সাবেক এক সরকারি কর্মকর্তা নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলছিলেন, তার একমাত্র ছেলে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিল। মাদক নেওয়ার কারণে পড়াশোনা শেষ করতে পারেনি সে।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমার ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছিল। কিন্তু মাদক সব শেষ করে দিয়েছে। আমার পরিবারও সামাজিকভাবে হেয় হয়েছে। আসলে একটি পরিবারকে ধ্বংস করতে মাদকই যথেষ্ট।
শুধু তিনিই নন, আরও অনেক অভিভাবক একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। কারো সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে, কারও মেডিকেল কলেজে পড়ত, আবার কারও সন্তান তখনও স্কুল–কলেজের ছাত্র। সবাই একই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার।
অভিভাবকেরা জানান, মাদকাসক্ত সন্তানরা প্রায়ই বাবা–মায়ের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। চাহিদা মতো টাকা না পেলে তারা কখনো মারধর করে, এমনকি অপরাধেও জড়িয়ে পড়ে।
ঢাকার মানসিক ও মাদকাসক্তি চিকিৎসা কেন্দ্রের মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলর নুসরাত সাবরিন চৌধুরী বলছিলেন, অধিকাংশ পরিবার বিষয়টি গোপন রাখে। কাউকে জানাতে চায় না বা চিকিৎসার প্রয়োজন মনে করে না। এভাবেই মাদকসেবীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে।
দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা কত
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সমীক্ষা অনুযায়ী, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পুরুষ ৭৭ লাখ ৬০ হাজার এবং নারী দুই লাখ ৮৫ হাজার। এর বাইরে দুই লাখ ৫৫ হাজার শিশু-কিশোর মাদকে আসক্ত।
মাদকাসক্তদের মধ্যে প্রায় ৬১ লাখ গাঁজায় (প্রায় ৫২ শতাংশ), ২৩ লাখ ইয়াবায় (প্রায় ২০ শতাংশ) ও ২০ লাখ ২৪ হাজার মদ্যপানে (১৭ শতাংশ) আসক্ত। তিন লাখ ৪৬ হাজারের বেশি মানুষ ফেনসিডিল ও সমজাতীয় মাদকে এবং তিন লাখ ২০ হাজার মানুষ হেরোইনে আসক্ত।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে, তিন লাখের মতো মানুষ ঘুমের ওষুধ মাদক হিসেবে নেন। ড্যান্ডির মতো আঠাকে মাদক হিসেবে ব্যবহার করেন এক লাখ ৬০ হাজারের মতো মানুষ। শিরায় মাদক নেন প্রায় ৩৯ হাজার মানুষ।
সব মিলিয়ে এই সংখ্যা দাঁড়ায় এক কোটি ১৭ লাখের মতো। তবে একই ব্যক্তি একাধিক মাদকে আসক্ত। সেটা বিবেচনায় নিয়ে এই হিসাব তৈরি করা হয়েছে। ফলে মোট মাদকাসক্ত দাঁড়ায় ৮৩ লাখে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) হাসান মারুফ গণমাধ্যমকে বলেন, দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে এবং মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। অধিদপ্তরের সীমিত সম্পদ ও সুবিধা দিয়েই মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
যেসব সীমান্ত দিয়ে আসছে মাদক
ড্রাগ রিপোর্ট-২০২৪ এ বলা হয়েছে, মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও ভৌগোলিকভাবে মাদকের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মাদক চোরাচালানের পথ (রুট) গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল (মিয়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ডের সীমানা), গোল্ডেন ক্রিসেন্ট (ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান) এবং গোল্ডেন ওয়েজের (ভারতের হিমাচল প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, নেপাল ও ভুটানের কিছু অংশ) একেবারে কেন্দ্রে অবস্থান হওয়ায় এমন ঝুঁকিতে বাংলাদেশ।
এ ছাড়া ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে দেশের ৩২টি সীমান্তবর্তী জেলা রয়েছে। এসব জেলার অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশে প্রচলিত ও অপ্রচলিত মাদক দেশে আসছে।
দেশের ১০৪টি ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত পয়েন্ট
মাদকবিষয়ক প্রতিবেদনে দেশের চারটি অঞ্চলের ১০৪টি ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশের পশ্চিমাঞ্চলের আট জেলার ৪৩টি, পূর্বাঞ্চলের চার জেলার ২১টি, উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার ২১টি এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলা কক্সবাজারের ১৯টি ঝুঁকিপূর্ণ সীমান্ত পয়েন্ট চিহ্নিত করা হয়েছে।
আশির দশক থেকে দেশে ভারত থেকে প্রচুর ফেনসিডিল আসা শুরু হয়। পরে ফেনসিডিলের জায়গা নেয় ইয়াবা। মিয়ানমার থেকে এখনো প্রচুর ইয়াবা আসে। পাশাপাশি নতুন করে আসা শুরু হয়েছে ক্রিস্টাল মেথ, যা মূলত ইয়াবার মূল উপাদান।
ঠিকঠাক হয় না তদন্ত ও সাক্ষ্যদান
