ঢাকা, শুক্রবার, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ২৩ মে ২০২৫, ২৫ জিলকদ ১৪৪৬

রাজনীতি

ইশরাকে রাজনীতিতে নাটকীয় মোড়, দৃশ্যপটে বিএনপি

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১:১৭, মে ২৩, ২০২৫
ইশরাকে রাজনীতিতে নাটকীয় মোড়, দৃশ্যপটে বিএনপি আন্দোলনে সমর্থকদের সঙ্গে ইশরাক হোসেন। ছবি: ডি এইচ বাদল

ঢাকা: বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের সমর্থকদের আন্দোলনের ফলে ৫ আগস্ট পরবর্তী রাজনীতির দৃশ্যপটে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে, যদিও শুরুর দিকে ছাত্রদের এবং পরে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি নেতাদের দাপট ছিল।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে ইশরাকের শপথের আন্দোলন ঘিরেই দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি রাজনীতির মঞ্চে শক্তি প্রদর্শন করেছে।

এখন রাজনীতিতে নানা সমীকরণ দেখা যাচ্ছে।

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বুধবার ঢাকা সেনানিবাসে অফিসার্স অ্যাড্রেসে ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেন। এর একদিন পর উচ্চ আদালত ইশরাক হোসেনের শপথের বৈধতা নিয়ে করা রিট খারিজ করে দেন।

এই ‘বিজয়’ উদযাপন করতে গিয়ে ইশরাক হোসেন ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে থাকা দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেন এবং ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন। তার কয়েক ঘণ্টা পরই বিএনপি এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে কয়েকজন উপদেষ্টার অব্যাহতির দাবি জানায়।

এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার তথা এনসিপি কী পদক্ষেপ নেবে, তা এখন আলোচনার কেন্দ্রে। রাজপথ কাঁপানো এনসিপির সভাগুলোতেও এখন কর্মীদের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে। নির্বাচন কমিশনের সামনে তাদের সাম্প্রতিক বিক্ষোভে যৎসামান্য উপস্থিতিই তার ইঙ্গিত দেয়।

এদিকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, অধ্যাপক ইউনূস এরইমধ্যে অভ্যুত্থানের নায়কদের ডেকে বলেছেন, ‘তোমরা সংযত হও, না হলে আমি পদত্যাগ করব। ’ এই তথ্য ঘিরে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

এর মধ্যেই এসেছে আরেকটি খবর— এনসিপি প্রধান নাহিদ ইসলাম যমুনায় সাক্ষাৎ করেছেন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। নাহিদ বিগত সরকারের পতনের সময় অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন এবং পরে উপদেষ্টা পদে আসীন হন, যদিও পরে নিজে দল গঠনের জন্য সেই পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগ নিয়ে আলোচনা

সাক্ষাতের পর বিবিসি বাংলাকে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘দেশের চলমান পরিস্থিতি, স্যারের (অধ্যাপক ইউনূস) তো পদত্যাগের একটা খবর আমরা আজ সকাল থেকে শুনছি। তো ওই বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে স্যারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ’

প্রধান উপদেষ্টা দেশের চলমান পরিস্থিতিতে কাজ করতে পারবেন না- এমন শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বলে জানিয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক।

তিনি বলেন, ‘স্যার বলছেন, আমি যদি কাজ করতে না পারি... যে জায়গা থেকে তোমরা আমাকে আনছিলা একটা গণ অভ্যুত্থানের পর। দেশের পরিবর্তন, সংস্কার...। কিন্তু যেই পরিস্থিতি যেভাবে আন্দোলন বা যেভাবে আমাকে জিম্মি করা হচ্ছে। আমি তো এভাবে কাজ করতে পারব না। ’ 

প্রধান উপদেষ্টাকে পদত্যাগের মতো সিদ্ধান্ত না নিতে আহ্বান জানিয়েছেন গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন গঠিত দলটির নেতা নাহিদ ইসলাম।

প্রধান উপদেষ্টাকে নাহিদ বলেছেন, আমাদের গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তা ও দেশের ভবিষ্যৎ সবকিছু মিলিয়ে তিনি যেন শক্ত থাকেন। সব দলকে নিয়ে যেন ঐক্যের জায়গায় থাকেন। সবাই তার সঙ্গে আশা করি কো-অপারেট করবেন।

