ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

কলঙ্কমুক্ত হয়ে উঠুক বাংলাদেশ

ফারুক যোশী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৩, ২০১২
কলঙ্কমুক্ত হয়ে উঠুক বাংলাদেশ

ঢাকা: রাজাকারদের নেতা, একাত্তুরে পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার অকুতোভয় সৈনিক, লাখ লাখ মানুষের হত্যার সাখে যার নাম জড়িত, তিনি এখন বয়সের ভারে নুব্জ্য, কিন্তু পাপ তাকে কাবু করতে পারেনি, তাইতো পাপের পঙ্কিলতায় ডুবে থেকেও তার কোনও অনুতাপ নেই। নেই কোনও অনুভূতি।

পাপের অনুভূতিহীন সেই রাজাকারকে ধরতে লেগেছে রাষ্ট্রের চল্লিশটি বছর। কারণ এই রাষ্ট্র এদের জায়গা দিয়েছে। পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে এনেছে। নাগরিকত্ব হারানো গোলাম আযম পুনরায় নাগরিক হয়েছেন। কেননা তার রাজনৈতিক দর্শনের মানুষগুলো পৌনঃপুনিক এসেছে ক্ষমতায়। তারা ছড়ি ঘুরিয়েছে। তার দোসররা মন্ত্রী হয়েছে। বাংলাদেশকে না মানা মানুষগুলোই বিভিন্ন সময়ে খামছে ধরেছে জাতির পতাকা, কবির সেই শকুনের মতো। সেই নরঘাতক এখন হাজতবাস করছেন।
বাংলাদেশের মানুষের মনে স্বস্তি এসেছে। সবাই একবাক্যে স্বীকার করছেন সরকারের এ এক সফলতা, দীর্ঘদিন পরে হলেও। ঠিক পাশাপাশি জামায়াত-শিবির আবারও এ ইস্যু নিয়ে ফণা তোলার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে গোলাম আযমের ধরা পড়ার পর পরই বিভিন্ন জায়গায় এই পাঠানরা ভাংচুর করেছে। লিপ্ত হয়েছে সন্ত্রাস-ষড়যন্ত্রে। এমনিতেই জামায়াতিরা মনে করে, এখন তাদের দুর্দিন। জামায়াতের পালের গোদারা এখন বিচারের অপেক্ষায়। জামাতি দোসররা তাই মরিয়া হয়ে চালাবে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম।

জামাতিদের আজকের প্রজন্মের কাছে এই শশ্রুমণ্ডিত গোলামকে তারা মনে করে ফেরেশতাতুল্য মানুষ। আজকের জামাতি প্রজন্মের কাছে এভাবেই তোলে ধরা হয়েছে তাদের। অথচ তারা যেন বুঝতেই চায় না তারা যাকে ফেরেশতার সাথে তুলনা করে, এই মানুষটি লাখ লাখ মানুষ হত্যা করতে দেশের মানুষকে উৎসাহ যুগিয়েছেন, তিনিই সহায়তা করেছেন হাজার হাজার নারীকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দিতে।

অথচ আজকের জামাতি-প্রজন্ম মনে করে এই ফেরেশতাতুল্য (!?)মানুষটিকে ৮৯ বছর বয়সে কাঠগড়ায় তোলা মানে পাপ করা। এই পাপের সাথে যারা জড়িত,তাদের উৎখাতের জন্যেই তাদের সংগ্রাম চলবে।

সংগ্রাম মানে কী? সংগ্রাম মানে একাত্তুরের যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানো? যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানো মানে একাত্তুরের লাখ লাখ মানুষকে হত্যা, হাজার হাজার নারী-ধর্ষণকে বৈধতা দেওয়া। এই বৈধতা দিতে যারা সংগ্রাম নামের জ্বালাও-পোড়াও শুরু করেছে, পুলিশকে রক্তাক্ত করেছে, তারা আর যাই হোক মানবতার মিত্র হতে পারে না।

