ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে অন্যায় ধর্মযুদ্ধ

অধ্যাপক ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১০ ঘণ্টা, আগস্ট ৮, ২০২০
রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে অন্যায় ধর্মযুদ্ধ

ধর্ম যখন শাসন-শোষণ ও শাসানোর নিয়ামক হয়, তখন ধর্ম আর ধর্ম থাকে না, ধর্ম হয়ে ওঠে অধর্ম। ধর্মের নামে দেশে দেশে শাসন-শোষণ ও শাসানো চলছে।

সবসময়ই চলেছে, এখনও চলছে। বিষয়টি বোঝানোর জন্য আগের যুগের উদাহরণ টানা যাক। একটি ধ্বংসপ্রায় হিন্দু জমিদার বাড়ির স্থাপত্যকাঠামো লক্ষ্য করলে বিষয়টি সহজেই বোঝা যাবে। একটি জমিদার বাড়িতে থাকতো একটি পূজামণ্ডপ, তার পাশে কাছারি অর্থাৎ প্রশাসনিক ভবন, তার পাশে আবার রঙ্গমহল, ওই রঙ্গমহলে থাকতো জমিদারদের মনোরঞ্জনের জন্য অপ্সরাসম সুন্দরী শিল্পীগণ। আবার এর অনতিদূরে ছিলো জমিদারদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের জন্য নির্যাতন কক্ষ, যেখানে থাকতো অন্ধকার গভীর কূপ, যেখানে প্রতিবাদী প্রজাদেরকে ছুঁড়ে ফেলে গুম করা হতো। অর্থাৎ জমিদার বাড়িতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অবস্থান থেকে সহজেই অনুমেয় যে, একজন জমিদার কেনো জমিদার ছিলো।  

অর্থাৎ একটি জমিদারতন্ত্র চলতো ধর্মের সঙ্গে অধর্মের মিশেলে। সমস্ত অপকর্মকে ঢাকার জন্য প্রয়োজন ছিলো পূজা-অর্চনা, যেখানে জমিদার ও তার সহযোগীগণ পাপ মোচন ও আশীর্বাদ প্রাপ্তির জন্য দেবতার আরাধনা করতো। এখানে পূজা উৎসব আয়োজন করা হতো, যেখানে পূজার কেন্দ্রবিন্দু ভগবান হলো সবার জন্য সমান। সমস্ত অধর্মকে ফাঁকি দিতে প্রয়োজনীয় ধর্মের আবহ সৃষ্টিতে প্রয়োজন ছিলো এই পূজার।  

মুসলমান জমিদারদের বাড়িতেও ধর্ম-অধর্মের মিশেলটি ছিলো অনুরূপ। কিন্তু এখানে ধর্মপ্রতিষ্ঠানটি ছিলো শুধু ভিন্ন। দেবতার মন্দিরের জায়গায় ছিলো আল্লাহর মসজিদ। রাজা-বাদশাদের প্রাসাদেও ছিলো একই আবহ, যার দ্যুতি রাজ-রাজাদের রাজধানী ছাড়িয়ে অন্যত্র ছড়িয়ে পড়তো।  

কিন্তু যেখানে ধর্ম শাসন-শোষণ ও শাসানোর নিয়ামক হয়, সেখানে শাসকদলের কাছে অধর্মও ধর্ম হয়ে ওঠে। কারণ এই অধর্মের তখন থাকে আইনগত ও ধর্মীয় রক্ষাকবচ। জয় শ্রীরাম অথবা আল্লাহু আকবার ধ্বনি যেখানে প্রতিপক্ষকে খতমের শক্তি যোগায়, সেখানে আইন, শাসন ও বিচার সব অন্ধ হয়ে পড়ে। ধর্মের মোড়কে অধর্ম তখন মসজিদ ভেঙে মন্দির অথবা গীর্জা ভেঙে মসজিদ গড়ার সাহস ও শক্তি যোগায়।

অধর্মের সাথে ধর্মের মিশেলের আরও লাভ আছে। সে লাভের কোনোটা ব্যক্তি পর্যায়ের, কোনোটা পরিবারিক পর্যায়ের আবার কোনোটা দলীয় পর্যায়ের। অধর্মের সাথে ধর্ম মিশেল দিয়ে প্রতিপক্ষের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি তছনছ করে দিলেও, দেবতা আশীর্বাদ করেন আর শাসক-প্রশাসকগণ সমীহ করেন। ফল হয় ভালো। প্রতিপক্ষের ব্যবসাটা নিজের ব্যবসা হয়ে যায়। এ যেনো লাভের ওপর লাভ। রাম বা হনুমান ধর্মের ঢাল, অন্তরালে অধর্মের সাথে ধর্মের মিশ্রণ। এতো ধর্মের নামে শাসন-শোষণ আর শাসানো ছাড়া আর কী? আর যখন বিখ্যাত বাবরী মসজিদটি জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে গুঁড়িয়ে যায়, তখন মুসলমানদের ওপর অধর্ম-ধর্মের মিশেলে একটি বড়ো সৌধ স্থাপিত হয়। যে সৌধটি স্বতঃ জয় শ্রীরাম ধ্বনি ঘোষণা করে যে, গেরুয়া শক্তির জয় হয়েছে! গেরুয়া শক্তি থেকে সাবধান!