প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগের বিষয়টি বিবেচনা করছেন বলে জানান নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ যদি কাজ করতে না পারেন, থাকবেন, থেকে কী লাভ। ’ 

এই আলোচনার পরে প্রধান উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে জানিয়েছেন, ‘পদত্যাগের বিষয়ে ভাবছেন’ তিনি। ‘তিনি বলছেন এ বিষয়ে ভাবছেন। তার কাছে মনে হয়েছে পরিস্থিতি এ রকম যে তিনি কাজ করতে পারবেন না। ’

পদত্যাগের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার এখনকার মনোভাবের বিষয়ে নহিদ ইসলাম বলেন, ‘এখন যদি রাজনৈতিক দল তার পদত্যাগ চায়.... সেই আস্থার জায়গা, আশ্বাসের জায়গা না পেলে তিনি থাকবেন কেন?’

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিজয়ের পর ছাত্রদের বারংবার অনুরোধের পর নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। সরকার গঠনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।

কিন্তু মব ভায়োলেন্স, জনগণের নিরাপত্তায় ঘাটতি, অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি না হওয়া, করিডোর নিয়ে অস্পষ্টতা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল বিদেশিদের দিয়ে পরিচালনার প্রক্রিয়া নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে। বিশেষ করে করিডোর ও নির্বাচনের তারিখ নিয়ে অস্পষ্টতা নিয়ে নানা প্রশ্ন সামনে আসে।

দৃশ্যপটে বিএনপি

বিএনপি বারবার নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণের কথা বললেও সরকারের পক্ষ থেকে ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত সময়সীমার কথা বলা হচ্ছিল। তবে এনসিপি দীর্ঘদিন ধরেই সংস্কার শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে আসছিল। বৈষম্যবিরোধী প্ল্যাটফর্ম থেকে গড়ে ওঠা এনসিপি একসময় রাজনীতির মাঠে কার্যত চালকের আসনে ছিল। জামায়াতে ইসলামীও নানা উপায়ে তাদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছিল।

সেই প্রেক্ষাপটে বিএনপি ছিল কিছুটা ধীরস্থির ভূমিকায়। মাঝেমধ্যে বিএনপির কিছু নেতা জামায়াত নেতাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ালেও, দলটি সামগ্রিকভাবে তেমন সক্রিয় ছিল না। তবে দলের চেয়ারপারসনের চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার পর বিএনপির সব স্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন করে উদ্দীপনা দেখা যায়।  

একই সময়ে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের শপথ নিয়ে বিলম্ব করায় মাঠে নামেন বিএনপি সমর্থকেরা। পরে আদালতের আদেশের মাধ্যমে সেই আন্দোলনে পূর্ণতা আসে। ফলে এখন রাজনীতির মাঠে এনসিপি-জামায়াতকে ছাপিয়ে অনেকটা সামনে চলে এসেছে বিএনপি।

এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি কয়েকটি দাবি উত্থাপন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে—অন্তর্বর্তী সরকারের যে উপদেষ্টারা ‘সরাসরি বা পরোক্ষভাবে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত’, তাদের অব্যাহতি, সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানকে অপসারণ এবং ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ গঠনের লক্ষ্যে অবিলম্বে একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি।

ইশরাক ফ্যাক্টর

২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়। তাতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র নির্বাচিত হন। নির্বাচন কমিশন ২ ফেব্রুয়ারি ভোটের ফলের গেজেট প্রকাশ করে। এরপর শপথ নিয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তাপস।

নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফল বাতিল চেয়ে ২০২০ সালের ৩ মার্চ মামলা করেন বিএনপি নেতা ইশরাক। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্ট মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের সব সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এরপর থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন অতিরিক্ত সচিব শাহজাহান মিয়া।

এর মধ্যে গত ২৭ মার্চ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০২০ সালের নির্বাচনে ফজলে নূর তাপসকে বিজয়ী ঘোষণার ফল বাতিল করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম।

আদালত ১০ দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেন। এ রায় পাওয়ার পর ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন।

এদিকে গেজেট প্রকাশের দিন ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ঘোষণা করে দেওয়া রায় ও ডিক্রির বিরুদ্ধে আপিল করতে আইনি নোটিশ দেন রফিকুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদ নামে দুই ব্যক্তি। নোটিশে গেজেট প্রকাশ এবং ইশরাককে শপথ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়।