দেশে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও কোস্টগার্ড মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে। তবে মাদকের ছোট কারবারি ও মাদকসেবীদের বেশি ধরা হয়। আড়ালে থেকে যায় বড় মাদক কারবারিরা। আবার মাদক মামলার তদন্ত ও সাক্ষ্যদান ঠিকমতো হয় না বলে বেশির ভাগ মামলায় আসামি খালাস পেয়ে যান।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০২৪ সালে তিন হাজার ৬৯৮টি মাদক মামলার রায় হয়েছে, তার মধ্যে ৫৫ শতাংশ মামলায় সব আসামি খালাস পেয়েছেন।
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আঙ্কটাডের ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে মাদকের কারণে প্রতি বছর পাচার হয়ে যায় ৪৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার (৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা)। আর মাদক কারবারি করে অর্থ পাচারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে পঞ্চম।
দেশে মাদকাসক্তদের চিকিৎসার দশা
মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্রের প্রয়োজন থাকলেও দেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসাকেন্দ্র নেই। ঢাকার কেন্দ্রীয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রসহ চার বিভাগীয় শহরের চারটিতে একসঙ্গে মাত্র ১৯৯ জন রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে বেসরকারি পর্যায়ে ৩৮৭টি মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। নতুন করে সরকারিভাবে ঢাকায় ২৫০ শয্যার এবং দেশের বাকি সাতটি বিভাগে ২০০ শয্যাবিশিষ্ট আরও সাতটি পূর্ণাঙ্গ মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
মনোরোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আহমেদ হেলাল বলেন, যারা মাদকাসক্ত, তাদের মধ্যে বড় অংশই তরুণ-যুবক। ফলে চিকিৎসার মাধ্যমে এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা জরুরি। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের যদি পুনর্বাসন করা না যায়, তবে তারা সমাজের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবেন।
মনোচিকিৎসক এম এ মোহিত কামাল বলেন, আমি মনে করি, মাদক হচ্ছে মস্তিষ্কের রাসায়নিক দানব। কোনো কোনো মাদক ব্রেইনে ঢুকে এক বছর পর্যন্ত অ্যাক্টিভ ফর্মে থাকে এবং চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি সব নিয়ন্ত্রণ করে। এ নিয়ন্ত্রণ সুশৃঙ্খল থাকে না, বিশৃঙ্খল করে দেয়। ব্যক্তি সহিংস হয়ে পড়ে, নিষ্ঠুর আচরণ শুরু করে। এক পর্যায়ে মাদকাসক্তরা রাগের বশে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খুনখারাবিও করতে দ্বিধা করে না।
এই চিকিৎসক আরও বলেন, কোথাও কোথাও দেখা যায় মাদকাসক্তরা পুলিশের ওপর হামলা করছে। সুতরাং সবাইকে এর প্রতিরোধে, প্রতিকারে এগিয়ে আসতে হবে এবং আইনের সুরক্ষা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে অপরাধীকে দ্রুত আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মাদকাসক্ত তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। তরুণদের মাদকাসক্ত হওয়ার পেছনে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যত কারণ থাকুক না কেন মাদকের সহজলভ্যতা এর প্রধান কারণ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে কেউ হতাশ হয়ে পড়লে, একাকীত্ব সৃষ্টি হলে, সম্পর্ক ভেঙে গেলে কিংবা বন্ধু বা সঙ্গীর অনুরোধে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। পরিবার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জনপ্রতিনিধি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মাদক প্রতিরোধে প্রচলিত কার্যক্রম সফলতা সৃষ্টি করতে পারছে না। যতক্ষণ পর্যন্ত দেশে মাদক প্রবেশ ও অভ্যন্তরীণ মাদক উৎপাদন বন্ধ করা না ততক্ষণ পর্যন্ত মাদকের ভয়াবহতা বন্ধ হবে না।
তিনি আরও বলেন, যারা মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করবেন, মাদক প্রবেশে বাধা দেবেন এবং মাদক কারবারে জড়িতদের আইনের মুখোমুখি করবেন, তাদেরই একটি অংশ মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত। এখান থেকে তারা আর্থিক সুবিধা নিয়ে থাকেন। তাই যারা প্রতিরোধ করবেন তারাই সমস্যার অংশ হলে সেই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়।
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বললেও বাস্তবিক অর্থে এর উপস্থিতি ও প্রয়োগের জায়গাটি দৃশ্যমান নয়। মাঝেমধ্যে অভিযান, মাদকের বাহক ও মাদকাসক্তকে গ্রেপ্তার করে মাদক সমস্যার সমাধান করা যাবে না।
তিনি বলেন, মাদকাসক্ত তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আগামীতে বাংলাদেশ ভয়াবহ ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। কারণ মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা একটা সময় গিয়ে নিজে অন্যের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, কর্মক্ষমতা কমে যায়, কাজের ইচ্ছা হারিয়ে ফেলে এবং সমাজ ও পারিবারিক পর্যায়ে সম্পর্ক নষ্ট করে।
এমএমআই/আরএইচ