একাত্তুরের পরাজিত শক্তির সেই দোসরদের হাজারো কর্মী ছড়িয়ে আছে দেশ-বিদেশে। সত্যি কথা বলতে কী, ইউরোপ-আমেরিকায় এদের আছে একটি শক্ত ভিত। তাইতো বাংলাদশে যেমন অতর্কিতে পুলিশের উপর হামলা হয়েছে। ব্রিটেনেও সেই ধারা তারা বজায় রেখেছে। তবে দেশ বিবেচনা করে শান্তিপূর্ণভাবেই বিক্ষোভ করেছে ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে।

বাঁচাও বাংলাদেশ, ভয়েস এগেইন্স্ট অবসেশন, নাগরিক সমিতি,বাংলাদেশি সমিতি প্রভৃতি সুন্দর-বৈচিত্র্যপূর্ণ নাম নিয়ে তারা একই ছাতার নিচে গতকালই বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমাবেশ করেছে।

ম্যানচেস্টার হাইকিমশনসহ বিভিন্ন হাইকমিশনে তারা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে। ম্যানচেস্টার হাইকমিশনের সামনে এমনকি আযম সাহেবের উপস্থিত চার ছেলের মাঝে একজন বক্তৃতাও দিয়েছেন । সহানুভূতি পাবার চেষ্টা চলেছে। এগুলো বিভিন্নভাবে প্রচার-প্রচারণায় আসবে কিংবা আসছে।

একাত্তুরে যুদ্ধ হয়েছে স্বাধীনতার যুদ্ধ। এই যুদ্ধে রাজাকার আলবদর ছাড়া সবাই ছিলো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। আপামর মানুষের পক্ষাবলম্বনই শেষপর্যন্ত ছিনিয়ে এনেছিলো বিজয়, বাংলাদেশের। কিন্তু ওই আযমেরা এর বিপরীতে ছিলো। তাদের দর্শন ছিলো অন্যখানে, এক অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্ন ছিলো তাদের। আর সেজন্যই না-কি পাকিস্তানের পক্ষে থাকা ছিলো তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

একজন রাজনীতিক কিংবা একটি দল তার নিজস্ব মত-পথ দিতেই পারে। গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এ দাবিটুকু তার আছে। কিন্তু একটি দেশের জন্যে যখন যুদ্ধ বাঁধে, নির্যাতন চলতে থাকে, খুন-ধর্ষণ চলতে থাকে, তখন ওই খুন-ধর্ষণকে যারা সমর্থন করে এবং এমনকি খুন-ধর্ষণকে জায়েজ বলে একে উৎসাহিত করে, তখন এদের খুনিই বলতে হয়। এবং আজকের নব্য জামাতিরা যে এই খুন-ধর্ষণকে আজও নীতি আর আদর্শের যুদ্ধ হিসেবে বিচেনা করে, তার একটি উদাহরণ দিতে পারি আমার পরিচিত এক জামাতির কাছ থেকে।

তার কথায়ই জেনেছি জামাতিদের কথা। একাত্তুরের খুন-ধর্ষণের ব্যাপারটাকে তারা মনে করে যুদ্ধের এক অনিবার্যতা। এই অনিবার্যতার কথা শুনে তখন শুধু তাকে বলেছিলাম, আর কিছুর প্রয়োজন নেই শুধু আপনি আপনার অবস্থানে দাঁড়িয়ে একটি বার চিন্তা করুন, আপনার বোন কিংবা আপনার স্ত্রী কিংবা আপনার মা---তারপর বলেন এটা যুদ্ধের অনিবার্যতা।

কথাটি শুনে জামাতি লোকটা কেবল কয়েক মুহূর্ত অপলক চেয়েছিল আমার দিকে। তারপর দৃষ্টি মাটিতে নামিয়ে নিজের কাজে লেগে গিয়েছিলো।

তাই যারা আজও খুন-ধর্ষণকে যুদ্ধের অনিবার্যতা হিসেবে মনে করে, যারা আজও একাত্তুরের গণহত্যার জন্য এতটুকুও অনুতপ্ত হয় না, তাদের অন্তত বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলা মানায় না। রাজনীতি করা তো দূরের ব্যাপার।