পরে মামুনুর রশিদ গেজেটের বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। রিটে ২৭ মার্চের রায় এবং ২৭ এপ্রিলের গেজেট কেন বেআইনি হবে না এবং ইশরাক হোসেনের শপথ পরিচালনা থেকে বিরত রাখার নির্দেশনা কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারির আর্জি জানানো হয়। এ রুল বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় রায় ও গেজেটের কার্যক্রম স্থগিত চাওয়া হয়। এ অবস্থায় মন্ত্রণালয়ও শপথ পড়ানোর উদ্যোগ নেয়নি।

এদিকে ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানোর দাবিতে কয়েকদিন ধরে আন্দোলন করছিলেন তার সমর্থকেরা। টানা নগর ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে পরে বুধবার থেকে মৎস্য ভবন, কাকরাইল ও যমুনার সামনের রাস্তায় অবস্থান করছিলেন তারা। হাইকোর্টে সেই রিট খারিজ করে দিলে বৃহস্পতিবার বিকেলে অবশ্য ৪৮ ঘণ্টার জন্য আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করেন ইশরাক।

নির্বাচন নিয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্য

বুধবার সকালে সেনা কর্মকর্তাদের নিয়ে আয়োজিত এক সভায় (অফিসার্স অ্যাড্রেস) সেনাবাহিনী প্রধান এই দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য দেন। সেখানে শিগগিরই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।

চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের ব্যাপারে নিজের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) এ বিষয়ে কোনো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয়নি। পরে যোগাযোগ করা হলে আইএসপিআর কোনো মন্তব্য করবে না বলে জানায়।

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে মানবিক করিডোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে। এটি হতে হবে বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। করিডোরের ব্যাপারে জাতীয় স্বার্থ দেখতে হবে। রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার বিষয়ও এখানে যুক্ত।

মব ভায়োলেন্স, সাম্প্রতিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড বিষয়ে জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধান প্রতিবেদন, অন্তর্বর্তী সরকারের চলমান সংস্কারসহ নানা প্রশ্নের উত্তর দেন সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

বন্দর নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে জেনারেল ওয়াকার বলেন, এখানে স্থানীয় মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাদের মতামত প্রয়োজন হবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে। সংস্কার নিয়ে করা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কী সংস্কার হচ্ছে, কীভাবে হচ্ছে– এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।

কয়েকজন উপদেষ্টার অব্যাহতি চায় বিএনপি

‘অন্তর্বর্তী সরকারের যে উপদেষ্টারা একটি নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত’ তাদের অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। একইসঙ্গে সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানকেও অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে দলটি।  

বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন এসব দাবি জানান। গত বুধবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানাতে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে জনগণের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, মানবাধিকার এবং ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যত দ্রুত সম্ভব জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করাই এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তাই, আমরা একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছি।  

তিনি আরও বলেন, এই সর্বোচ্চ জনআকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানতম এজেন্ডা হওয়া উচিত বলে জনগণ মনে করে। এর অন্যথা হলে জনগণের দল হিসেবে বিএনপির পক্ষে এই সরকারের প্রতি সহযোগিতা অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

খন্দকার মোশাররফ হোসেন স্পষ্ট করে বলেন, বিষয়গুলো এই সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে, সেগুলো আমাদের আগের প্রস্তাব ও পরামর্শের মতো উপেক্ষিত হলে তা হবে দুর্ভাগ্যজনক। সেক্ষেত্রে অনিবার্যভাবেই বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে কি না, তা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হবে।

কেন সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে ‘সংশয়’ দেখছে বিএনপি

সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে ‘সংশয়’ তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘ফ্যাসিবাদী আওয়ামী দুঃশাসনের পতন হয়েছে, বিজয়ী হয়েছে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। কিন্তু গত সাড়ে নয় মাসে জনপ্রত্যাশা বা গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা কতটা পূরণ হয়েছে, তা একটি বিশাল প্রশ্নের সম্মুখীন। ’ 

‘ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। অথচ আগামী বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি এই ঐক্যকে বজায় রেখে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের কোনো বিকল্প নেই। এই ঐক্যের স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারকে সর্বোচ্চ নিরপেক্ষতার অবস্থান বজায় রাখার কথা ছিল। ’

