ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১০ আশ্বিন ১৪৩২, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৭

মুক্তমত

ভয়াবহ দুঃসংবাদের ডিম রাজনীতি

মন্‌জুরুল ইসলাম। সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:২২, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৫
ভয়াবহ দুঃসংবাদের ডিম রাজনীতি মন্‌জুরুল ইসলাম

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ঝগড়াঝাঁটি নতুন নয়। এটা আমাদের পুরোনো অসুখ।

এ কাইজ্জা নিয়েই আমাদের ৫৪ বছরের পথচলা। যেভাবেই হোক, ক্ষমতা পেলে সুপারগ্লু লাগিয়ে তা ধরে রাখতে চাই। আবার ক্ষমতাচ্যুত হলে মহাদেশপ্রেমিক হয়ে যাই। আওয়ামী লীগ গুম, খুন, অত্যাচার-নির্যাতন, দুর্নীতি-দুরাচার, মানবাধিকার ও ভোটাধিকার লঙ্ঘন করে টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিল। এ সময়ে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করেনি। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মানুষ হত্যা করা হয়েছে। কথায় কথায় জঙ্গি নাটক সাজানো হয়েছে। অপকর্ম সম্পাদনকারীদের করা হয়েছে পুরস্কৃত। সব অসৎ মানুষকে দেওয়া হয়েছে সততার পুরস্কার। সর্বশেষ জুলাই বিপ্লবে পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে পঙ্গু করা হয়েছে। দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুট করা হয়েছে। সে কারণে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা রক্তের বিনিময়ে আওয়ামী লীগকে দেশছাড়া করল। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দেশ ছেড়ে পালিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন। নিজের দল আওয়ামী লীগকে গলা টিপে হত্যা করে তিনি নিজেকে ও নিজের স্বজনদের রক্ষা করেছেন। কিন্তু জনধিকৃত হওয়ার পরও ন্যূনতম অনুশোচনা নেই। নিজের দেশে শিকড়শূন্য হয়ে বিদেশে শিকড় গজানোর চেষ্টা করছেন। এ অপচেষ্টার নগ্নরূপ সারা বিশ্ব ২২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের জেএফকে বিমানবন্দরে ও এর আশপাশে প্রত্যক্ষ করেছে। দেশের মানসম্মান ভূলুণ্ঠিত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। সভ্যতার মানদণ্ডে আমরা কোন পর্যায়ে আছি, বিদেশিদের কাছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অবশ্য যারা দেশছাড়া হয়েছে, যাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়েছে দেশের মানসম্মান তাদের কাছে মুখ্য বিষয় নয়। এই নির্বাসিত শক্তি আবারও প্রমাণ করল দেশের সম্মান নষ্ট করা তাদের কাছে লজ্জার নয়, গর্বের এবং এটাই তাদের প্রকৃত স্বরূপ। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে হয়তো আরও অপ্রীতিকর ঘটনা তারা ঘটাতে পারে। সে কারণেই অন্তর্বর্তী সরকার ও সব রাজনৈতিক দলকে এক ছাতার নিচে আসতে হবে। এ অপশক্তিকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করার জন্য ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের ভিতরে যদি গোপন শত্রু থাকে, রাজনৈতিক দলগুলো যদি নির্বাচন ইস্যুতে দ্বিধাবিভক্ত থাকে, তাহলে দেশছাড়া অপশক্তি আবার দেশে ফেরার সুযোগ পাবে। তখন শুধু ডিম নয়, আরও অনেক কিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারপ্রধান