ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বাতিঘর কবীর চৌধুরী

ফকির ইলিয়াস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১১
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বাতিঘর কবীর চৌধুরী

জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী চলে গেলেন। ৪০তম শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আগের দিনই তিনি চলে গেলেন এই পৃথিবী থেকে।

বাংলাদেশের মাহান মুক্তিসংগ্রামে তিনি ভাই হারিয়েছিলেন। শহীদ মুনীর চৌধুরী। বলেছিলেন, ভাইয়ের অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করতে চাই। সেই চেতনায় কাজ করেছিলেনও। তাঁর আরেক ভাই প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। ছোটবোন ফেরদৌসী মজুমদার।

এই জাতির জন্য কী করেননি কবীর চৌধুরী। জাতির জনক তাঁকে শিক্ষা সচিব করেছিলেন। তাঁর প্রধান কাজটি ছিল সমাজের সংস্কার। কী চাইতেন তিনি ?

তার চাওয়া ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশে মৌলবাদ- জঙ্গীবাদ থাকবে না। আর এই কারণেই তাঁর শত্রুর সংখ্যা ছিল অনেক। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কীভাবে মানুষের জয় হবে? হেসে বলেছিলেন, যখন মানুষ জয় করার বিদ্যা শিখবে। বলেছিলাম, কী সেই বিদ্যা ! বলেছিলেন, জেগে ওঠার প্রত্যয়।
 
এই প্রত্যয় নিয়ে কী প্রজন্ম এগোতে পারছে ? প্রশ্নটি আমি বার বার করি নিজেকেই । যদি না পারে, কেন পারছে না?

এইতো সেই প্রজন্ম যারা ২০০৮ সালে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে আওয়ামী
মহাজোটকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। এই মহাজোট গেল তিনবছরে মাত্র ছ`জন
যুদ্ধাপরাধীকে গ্রেফতার করেছে। বিচার শুরু করেছে মাত্র একজনের। এর
কারণ কী ?

১৩ ডিসেম্বর ২০১১ মঙ্গলবার জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী চিরবিদায় নিলেন। ঐ একই দিনই বিভিন্ন চ্যানেলে কুখ্যাত ঘাতক গোলাম আজমের একটি সাক্ষাতকার দেখেছে দেশ-বিদেশের কোটি বাঙালি।

এই সাক্ষাতকার নিতে বেশ কিছু তরুণ সাংবাদিক বন্ধুকে গোলাম আজমের সামনে বসে থাকতে দেখলাম। তারা বেশ কিছু প্রশ্নও করেছেন।

গোলাম আজম এক প্রশ্নের জবাবে বলেছে, আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারবে না এই সরকার। গো. আজম আরও বলেছে, এতোদিন পর বিচারের চেষ্টা কেন ? এই আওয়ামী লীগ সরকার তো আগেও ক্ষমতায় ছিল।
আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমার কোনো সাংবাদিক বন্ধু এর জোর প্রতিবাদ করলেন না। তারা বললেন না, এখনও নাৎসীদের বিচার হচ্ছে।

আরও বহুদিন পর্যন্ত হবে। অপরাধীর বিচারের কোনো সময় সীমা নেই। থাকতে পারে না। দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চালু আছে। অনন্তকাল থাকবে। বাংলাদেশ অন্য কোনো গ্রহের দেশ নয়।
 
না, আমার সাংবাদিক বন্ধুদের মাঝে তেমন জোরালো কোনো প্রতিবাদ দেখলাম না। কেন দেখলাম না। এই প্রজন্ম তো শহীদ রফিক-জব্বার- বরকত-সালাম, সেলিম-জাহিদ-দেলওয়ার-নূর হোসেন- বসুনিয়ার উত্তরাধিকারি। তারা সেই ঋণ শোধে রুখে দাঁড়ালেন না কেন ? কন্ঠের শক্তি দিয়ে প্রতিবাদ করলেন না কেন ? মনে রাখা দরকার, শুধু পেশাগত দায়িত্বই সামাজ বিনির্মাণ ও সত্য প্রতিষ্টার একমাত্র শক্তি নয়। কথামালার ব্যাপৃতি ঘটিয়ে, বুদ্ধিবৃত্তির মাধ্যমে সত্য বের করে আনাও একটি অন্যতম কর্তব্য।

কবীর চৌধুরী সেই চেতনা জাগাতে চেয়েছিলেন প্রজন্মের মাঝে। তিনি জীবনের গোটা সময়ই কাজে কাটিয়েছেন। বলেছেন, সৃষ্টির ধারা থেমে থাকতে পারে না। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দোরগোড়ায় অনুবাদের মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। কই, যারা তথাকথিত `তমদ্দুনপন্থী সাহিত্য মজলিশের` নীতি নির্ধারক, এরা কেউতো এই মহান কাজটি করতে এগিয়ে  আসেন নি।

এইতো মাত্র এক সপ্তাহ আগে কবি শহীদ কাদরী এক আড্ডায় বাংলাদেশের এক বিশিষ্ট  ভাষাদক্ষ ,পন্ডিত ব্যক্তিত্বের নাম ধরে বললেন,  `আর যাই বলো তিনি তো কবিতা বুঝতেন না। `

হাঁ, এটাই নিয়ম। কবিতার প্রতি দরদ না থাকলে কবিতার সমঝদার হওয়া যায় না, যাবে না। পাক তমদ্দুন পন্থী সেইসব `সাহিত্যিক`রা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে মনে প্রাণে ভালোবাসে না। আর ভালোবাসে না বলেই ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ আমাদের বুদ্ধিজীবীদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।

সেই হায়েনা আশরাফুজ্জামান খান এখন আমেরিকায়, খান মঈনুদ্দীন ইংল্যান্ডে এখনও বহাল তবিয়তে আছে।

আজ মহান শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। না , গোলাম আজমকে এখনও গ্রেফতার করা হয়নি। কেন হয় নি ?
 
``আর কত মৃত্যু হলে নগরে ঘোষিত হবে মহামারী,
আর কত ভাঙন এলে আমরা তাকে বলবো মহাপ্রলয় !
আর কত শিশু রক্তাক্ত হলে আমরা তাকাবো
খোলা আকাশের দিকে। কিংবা আর কত নারী ধর্ষিতা
হলে আমরা খুঁজবো আততায়ী হায়েনার নখ !``
 
কবিতার এমন পংক্তি অনেক আগেই লিখেছি। কবিতা আমাদের সমাজের
উঁচু শ্রেণীকে কী ভাবিত করে ?

আমাদের প্রধানমন্ত্রী, অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর শবদেহ দেখতে গিয়েছিলেন। কবীর চৌধুরীর স্বপ্ন ছিল কুলাঙার গো. আজমের বিচার দেখে যাবেন। পারেন নি। আবারও বিনীত অনুরোধ করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী-

আপনি যদি সত্যি কবীর চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হন, তবে তাঁর স্বপ্নটির বাস্তবায়ন করুন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের অসমাপ্ত কাজটির ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করুন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
 
নিউইয়র্ক / ১৪ ডিসেম্বর ২০১১

email- [email protected]   

বাংলাদেশ সময় ১৪১৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।