেতৃত্ব ক্রমান্বয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে। খুলনাঞ্চলও তার হারানো জৌলুশ ফিরে পাবে।

কলেজের শিক্ষার্থী নাসরিন সুলতানা উর্মী বাংলানিউজকে বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে যে প্রতিনিধি উঠে আসে তারা কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে না; বরং তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করে। গুটিকয়েক মানুষ নিজ স্বার্থের জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। কিন্তু ক্যাম্পাসের প্রতিটি সাধারণ শিক্ষার্থী চায়, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতিবছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হোক। তাই শিক্ষার্থীদের সকল সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে এবং লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতিরও মীমাংসা করতে অবিলম্বে বিএল কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে।

কলেজের শিক্ষার্থী রিয়াদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের ক্যাম্পাসে দীর্ঘদিন ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমস্যা, সংকটের কথাগুলো ঠিকমতো উঠে আসছে না। ক্যান্টিনের অব্যবস্থাপনা, আবাসিক হল চালু না হওয়া বা পরিবহন সংকট দিনদিন শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। আমরা দেখছি, ছাত্র সংসদ না থাকায় কলেজের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের সামাজিক বা সাংস্কৃতিক কাজেও সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসছে না। ফলে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ না থাকায় এ জাতীয় কাজগুলো সহজে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তাই আশা করবো, বিএল কলেজ ক্যাম্পাসের সব সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক চর্চায় গুণগত পরিবর্তন আনতে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা বা দাবিগুলো তুলে ধরতে প্রশাসন দ্রুতই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।

যা বলছেন অধ্যক্ষ
সরকারি বিএল কলেজের অধ্যক্ষ সেখ মো. হুমায়ুন কবীর বাংলানিউজকে বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখনো কোনো নির্দেশনা পাইনি। পেলে অবশ্য আমরাও নির্বাচনের আয়োজন করব। ১৯৯২ সালের পর থেকে এই কলেজে আর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। ছাত্র সংসদের রুমটি এখন কমন রুম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

এমআরএম/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।