গোলাম আযম, মইত্যা রাজাকার, সাকা চৌধুরী, সাঈদী, মোজাহিদরা আটকা পড়েছেন। একাত্তুরের চেতনায় হৃদ্ধ বাংলাদেশের মানুষ খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে করছেন, এদের বিচার হতেই হবে। কিন্তু এ বিচার নিয়েও যেন মানুষের শঙ্কা প্রতিদিন।

সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণের নাম নিয়ে গত ক‘দিন যেভাবে কিংবা যেসব সাক্ষীদের হাজির করা হয়েছে, তাতে বিচার প্রক্রিয়া কি ত্বরান্বিত হবে? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্যে গঠিত ট্রাইবুনাল বিচক্ষণতার সাথে না এগুলে প্রামাণ-পত্র অনেক কিছুই হয়তো জনসমক্ষে আসবে না। কারণ চল্লিশ বছর আগের অনেক মানুষই আজ আর নেই।

আর তাই সেখানে এ সময়ে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের মতোও ওই ঘাতকদের দাঁড় করানো যেতে পারে কাঠগড়ায়। যারা মানুষ খুন করেছে,বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা করেছে, ওই তারা অর্থাৎ আযম-মইত্যা-সাঈদীরা সেসময় এমনকি তাদের পত্রিকা সংগ্রামে যেসব বিবৃতি-বক্তৃতা দিয়েছে সেগুলোই হয়ে উঠুক আজকের প্রধান প্রমাণ-পত্র।

মনে রাখতে হবে, ন্যুরেমবার্গ ট্র্যায়ালেও নাৎসী বাহিনীর হাজার হাজার বক্তৃতা বিৃবতি প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছিলো। গোলাম আযমকে গ্রেফতার করতে সরকারের লেগেছে তিনটি বছর। এখন বিচার করতে লাগবে কত দিন- এ প্রশ্ন আছে মানুষের।

জামাতিরা মনে করে তাদের কিছুই হবে না। আন্তর্জাতিক লবিস্ট গ্রুপ করেছে তারা। শত শত কোটি টাকা তারা ফান্ড কালেকশনে ব্যস্ত। কিন্তু এ সময়ে বিদেশে অবস্থানরত সরকারি দলের কর্মী-সমর্থকরা নিজেদের মাঝে সভা-সমাবেশ করছেন। আর সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইছে। এ যেন সরকারের কাছে সরকারের বিচার চাওয়া। যা হাস্যকর।

তারা ভালো করে একটা লিফলেট পর্যন্ত প্রচার করতে পারছে না, জনমত তৈরির কোনও উদ্যোগই নেই। শোনা গিয়েছিলো তারাও ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে এমপি-মন্ত্রীদের সাথে বৈঠক করবে। মৌলবাদী রাজাকারদের বিচারের যৌক্তিকতা তুলে ধরবে। কিন্ত সে কাজ হচ্ছে না। অথচ দ্রুতগতিতে ঠিকই সেই পরাজিত শক্তি তাদের অর্থ দিয়েই লবিষ্ট নিয়োগ করে কাজ চালাচ্ছে।

চল্লিশটি বছর পর যে সুযোগ এসেছে এ সুযোগ ছেড়ে দেওয়া মানে পায়ের নিচ থেকে ব্যাঙের বিদায়। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, সরকার যে সাহসিকতার স্বাক্ষর রেখেছে, সেই সাহসিকতার সাথী হবে দেশের মানুষ-বিদেশের বাঙালিরা। দীর্ঘ চল্লিশটি বছর ধরে জাতির উপর চেপে থাকা জগদ্দল পাথর যেন সরে যায়। দায়মুক্ত হয় যেন বাঙালি জাতি। কলংকমুক্ত হয়ে উঠুক বাংলাদেশ এই প্রত্যাশায়।

লেখক:যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক

[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।