গেরুয়া শক্তির শ্রীরাম স্লোগানের বিপরীতে রয়েছে, আল্লাহু আকবার ধ্বনি। এই ধ্বনি জিহাদের শক্তি যোগায়। এই ধ্বনিকে বুকে ধারণ করে দক্ষিণ এশিয়া ও ইউরোপের নানা দেশে চলছে জিহাদ। উলামাদের যুক্তি হলো- এই জিহাদে ইসলামের সমর্থন নেই। ইসলামকে ব্যবহার করে জিহাদের পথে ঠেলে দেওয়া হয়েছে কেবল। অর্থাৎ উলামাদের মতে অধর্মের সাথে ধর্মের মিশেলের ফলেই কেবল এই মেকি জিহাদী জোশ সৃষ্টি হয়েছে। আমারও তাই মনে হয়। তা না হলে বছর কয়েক আগে হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টে যে জিহাদী হামলা হয়, তার লক্ষ্যবস্তু ছিলো- জাপানি আর ইতালীয়গণ। প্রকৃত জিহাদের লক্ষ্য কেনো বিদেশি ব্যবসায়ী হত্যা হতে পারে না- এ বিষয়টি সহজেই অনুমেয়। কিন্তু বাস্তবে এখন এই রকম জিহাদই হচ্ছে।  

খোলাফায়ে রাশেদীনের পরবর্তী যুগে মুসলমান রাজশক্তিগুলো আরব বিশ্বসহ নানা দেশে যে সাম্রাজ্য সৃষ্টি করে, তার মর্মমূলে অধর্মের সাথে ধর্মের মিশ্রণজাত জিহাদী জোশ ছিলো। কারণ, খোলাফায়ে রাশেদীন যুগ ও খোলাফায়ে রাশেদীনত্তোর যুগের ইতিহাসের প্রধান পার্থক্য হলো- পূর্ববর্তী যুগটি ছিলো ইসলামের ইতিহাসের যুগ আর পরবর্তী যুগটি মুসলমানদের ইতিহাস যুগ। মুসলমানদের ইতিহাস যুগে অধর্মের সাথে ধর্মের মিশেল হয়েছে প্রচুর। এই অধর্মের সাথে ধর্মের মিশেলে তুর্কীগণ ইউরোপ-এশিয়ার প্রায় সমস্ত ভূখণ্ড দখল করে, সেখানে বিশাল সাম্রাজ্য স্হাপন করে। ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কীদের কনস্টান্টিনোপল বিজয় ঘটেছিলো অধর্মের সাথে ধর্মের মিশেলের ফলে। তুর্কীগণ তখন কনস্টান্টিনোপলে অবস্থিত আয়া সোফিয়া নামক খ্রীস্টানদের একটি গীর্জাকে মসজিদে রূপান্তর করে। তুর্কী মুসলমানদের কনস্টান্টিনোপল বিজয় ও আয়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের বিষয়টি ছিলো মুসলমানদের জন্য একটি গৌরবের বিষয়, অপরপক্ষে খ্রিস্টানদের জন্য ছিলো এটি অপমানজনক। ইউরোপীয় খ্রীস্টানগণ কনস্টান্টিনোপল পরাজয়ের অপমানের জবাব দিয়েছিলো- ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের স্পেনে প্রতিষ্ঠিত সাতশত বছর স্থায়ী মুসলমান রাজশক্তির পতন ও কর্ডোভায় অবস্থিত মুসলমানদের মসজিদ দখলের মাধ্যমে।

এই উপমহাদেশে অধর্ম-ধর্মের এ মিশেল যেমন দিয়েছে সুলতানগণ, তেমনি দিয়েছে মুঘল বাদশাহগণ। কারণ মধ্য এশিয়া বা পশ্চিম এশিয়া থেকে যারা এ দেশে শাসন করতে এসেছিলো, তারা এ ধরণের মিশেলের রাজনীতির শিকার হয়েছিলো। তারা এ দেশে আগমনের পূর্বে তুর্কী ও মোঙ্গল শক্তির কাছে নিজেদের বাড়ী-ঘর, বাজার-ঘাট ও শহর-বন্দর হারিয়ে বড় তিক্ত অভিজ্ঞতা বহন করে এ দেশে এসেছিলো। বাবর এদেশে এসেছিলেন-সুদূর উজবেকিস্তান থেকে। তিনি তার দেশে ছেড়েছিলেন প্রতিপক্ষের নিকট তার ভিটে-মাটি হারিয়ে। কাজেই এই উপমহাদেশে মোগলগণ যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলো, তা ছিলো মুসলমানদের ইতিহাস, প্রকৃত ইসলামের ইতিহাস নয়।

বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া থেকে মধ্য এশিয়া, মধ্য এশিয়া থেকে পশ্চিম এশিয়া জুড়ে সর্বত্র চলছে ধর্মান্ধদের ধর্মযুদ্ধ। এই ধর্মযুদ্ধে অধর্মের সাথে ধর্মের মিশেল দিচ্ছে ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তিসমূহ। কিন্তু এই মিশেল দিয়েছে ও দিচ্ছে কেবল রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য। বর্তমানে এই উপমহাদেশে ধর্মযুদ্ধ চলছে। কিন্তু এ ধর্মযুদ্ধ কোনো আদর্শিক যুদ্ধ নয়। বরং ধর্মের নামে অধর্মের যুদ্ধ। এই অধর্মের যুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার সর্বত্র অধর্ম-ধর্মের মিশেলের অন্যায় যুদ্ধকে কেবলই প্রলম্বিত করবে।

লেখক: জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।