ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কান্না

আপেল মাহমুদ, সাইফুল্লাহ ইবনে আহমেদ<br>মাহফুজুর রহমান, আরিফুল আরেফিন পেপো ও সরোজ মেহেদী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ৩, ২০১১
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কান্না

বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে কত কষ্টই না করেছি। রাত দিন খেয়ে না খয়ে পড়া।

তবু শঙ্কা ছিল চান্স না পাওয়ার ... না, বিমুখ করেনি জগন্নাথ, নিজের বুকে চির আপন করে নেয় আমাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আনন্দে কী যে উন্মাদনা তা ‌এক সাগর কলমের কালিতে লিখে বোঝানোর মত নয় । ভর্তি হওয়ার পর দেখলাম জগন্নাথের চারদিকে শুধু না‌ইয়ের ফিরিস্তি । শুধু নাই আর নাই। তবু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় । যার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের ভাঙ্গা গড়ার স্মৃতি।

আমাদের ক্লাস করার জন্য নির্দিষ্ট কোনও শ্রেণীকক্ষ নেই,  শ্রেণীকক্ষ সংকট এখন চরম আকার নিয়েছে । কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে নির্বিকার ।   গত দুয়েক বছর ধরে তারা বলে আসছে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ক্লাস সমস্যার সমাধান হবে ।

নতুন ভবনের ৬ তলায় ১ রুমের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরী । যেন দু:সহ বেদনা নিয়ে দাঁড়িয়ে । শিক্ষার্থীদের , সমব্যথী অসহায় গ্রন্থাগার । তেমন কিছু নেই তার মধ্যে । তাক গুলো প্রায় ফাঁকা । যেসব তাকে বই আছে সেগুলোও তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় । বিদ্যুৎ চলে গেলে অন্ধকারে বসে থাকতে হয় । নেই জেনারেটর এর ব্যবস্হা । লাইব্রেরি রুমটিতে বড়জোর ৩০/৩৫ জন একসাথে বসে পড়তে পারে । তাই প্রতিদিন দুপুরে পড়তে এসে ফিরে যায় অনেক শিক্ষার্থী । লাইব্রেরীতে কোনও ফিল্টার নেই । নেই ফটোকপি মেশিন । এক্ষেত্রে বলে রাখা ভাল পুরো জগন্নাথ জুড়ে চলছে বিশুদ্ধ পানির হাহাকার । ছেলেরা মেস থেকে পানি খেয়ে আসে আবার মেসে গিয়ে খায় । বারবার কর্তৃপক্ষকে পানির সমস্যার কথা জানালেও কোনও লাভ হয় না । জবির রেফারেন্স রুমের অবস্হা সব থেকে করুণ । ভিসি এসব সমস্যার সমাধানে পূর্বাপর এত বেশি আশ্বাস শুনিয়েছেন যে, এসব আশ্বাস এখন হাসি নয় ,  প্রহসনে পরিণত হয়েছে ।

অনেক ডিপার্টমেন্টের সেমিনার কক্ষ নেই । অধিকাংশ ডিপার্টমেন্ট তাদের জন্য বরাদ্ধ অফিস রুমের এক কোনা সেমিনার কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করছে । কয়েকজন শিক্ষার্থীর বসতে কষ্ট হয় এসব রুমে। বড় জোর ৮ কী ১০ জন বসা যায় । অথচ একটি ব্যাচেই শিক্ষার্থী সংখ্যা সর্বনিম্ন ৫০ জন ।   কোনও বিষয়ে অভিযোগ করতে গেলে শিক্ষার্থীদের উল্টা রোষানলে পড়তে হয়।                                           

আমরা কোথায় পড়ব কিভাবে পড়ব জিঙ্জ্ঞাসা করলে শিক্ষকদের সোজা উত্তর  ভর্তি হয়েছ কেন নতুন ডিপার্টমেন্টে , তোমাদেরতো আমরা ডেকে আনিনি। ভাল না লাগলে চলে যাও। দরজা খোলা । আর থাকতে চাইলে এভাবেই মুখ বন্ধ করে থাকতে হবে। পড়াশুনার পরিবেশ নিয়ে কিছু বলতে পারবে না । কিন্তু আর কতদিন ? 