হিসেবে দ্বিতীয়বার জাতিসংঘে গেলেন। গত বছর প্রথমবার তিনি যখন জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেন, তখন বিশ্বসভার সভ্যগণ তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তিনি শুধু বাংলাদেশের সরকারপ্রধানই নন, তিনি হলেন একজন নোবেল লরিয়েট। সে কারণেই তিনি সবার কাছে অধিকতর গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। বিশ্বসভা তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে কার্পণ্য করেনি। প্রথমবার সঙ্গে নিয়েছিলেন জুলাই বিপ্লবীদের। কীভাবে বিপ্লব হলো, কীভাবে তিনি সরকারপ্রধান হলেন, বিপ্লবের মাস্টারমাইন্ড কে সবিস্তার ব্যাখ্যা করেছিলেন। তুমুল করতালিতে সবাই স্বাগত জানিয়েছিলেন। তাঁর এবারের সফরসঙ্গী রাজনৈতিক নেতারা। দুটি বড় ও একটি নতুন রাজনৈতিক দল। গত বছরের চেয়ে এবার প্রধান উপদেষ্টার ব্র্যান্ডিং একটু ভিন্ন রকম হবে। কারণ বিদেশিদের কাছে বার্তা হলো-বাংলাদেশের রাজনীতিতে চরম অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব সবচেয়ে বেশি। বিপ্লবীদের নতুন দলও এখন ফ্যাক্টর। অনৈক্যের খণ্ডিত প্রাচীর মেরামত করতে গঠন করা হয়েছে ঐকমত্য কমিশন। তার পরও ঐক্য হচ্ছে না। এ অবস্থায় বিদেশিরা যদি দেখেন যে ড. ইউনূস সবাইকে মানিয়ে একসঙ্গে নিয়ে কাজ করছেন, তাহলে বিশ্বপরিসরে তাঁর সুখ্যাতি বাড়বে। দেশবাসীও সবার ঐক্য কামনা করে। এ মুহূর্তে দেশবাসীর প্রত্যাশা হলো তিন দলের নেতারা জাতিসংঘ থেকে ঘুরে এসে নিশ্চয় দেশবাসীকে একটি সুখবর দেবেন। রাজনৈতিক দলগুলো বিভেদ ভুলে যাবে। সব রাজনৈতিক দল একমত হয়ে গণতন্ত্রের নতুন যাত্রা শুরু করবে। জনগণ নির্ভয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে এবং তাদের ভোটে নির্বাচিতরাই সরকার গঠন করবে। এমন একটি সুখবর যদি না পাওয়া যায়, তাহলে ড. ইউনূসের এ উদ্যোগ অতীতের মতো নিছক প্রথাগত জাতিসংঘ ভ্রমণে পরিণত হবে। শেখ হাসিনার ১৬ বছরে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য দেশ থেকে উড়োজাহাজ বোঝাই করে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়া হতো। এ তালিকায় নাম তোলার জন্য সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ সারা বছর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তদবির করতেন। উড়োজাহাজ বোঝাই করে যাদের নেওয়া হতো তারা কেউ কেউ ফিরতি জাহাজে আর ফিরতেন না। অন্যরা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আনন্দ-ফুর্তি করে উপহারের মোবাইল ফোন সেট, কিছু সাবান-শ্যাম্পু লাগেজে ভরে ঢাকায় ফিরতেন। পাসপোর্টে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার একটি সিল প্রাপ্তিকেই অনেকে বেহেশতের টিকিট পাওয়ার মতো মনে করতেন। এদিকে এবার সফরসঙ্গী হিসেবে রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘের অধিবেশনে অংশগ্রহণ বিদেশিদের কাছে প্রশংসিত হলেও, আমাদেরই প্রবাসীরা তাঁকে অপমান করেছেন। যে বিপ্লবীদের কারণে দেশ আজ মুক্ত, সেই বিপ্লবীদের ডিম মারা হয়েছে। এর আগে লন্ডনে আরেক বিপ্লবী তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপরও প্রবাসীরা ডিম নিক্ষেপ করেন। দুটি ঘটনাই সরকার ও বিপ্লবীদের জন্য বিপদের সংকেত।

