দেশ এখন গভীর সংকটে। দেশ পরিচালনায় রাজনীতিবিদদের যে বিকল্প নেই, সেই সত্যটি আবারও প্রমাণিত হয়েছে গত ১৪ মাসে।
জুলাই গণ অভ্যুত্থান ছিল স্বাধীনতার পর সবচেয়ে মহত্তম অর্জন। কিন্তু এ অর্জন এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ এ অভ্যুত্থানের পর দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। লাখ লাখ শ্রমিক হয়ে গেছেন বেকার। জীবিকা হারিয়ে হতাশায় ভুগছেন তারা। বলা হয়ে থাকে রাজনীতির প্রাণ হলো অর্থনীতি। দেশের অর্থনীতি দুর্বিপাকে থাকায় জুলাই গণ অভ্যুত্থানের চেতনা নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছে জনমনে। ক্ষুধাতুর মানুষের কাছে তা কোনো অবদান রাখতে পারছে না। এর প্রধান কারণ জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পর যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারা ব্যবসায়ীদের শত্রু ভাবার ভ্রান্তিতে ভুগে তাদের হেনস্তা করাকে নিজেদের অর্জন বলে ভাবছে। পরিণতিতে মানুষ বলতে শুরু করেছে, আগেই তারা ভালো ছিল। ব্যবসায়ীদের ওপর চড়াও হওয়ার অপনীতির সমালোচনা করা হয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, ঢালাওভাবে ব্যবসায়ীদের ব্যাংক হিসাব জব্দ রাখা ঠিক নয়। বড় ধরনের বিচ্যুতি না থাকলে ব্যবসায়ীদের জব্দ হিসাবগুলো খুলে দেওয়া যায়। তা না হলে সার্বিক ব্যবসাবাণিজ্য, দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানের ওপর বিরাট প্রভাব পড়বে। ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি আয়োজিত ছায়াসংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় তিনি আরও বলেন, গত এক বছরে অর্থনীতির কিছু সূচকের পতন ঠেকানো গেলেও সংকট কাটেনি এবং দারিদ্র্যও কমেনি। ব্যাংকিং খাতে বিগত সরকারের সময় সুশাসন ছিল না। অর্থনীতির আকারের চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক বেশি ব্যাংক অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল, যা পৃথিবীর কোথাও নেই। অর্থনীতি ও রাজনীতি পাশাপাশি চলে। একটি অন্যের পরিপূরক। দুর্বল শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থনীতি চলতে পারে না। সঠিক রাজনীতি ছাড়া সঠিক অর্থনীতি হয় না। স্বল্পমেয়াদি সরকার দীর্ঘায়িত হওয়া অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। এতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাধাগ্রস্ত হয়। তাই আর্থিক খাতের শৃঙ্খলার জন্য প্রয়োজন দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকার। সিপিডির নির্বাহী পরিচালকের বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের সুফল পেতে ব্যবসাবান্ধব কর্মকাণ্ডে সরকারকে জোর দিতে হবে। মানুষের জীবনজীবিকার পথ প্রশস্ত করতে হবে নিজেদের সুনামের স্বার্থেই।
বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ২০২৪ সালের তুলনায় চলতি বছর শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ বেড়ে ২১ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক সর্বশেষ প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, এটি করোনাভাইরাস বা কভিড-পরবর্তী চার বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দারিদ্র্যের হার। বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার নব্বই-পরবর্তী বছরগুলোতে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছিল। বিগত সরকারের আমলের শেষ দুই বছরে দারিদ্র্যের আর হ্রাসের বদলে বেড়ে যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও এ ক্ষেত্রে পেছন পানে হাঁটার প্রবণতা দুর্ভাগ্যজনক। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে নেমে ৫৮ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ প্রায় ৩০ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে, যার মধ্যে প্রায় ২৪ লাখই নারী। ফলে কর্মসংস্থান ও কর্মক্ষম জনসংখ্যার অনুপাত ২ দশমিক ১ শতাংশ কমে ৫৬ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ, ২০২৩ সালে ১৯ দশমিক ২ এবং ২০২২ সালে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে সংস্থাটির মতে, পরিকল্পিত অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন, ব্যাংক খাত পুনর্গঠন, বিনিয়োগ সম্প্রসারণ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বজায় রাখা গেলে ২০২৬-২৭ সালে অর্থনীতি স্থিতিশীল হয়ে দারিদ্র্য