‘কিন্তু লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে কোনো কোনো মহলের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করাই যেন সরকারের কর্মপরিকল্পনার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বক্তব্য আমরা বারবার উচ্চারণ করেছি। অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ডে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনমনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। ’

‘বিতর্কিত’ উপদেষ্টাদের সরানোর আহ্বান জানিয়ে খন্দকার মোশাররফ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে বিতর্কিত কয়েকজন উপদেষ্টা যাদের বক্তব্যে এবং কর্মকাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে, এমন বিতর্কিত উপদেষ্টাদের সরিয়ে দেওয়ার দাবি আমরা তুলেছিলাম।  

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের যে উপদেষ্টারা একটি নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত বলে সবাই জানে ও বুঝে; উপদেষ্টা পরিষদে তাদের উপস্থিতি সরকারের নির্দলীয় নিরপেক্ষ পরিচিতিকে ক্রমাগত প্রশ্নবিদ্ধ করে চলেছে বলেই সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাদের অব্যাহতি দেওয়া প্রয়োজন।  

তিনি আরও বলেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার বুধবারের বক্তব্য আবারও নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাকে অব্যাহতি প্রদান করতে হবে। ফ্যাসিবাদের দোসর কয়েকজন উপদেষ্টাকে সরিয়ে দেওয়ার দাবি আমরা আগে অনেকবার জানিয়েছি। যেহেতু, একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই এই সরকারের প্রধান কাজ, তাই মাথাভারী উপদেষ্টা পরিষদ না রেখে শুধুমাত্র রুটিন ওয়ার্ক (দৈনন্দিন কার্যক্রম) পরিচালনার জন্য একটি ছোট আকারের উপদেষ্টা পরিষদ রাখাই বাঞ্ছনীয়।

সরকারের একমাত্র ম্যান্ডেট সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন

অন্তর্বর্তী অস্থায়ী সরকারের একমাত্র ম্যান্ডেট হলো একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা—এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, অথচ সরকারের মুখপাত্র হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন যে, ‘এই সরকারের সবকিছু করার ম্যান্ডেট রয়েছে’।  

নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি বিব্রতকর উল্লেখ করে খন্দকার মোশাররফ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি ‘সংস্কার সনদ’ তৈরির প্রক্রিয়ার মধ্যেই আলাপ-আলোচনা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও একই বিষয়গুলো নিয়ে এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে একটি দলের নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি আমাদের এবং সরকারকে বিব্রত করে।

সার্চ কমিটির মাধ্যমে আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠিত হলেও একটি মহল নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন চায় এমনটি জানিয়ে তিনি বলেন, সরকার সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহ পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায় সব ক্ষেত্রে আমাদের মতামত না নিলেও নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে সব পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করে এই কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সংক্রান্ত বিষয়ে আদালতের রায় অনুযায়ী গেজেট নোটিফিকেশন করায় নির্বাচন কমিশনকে অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।  

তিনি বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্যই দেশের জনগণ রক্ত দিয়ে গণঅভ্যুত্থান করেছে, সুতরাং আমাদের আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ থাকতে হবে। আমরা আশা করব নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল এবং উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে অতি শিগগিরই সরকার ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে ইশরাক হোসেনের শপথের ব্যবস্থা নেবে।

বিব্রতকর পরিস্থিতির দায় পুরোটাই সরকারের উল্লেখ করে স্থায়ী কমিটির এই সদস্য আরও বলেন, দেখা যাচ্ছে, জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী সরকারের যা করণীয় তা যথাসময়ে না করে চাপের মুখে করার সংস্কৃতি ইতোমধ্যেই সরকারের সক্ষমতা ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছে এবং অন্যদেরও একই প্রক্রিয়ায় দাবি আদায়ের ন্যায্যতা দিয়েছে।

তিনি বলেন, এই অনভিপ্রেত ও বিব্রতকর পরিস্থিতির দায় পুরোটাই সরকারের বলে আমরা মনে করি। নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এমন বাস্তবতায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে নির্বাচন কমিশন ঘেরাও করার বিষয়টি উদ্দেশ্যমূলক ও রহস্যজনক।  

ইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।