কোনো সরকারের কোনো দায়ই কেউ নেয় না। সরকারের শরিকরাও নেয় না। সুবিধাভোগীরা সরকারের কাছ থেকে সুবিধা ভোগ করবে; কিন্তু দিনশেষে কোনো দায় নেবে না। ১৬ বছরের সীমাহীন নির্যাতন শেষে সফল বিপ্লবের পর একটি সরকার গঠিত হলো। বিগত সময়ে যারা নির্যাতিত হয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে মুক্ত বাতাসে তারা শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে বিচরণ করছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে তাদেরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। বৈষম্যমুক্ত সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্র গঠনে প্রতিশ্রুত সরকারের বয়স এখন এক বছরের বেশি। এ সময়ের মধ্যে প্রত্যাশা অনুযায়ী অনেক কিছুই হয়নি। আবার যা হয়েছে তা-ও কম নয়। তবে শেষ পর্যন্ত ঘোষিত সময়ের মধ্যে একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনই হচ্ছে জাতির চূড়ান্ত প্রত্যাশা। সে প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশবাসীর কাছে স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে থাকবেন। তা না হলে কেউ ক্ষমা করবে না। সুতরাং সম্মান বাঁচাতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। একমাত্র সুষ্ঠু ও সফল নির্বাচনই পারে প্রধান উপদেষ্টার ভাবমর্যাদা রক্ষা ও উজ্জ্বল করতে। নির্বাচন বিলম্বিত করতে কিছু দল ও সরকারের ভিতরের একটি অংশ নানাভাবে কাজ করছে। মনে রাখতে হবে, বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতিতে নির্বাচন নিয়ে সংকট তৈরি হলে সে সংকট কাউকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। দেশের আইনশৃঙ্খলা, অর্থনীতি, বিনিয়োগ, প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, শিক্ষাব্যবস্থা ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া খণ্ডকালীন সরকারের ওপর কেউ আস্থা রাখতে পারছে না। সে কারণেই দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। সবকিছুতেই সবাই বেপরোয়া। এ পরিস্থিতি যদি আরও প্রলম্বিত হয়, তাহলে সরকারে যাঁরা আছেন তাঁদের প্রত্যেককে কোনো না কোনো সময় এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। চরম মূল্যও দিতে হতে পারে। ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরা জানেন ও মানেন, প্রত্যেক মানুষের দুই কাঁধে দুজন ফেরেশতা কিরামান কাতেবিন আল্লাহতায়ালা নিয়োগ দিয়েছেন। মানুষ কখন কী করছে, কী ভাবছে সবই তাঁরা প্রতিনিয়ত তাঁদের ডায়েরিতে লিখে রাখছেন। হাশরের মাঠে সেই ডায়েরি ধরে আল্লাহ তাঁর বান্দার বিচার করবেন। ভালো কাজের পুরস্কার দেবেন, মন্দ কাজের শাস্তি ও তিরস্কার দেবেন। তেমনি বর্তমান সরকারে যাঁরা আছেন, তাঁদের চারপাশেও অনেক লোক আছেন যাঁরা সবকিছু দেখছেন, সব ফাইলের ফটোকপি করে রাখছেন। কার তদবিরে কোন ফাইল পাস হচ্ছে, কে কোন সুবিধা নিচ্ছেন ও দিচ্ছেন। কে ন্যায্য করছেন, কে অন্যায্য করছেন। কে নীলা মার্কেটে যাচ্ছেন, কে লং ড্রাইভে যাচ্ছেন। এমনকি কে সকালে ঘুম থেকে উঠছেন আর কার ঘুম ভাঙে বিকাল ৪টায়। সমাজ ও রাষ্ট্র কলুষমুক্ত করতে যাঁদের বিশ্বস্ত ভেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাঁরা কে কে কোথায় কার সঙ্গে গোপন মিটিং করছেন সব খবরই অনেকের কাছে আছে। বিশেষ করে সেগুনবাগিচার কোন শীর্ষ কর্তা গুলশানে কার বাসায় নিয়মিত মিটিং করেন সে খবরও আছে। কারা সরকারকে সহায়তা করছেন, কারা সরকারের মধ্যে থেকে উল্টো পথে চলছেন, সেসব রেকর্ডও আছে। যদি বৈরী সময় আসে তাহলে সরকারের ভিতরের সুবিধাভোগীরা সুযোগ ও সময় বুঝে সটকে যাবেন। আর ব্যর্থতার সব দায় পড়বে প্রধান উপদেষ্টার ওপর। এখন আইন যেমন ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কথা বলছে, কোনো একসময় যদি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধেও কথা বলে, তখন ইমেজ নষ্ট হবে নোবেল লরিয়েটের। পার পাবেন না রাজনীতিবিদরাও। ওয়ান-ইলেভেন রাজনীতিবিদদের ক্ষমা করেনি। রাজনৈতিক সংকটে সৃষ্ট ওয়ান-ইলেভেনের প্রায়শ্চিত্ত রাজনীতিবিদদের ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ভোগ করতে হয়েছে। এর পরও হুঁশ না হলে জুলাই বিপ্লবের মতো জনগণকেই নতুন করে ভাবতে হবে। সেই ভাবনা রাজনীতিবিদদের জন্য সুখকর কিছু হবে বলে মনে হয় না।

যুক্তরাষ্ট্রে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন ও লন্ডনে তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর ডিম হামলা বিপ্লব-উত্তর বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ দুঃসংবাদ। যে বিপ্লবীদের কারণে আজ সবাই স্বাধীন, তাঁদের ওপর হামলা মেনে নেওয়া কষ্টকর। সে কারণেই বর্তমান বাস্তবতায় সব ভেদাভেদ ভুলে গণতান্ত্রিক শক্তি মজবুত রাখতে হবে। এজন্য ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচিত সরকার ছাড়া অপশক্তি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। মানুষ শান্তি চায়। নিরাপত্তা চায়। দেশ ও মানুষের কল্যাণের একমাত্র পথ নির্বাচন। মনে রাখতে হবে, ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বানচাল অথবা বিলম্বিত করার চেষ্টা হলে জনগণ মানবে না। নির্বাচনবিরোধী কাজ যারা করবে, তাদের জন্য প্রবাসী ফ্যাসিস্ট নয়, দেশের জনগণই ডিম বরাদ্দ করতে পারে। সময়মতো যা তারা পেয়ে যাবেন।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন

[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।