কমবে অর্থাৎ দেশে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দরিদ্র বাড়ার স্রোত থেমে যাবে। যা একটি আশাপ্রদ দিক। এর আগে দেশে দারিদ্র্য বৃদ্ধির তথ্য জানিয়েছিল বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসি ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। বিবিএসের হিসাবে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৯ দশমিক ২ শতাংশ এবং ২০২২ সালে তা ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে পিপিআরসির সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৫ সালে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশে এবং অতিদারিদ্র্যের হার ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশে পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ণে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও প্রকৃত মজুরি হ্রাসের কারণে পরিবারগুলো মারাত্মক চাপে পড়েছে। ২০২৫ অর্থবছরে স্বল্প আয়ের শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি ২ শতাংশ কমেছে। তবে নীতিগত সংস্কার কার্যকর হলে ২০২৬ সালে দারিদ্র্য ১৯ দশমিক ১ শতাংশ ও ২০২৭ সালে ১৮ দশমিক ১ শতাংশে নামার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবেদনে আারও বলা হয়, চলতি বছর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এলে ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লে বেসরকারি খাতের ভোগ ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে, এ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া অত্যন্ত নাজুক এবং এর সাফল্য সংস্কার বাস্তবায়ন, ব্যাংক খাত পুনর্গঠন ও অনুকূল অর্থনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখা এ তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষজ্ঞরা বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র্য বৃদ্ধির তথ্যকে যৌক্তিক বলে মনে করছেন। তাদের মতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান না বাড়ায় দারিদ্র্য বাড়ছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পেছনে শিক্ষিত বেকারত্বের হার বৃদ্ধির ঘটনা ছাত্রসমাজকে রাজপথে নামতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৪ মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত ছিল তাদের সংস্কার কার্যক্রমে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার দেওয়া। কিন্তু তারা ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণের বদলে ব্যবসায়ীদের প্রতিপক্ষ ভেবে দেশের অর্থনীতির জন্য বিপদ ডেকে এনেছেন। দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণে অন্তর্বর্তী সরকার যে ব্যর্থতার পরিচয়ই দিয়েছে তা তাদের ইমেজ ক্ষুণ্ন করেছে। গত ১৪ মাসে দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো সংস্কারই হয়নি। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের রোডম্যাপ দেওয়া হলেও সরকারের ভিতরে-বাইরে চলছে নানা ষড়যন্ত্র। ।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. ফ্রানজিস্কা ওনসর্জ বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিকে রূপান্তর করতে উন্মুক্ত বাণিজ্য ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশে নীতিগত সংস্কারের মাধ্যমে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানো সম্ভব। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল বিএনপি আমলে। শহীদ জিয়া উৎপাদনের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। কৃষি, শিল্প সব ক্ষেত্রে তিনি ইতিবাচক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছেন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আমলে বাজার অর্থনীতির পথে চলা শুরু করে বাংলাদেশ। ২০০৬ সালে সেনাসমর্থিত ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আমলে দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে মার খায়। আওয়ামী লীগের দেড় দশকে অর্থনীতিতে গতি সৃষ্টি হলেও দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও দুঃশাসনের কারণে তা ধরে রাখা যায়নি। ফেব্রুয়ারিতে যে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসছে, তাকে অর্থনীতিবান্ধব রাজনীতি অনুসরণে যত্নবান হতে হবে।
লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসুর জিএস