জগন্নাথের প্রতিটি বিভাগে চলছে শিক্ষক সংকট । যো্গ্য শিক্ষকের কথা বলা হলে সে সংখ্যাটা হবে হাতেগোণা। এখনও বিশ্ববিদ্যালয় চলছে কলেজ থাকাকালীন শিক্ষকদের দ্বারা । প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই শিক্ষার্থীরা দাবি জানিয়ে আসছেন, এসব শিক্ষককে অপসারনের জন্য । গত ছয় বছরে জবিতে নতুন শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছে অতি নগন্যহারে । যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের মান নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। দেশের ইতিহাসে পলিটিকাল ফরমালিটির রক্ষার সর্বোত্তম উদাহরণ হচ্ছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। পলটিকাল নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা ক্লাস লেকচার দিতে এসে নিজেরাই নোংরা রাজনীতি শুরু করে দেন। তারা রাজনৈতিক মতাদর্শ শেখান শিক্ষার্থীদের ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মাত্র ক্যান্টিন । বর্তমানে এখন তা-ও বন্ধ ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট্ট এ ক্যাম্পাসটির একটা বিশাল অংশ জুড়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের শাখা । শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে এটি অপসারনের দাবি জানালেও অদৃশ্য কারণে অপসারন হচ্ছে না ব্যাংকের এ শাখাটি । প্রশাসন নির্বিকার। তাদের যেন এক্ষেত্রে কিছুই করার নেই । বিএনপির প্রথম আমলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া নাকি আশ্বাস দিয়েছিলেন এ শাখাটি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার । ২০০৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জবির যাত্রার পর তিনি আবার আশ্বাস দিয়েছিলেন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরও একাধিক বার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই কিছুই হয়নি ।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট দুটি।   আর সিকিউরিটি গার্ডের কথা নাই বা বললাম ।   জবির দক্ষিণ গেটটিকে ঘিরে চলে বিশাল চাঁদাবাণিজ্য । তাই গেটটি কখনো খোলা হয় না । গেটটির সামনে বানানো হয়েছে গ্যারেজ । জবি ক্যাম্পাসে বিকাল ৫টার পর  ঢুকতে পারেন না শিক্ষার্থীরা । প্রশাসন এ ক্ষেত্রে সরব হলেও বিকেলে ক্যাম্পাসে মাদকের আড্ডা নিয়ে ভীষণ নীরব তারা । বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ নিয়ে বর্তমান প্রশাসন এতটাই সচেতন যে, গত কয়বছরে তারা বেবদখল হওয়া জবির ১২টি হল উদ্ধারতো দূরের কথা এগুলো উদ্ধারে উল্লেখযোগ্য কোনও কাজই  করেনি  তারা । ১টা  হলের অবস্হানও তাদের কাছে স্পষ্ট নয় । আমাদের  প্রশাসনের বদান্যতায় সম্প্রতি এক কথিত শহীদ পরিবারের নামে শহীদ আজমল হোসেন হল উদ্ধার করা হয়েছে ।

হল উদ্ধারে একটি কমিটি আছে কিন্তু তাদের কোনও কাজ নেই । সাধারণ শিক্ষার্থীরা হল উদ্ধারের ন্যায্য দাবিতে আন্দোলনে নামলে তাদের দমনে প্রশাসন বেশ পারঙ্গম । লেলিয়ে দেয়া হয় পেটুয়া পুলিশ বাহিনী। এক্ষেত্রে কাজে লাগানো হয় প্রত্যেক বিভাগেরর রাজনৈতিক শিক্ষকদের ।

