ঢাকা, সোমবার, ৪ কার্তিক ১৪৩২, ২০ অক্টোবর ২০২৫, ২৭ রবিউস সানি ১৪৪৭

অন্যান্য

খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অপচয় রোধ করা প্রয়োজন

ড. জাহাঙ্গীর আলম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:১৯, অক্টোবর ২০, ২০২৫
খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অপচয় রোধ করা প্রয়োজন ড. জাহাঙ্গীর আলম

জীবনের জন্য খাদ্য অপরিহার্য। মানুষের মৌলিক প্রয়োজনগুলোর মধ্যে প্রথমেই খাদ্যের অবস্থান।

সে কারণে বিগত অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর বিশ্বব্যাপী যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। উদ্ভাবন করা হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি।

বাস্তবায়ন করা হয়েছে সবুজ বিপ্লব। ১৯৭১ সালে বিশ্বের মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল ১.১৮ বিলিয়ন মেট্রিক টন। ২০২৪-২৫ সালে তা ২.৮৪১ বিলিয়ন মেট্রিক টনে বৃদ্ধি পায়। এই ৫৫ বছরের ব্যবধানে মোট উৎপাদন বেড়েছে ১৪০.৭৫ শতাংশ।

বছরে গড়ে বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে ১.৬ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে।

বর্তমানে পৃথিবীতে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়, তা দিয়ে বৈশ্বিক জনসংখ্যার দেড় গুণেরও বেশি মানুষকে খাওয়ানো সম্ভব। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী উল্লেখযোগ্য হারে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও অপুষ্টি বিরাজ করছে। প্রায় ৭৮৩ মিলিয়ন মানুষ বর্তমানে অভুক্ত থাকছে।

মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এর জন্য দায়ী অসম বণ্টন, খাদ্যে প্রবেশাধিকারের অভাব এবং দুর্বল অবকাঠামো। তা ছাড়া অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো খাদ্য অপচয়। বিশ্বব্যাপী মোট উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ নষ্ট বা অপচয় হয়। এর পরিমাণ দৈনিক এক বিলিয়ন মিল বা খাবার।

বছরে প্রায় এক ট্রিলিয়ন ডলার লোকসান হয় অপচয়ের জন্য। এর সঙ্গে অপচয় হয় উৎপাদনকাজে নিয়োজিত জমি, পানি ও তেজ বা শক্তি। দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র্য এবং ক্ষুধার অন্যতম কারণ খাদ্য নষ্ট ও অপচয়। ধনী ও উন্নয়নশীল সব দেশেই বিপুল পরিমাণ খাদ্যের অপচয় দৃশ্যমান। অপেক্ষাকৃত উষ্ণ আবহাওয়ার দেশগুলোতে খাদ্য অপচয় বেশি। উচ্চ তাপমাত্রার কারণে প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ ও পরিবহনের ক্ষেত্রে খাদ্য অপচয় বেশি হয়।

বাংলাদেশের আবহাওয়া উষ্ণ ও আর্দ্র। এখানে খাদ্যের পচনশীলতা তুলনামূলকভাবে বেশি। খাদ্য সংরক্ষণ পদ্ধতি অনেকটা সেকেলে। পরিবহনব্যবস্থায় শীতল শৃঙ্খল প্রায় অনুপস্থিত। মাঠের ফসলে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ নিত্যনৈমিত্তিক। ফসল সংগ্রহ, মাড়াই, ঝাড়াই, প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেটজাতকরণ ব্যবস্থা তেমন উন্নত নয়। সে কারণে খাদ্যপণ্যের অপচয় বেশি। ইউএনএফপি পরিবেশিত খাদ্যবর্জ্য সূচক প্রতিবেদন ২০২৪ অনুসারে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪.১০ মিলিয়ন টন খাদ্যপণ্য অপচয় হয়। এটি ২০২১ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ১০.৬২ মিলিয়ন টন অপেক্ষা ৩২.৭৮ শতাংশ বেশি। ২০২১ সালে জনপ্রতি ৬৫ কেজি খাদ্যপণ্যের অপচয় হতো।

২০২৪ সালে তা বৃদ্ধি পায় জনপ্রতি ৮২ কেজিতে। খাদ্য অপচয়ের এই পরিমাণ যুক্তিরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের চেয়ে বেশি। একজন ব্যক্তি বছরে গড়ে যুক্তরাজ্যে ৭৬ কেজি, যুক্তরাষ্ট্রে ৭৩ কেজি, জাপানে ৩৮ কেজি, চীনে ৭৫ কেজি, রাশিয়ায় ৩৩ কেজি এবং ভারতে ৫৫ কেজি খাদ্য অপচয় করে। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশে খাদ্য অপচয় রোধকল্পে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণের দাবি রাখে।