গত তিন বছর ধরে প্রশাসন বলে আসছে কেরাণিগঞ্জে ১০১ একর জায়গা রাখার কাজ প্রক্রিয়াধীন । তা এখনও প্রক্রিয়াধীনই রয়েছে । কোনও দিন তার বাস্তব রূপে দেখা যাবে কিনা কে জানে ? । শহীদ আজমল হোসেন হল নতুন করে বেদখল হওয়ার খবরে সম্প্রতি ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরে । একটা আন্দোলন দানা বাঁধতে পারে এমন আশংকায় পশাসন তড়িঘড়ি করে ছাত্র –শিক্ষক – কর্মককর্তা– কর্মচারি ব্যানারে মানববন্ধনের আয়োজন করে । প্রগতিশীল ছাত্র জোট দীর্ঘদিন ধরে হল উদ্ধারের দাবিতে আন্দোলন করে এলেও তাদেরকে এ ব্যাপারে কিছুই জানানে হয়নি । আন্দোলনের ব্যাপারে কিছুই জানেনা হল উদ্ধার আন্দোলনের নেতারা । ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষর্থীদের অধিকার নিয়ে বাম দল গুলো সচেতন হলেও তারা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছেন না । গত ছয় বছরে  হল  উদ্ধার  হয়নি। প্রশাসন এক্ষেত্রে চূড়ান্ত ভাবে ব্যর্থ , উল্টো হলগুলো নতুন করে দখলে নিল  দখলবাজরা।

মেস জীবনের ঘানি টানতে টানতে জীবন শেষ, মেধাচর্চার  সময় কোথায় জবি শিক্ষার্থীদের? তবু পড়তে চাই আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আমাদের বাবার টাকা নেই। চাইলেই আমরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যডমিশান নিতে পারি না। পারলে হয়তো এত কষ্ট করে পাবলিকে ভর্তিযুদ্ধে লিপ্ত হতাম না । কিন্তু এসব কি হচ্ছে আমাদের প্রিয় ক্যাম্পাসে ? দুই দলের সংঘর্ষ যেন প্রতিদিনকার ব্যাপার। প্রশাসন-পুলিশ তখন শান্ত দর্শক । সবশেষে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর শুরু হয় পুলিশের অ্যাকশন। পলিশের নির্যাতনের শিকার হই আমরা। সব কছু মুখ বুজে সহ্য করতে হয় । তবু শান্তি নেই । আদুভাইদের মারামারির ফলে বন্ধ হয়ে যায় ক্যাম্পাস। ক্লাস বন্ধ থাকে । তারপর সেশন জটের ফিরিস্তি না বললেও চলে । একবার ভাবি শিক্ষকদের কথা শুনে শুধু ডিপার্টমেন্ট নয় বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাই । কিন্তু তাদের কথা ভেবে থমকে দাঁড়াতে হয় যে মুখগুলো আমাদের পানে  তাকিয়ে আছে । তারা আমাদের সাফল্য দেখার জন্য ব্যাকুল অপেক্ষায় আছে ।

আমাদের মা–বাবা– শুভাকাঙ্ক্ষী। আমাদের কাছে তাদের চাওয়াতো আমরা শিক্ষা আর সাফল্য নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে মানুষের মত মানুষ হয়ে  বেরর হই । কিন্তু জগন্নাথে সে সুযোগ কই ।   আমাদের প্রশাসন পাথরসম কঠিন । তারা আমাদের  দু:খ বোঝে না। আমাদের আহাজারি তাদের কানে পৌঁছায় না । তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার পানে তাকিয়ে আমরা জবির ২৫ হাজার শিক্ষার্থী। আপনিতো আমাদের অবিভাবক। আমাদের হল দিন, পড়ার পরিবেশ দিন । একবার জবিতে এসে দেখে যান জবির গরীব শিক্ষার্থীদের দু:খ । কী কষ্টই না আমরা করছি! নিজের চোখে দেখে যান। আপনাকে সমব্যথী হিসেবে পাশে চাই আমরা । আপনিতো মা, বুঝবেন না সন্তানের কষ্ট ?  হলের জন্য কান্না জবির অসহায়  শিক্ষার্থীদের, কাঁন্না তার বোবা দালান আর উড়ন্ত ধুলা-বালির, বেদনাসিক্ত চোখের পানির স্রোত পুরো জবিজুড়ে। চির বৈষম্যের শিকার জবি কাঁদছে । প্রধানমন্ত্রী এ কান্না আপনি শুনতে পান কী ? প্রধানমন্ত্রী এ কান্না আপনার কানে পৌঁছে কি ? 

লেখকবৃন্দ :  জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত

[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।