এসডিজির লক্ষ্য অনুযায়ী আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্য অপচয় অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। এ সম্পর্কে দেশের সাধারণ মানুষের তেমন ধারণা আছে বলে মনে হয় না। কিছুদিন আগে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এ সম্পর্কে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকায়। এর সংক্ষিপ্ত শিরোনাম ছিল ‘খাদ্য অপচয় ও ক্ষতি শূন্যের পথে’। এটি আমাদের ঐকান্তিক প্রত্যাশা। কিন্তু এর বাস্তবতা থেকে আমরা যোজন যোজন দূরে।

বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল এক কোটি ১০ লাখ টন। এর ৫২ বছর পর ২০২৩-২৪ সালে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় পাঁচ কোটি ১১ লাখ টন। এতে মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৬৪.৫৫ শতাংশ। প্রতিবছর গড়ে ২.৯ শতাংশ চক্রবৃদ্ধি হারে উৎপাদন বেড়েছে। তার পরও আমাদের আমদানিনির্ভরতা রয়ে গেছে। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৭০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমাদের আমদানি করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩১ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ৬৩ শতাংশ মানুষ পুষ্টিমান সমৃদ্ধ খাবার পায় না। এতে দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করছে। এসবের অন্যতম কারণ খাদ্যপণ্যের বিশাল অপচয়। এর বেশির ভাগ হয় উৎপাদন, পরিবহন, প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ ও বিপণনের সময়।

এক সমীক্ষায় দেখা যায়, আমাদের উৎপাদিত খাদ্যের ২৭ শতাংশই খাবার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছায় না। মাঠে ফসল নষ্ট হওয়া ও পরবর্তী অপচয়ের কারণে এমনটি ঘটে। দানাদার ফসলের ক্ষেত্রে অপচয় কিছুটা কম। ফলমূল, শাক-সবজি, আলু, পেঁয়াজ, দুধ ও মাছের ক্ষেত্রে অপচয়ের মাত্রা অনেক বেশি। প্রতিবছর প্রায় ২৩ শতাংশ ধান-চাল, ১৭ শতাংশ গম, ২৭ শতাংশ মসুর ডাল, ২০ শতাংশ কলা, ২৯ শতাংশ আম, ২২ শতাংশ আলু, ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ, ২৭ শতাংশ গাজর, ১০ শতাংশ টমেটো, ২৪ শতাংশ শাক-সবজি এবং ৩৬ শতাংশ মাছ নষ্ট বা অপচয় হয়। বাড়িতে খাবার টেবিলে, নগরীর রেস্টুরেন্টে এবং বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানে যে পরিমাণ খাদ্য নষ্ট হয়, তা উদ্বেগজনক।

বাজার থেকে অতিরিক্ত খাদ্য ক্রয়, দুর্বল খাদ্য ব্যবস্থাপনা, পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজের অভাব, বাজারজাতে অকার্যকর অবকাঠামো, অদক্ষ পরিবহনব্যবস্থা এবং জনসচেতনতার অভাবে আমাদের খাদ্য অপচয় বেশি হয়। বাংলাদেশে যখন কোটি কোটি মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য জোগাড় করতে পারে না, তখন বিপুল পরিমাণ খাদ্য অপচয়ের কথা বিলাসিতা বলেই মনে হয়। এর লাগাম টানা দরকার। নতুবা আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, আর্থিক ক্ষতি বৃদ্ধি পাবে এবং পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। খাদ্য অপচয় ও ক্ষতি রোধে সরকার, বেসরকারি খাত ও নাগরিক সমাজের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। উপযুক্ত কার্যপরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ ও পরিবহনের ক্ষেত্রে আধুনিক কলাকৌশল গ্রহণের সঙ্গে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন এবং তাঁদের সচেতন করা প্রয়োজন।

ইসলাম ধর্মে খাদ্য অপচয় নিষেধ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা খাও ও পান করো, কিন্তু অপচয় কোরো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না’ (সুরা  আরাফ, আয়াত-৩১)। অপর এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা এগুলোর ফল খাও, যখন তা ফলবন্ত এবং এগুলোর হক আদায় করো ফসল কাটার দিন। আর তোমরা অপচয় কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না’ (সুরা আনআম, আয়াত-১৪১)। আমাদের রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদ্য অপচয়কে বর্জনীয় বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। খাবার শেষে তিনি প্লেট ও আঙুল পর্যন্ত চেটে খেয়ে উম্মতের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাই যখন আমরা খাবার নষ্ট করি, তখন আমরা ঐশ্বরিক আশীর্বাদকেও অবহেলা করি। বর্তমানে খাদ্য অপচয় আমাদের একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ গরিব-মিসকিনরা দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে গলদঘর্ম হচ্ছে। ক্ষুধার জ্বালায় তারা ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এতে তারা সীমাহীন কষ্ট পাচ্ছে। তাদের দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতা বাড়ছে। বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে সমাজে। কাজেই ধর্মীয়, মানবিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেও খাদ্য অপচয় রোধ করতে হবে। এ বিষয়ে উপযুক্ত নীতি-কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন।

লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ

এসআই


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।