বাংলাদেশ স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী অতিক্রম করেছে। একদিকে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অন্যদিকে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার সংগ্রাম—এই দ্বৈত বাস্তবতায় দেশ এগিয়ে চলছে।
কিছু রাজনৈতিক মহল দাবি করছেন, এই পদ্ধতি ছোট দলগুলোর সংসদে প্রবেশ নিশ্চিত করবে, বহুমাত্রিক প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি করবে এবং গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা—বিশেষ করে নেপালের উদাহরণ—আমাদের সামনে এক ভয়াবহ সতর্কবার্তা হাজির করছে। নেপাল গত ১৭ বছরে ১৩ বার সরকার পরিবর্তন করেছে, যা একটি রাষ্ট্রের জন্য ভয়াবহ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রতীক।
নেপালের অভিজ্ঞতা: বহুদলীয় প্রতিনিধিত্ব থেকে জিম্মি রাজনীতি
নেপালে পিআর পদ্ধতি চালু করার উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়ে দাঁড়িয়েছে:
• সংসদে কোনো দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি।
• সরকার গঠন ও টিকিয়ে রাখতে বারবার জোটের দরকষাকষি করতে হয়েছে।
• ছোট দলগুলো সংসদে অতিরিক্ত ক্ষমতা অর্জন করে বড় দলগুলোকে জিম্মি করেছে।
• নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রিতায় ভুগেছে।
• উন্নয়ন কার্যক্রম থমকে গেছে।
• জনগণ রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে।
এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় জনরোষ এতটাই বেড়েছে যে সাধারণ মানুষ নেতাদের গণপিটুনি দিয়েছে। এটি গণতান্ত্রিক দুনিয়ায় বিরল এক ঘটনা।
বাংলাদেশের সংবিধান ও বাস্তবতা
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (FPTP) পদ্ধতিতে। অর্থাৎ প্রতিটি আসনে সর্বাধিক ভোট পাওয়া প্রার্থী নির্বাচিত হন। পিআর পদ্ধতি আমাদের সাংবিধানিক কাঠামোয় নেই। এটি চালু করতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে—যা একটি দীর্ঘ, জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রক্রিয়া।
এছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক কাঠামো এখনও পিআর পদ্ধতির জন্য প্রস্তুত নয়। এতে—
• সংসদ ঝুলন্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
• প্রশাসন অকার্যকর হয়ে পড়বে।
• বিচার বিভাগেও রাজনৈতিক চাপ বাড়বে।
• গোটা জাতি রাজনৈতিক অস্থিরতায় নিমজ্জিত হবে।
উন্নয়ন প্রকল্প ও অর্থনীতির ঝুঁকি
বাংলাদেশ এখন পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেলসহ নানা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এসব প্রকল্পের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে টেকসই সরকার অপরিহার্য।
যদি পিআর পদ্ধতি চালু হয়:
• সরকার বারবার বদলাবে।
• সিদ্ধান্ত গ্রহণ হবে বিলম্বিত।
• বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাবে।
• অর্থনীতি ও উন্নয়ন থমকে যাবে।
অতএব, বর্তমান পরিস্থিতিতে পিআর বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ধর্মীয় লেজুড়বৃত্তিক দলের প্রভাব
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনেক ছোট দল ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেছে। পিআর পদ্ধতি চালু হলে এসব দল সংসদে প্রবেশ করে জাতীয় রাজনীতিকে জিম্মি করতে পারে।
• তারা ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক বিভাজন বাড়াবে।
• নীতি নির্ধারণে জাতীয় স্বার্থ নয়, বরং স্বার্থান্বেষী এজেন্ডা গুরুত্ব পাবে।
• ধর্মীয় সহিংসতা ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে।
বাংলার সংস্কৃতি বরাবরই সহাবস্থান ও সম্প্রীতির। কিন্তু ধর্মভিত্তিক লেজুড়বৃত্তিক দলগুলো সংসদে অতিরিক্ত ক্ষমতা পেলে সেই ঐতিহ্য ভেঙে যাবে।
মানবাধিকার, লিঙ্গ ও বয়সভিত্তিক চ্যালেঞ্জ
পিআর পদ্ধতির সমর্থকরা দাবি করেন, এতে নারী, তরুণ, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে:
• রাজনৈতিক দলগুলো আসন বণ্টনে আনুগত্যকে প্রাধান্য দেবে, যোগ্যতাকে নয়।
• নারীরা কেবল প্রতীকী আসন পাবেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব সীমিত থাকবে।
• তরুণরা কেবল ভোট গণনায় সংখ্যা বাড়াবে, কিন্তু তাদের চাহিদা পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিফলিত হবে না।
• মানবাধিকার প্রশ্নে পিআর ব্যবহৃত হবে রাজনৈতিক প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে।
ফলে বহুমাত্রিক প্রতিনিধিত্ব হলেও প্রকৃত ক্ষমতায়ন ঘটবে না।
নতুন ভোটারদের প্রত্যাশা
বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনে প্রায় দুই কোটি নতুন ভোটার যুক্ত হবেন। তাদের বেশিরভাগ তরুণ, যারা চায়—
• কর্মসংস্থান
• আধুনিক শিক্ষা
• প্রযুক্তি নির্ভর উন্নয়ন
• রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
কিন্তু পিআর পদ্ধতি চালু হলে তারা রাজনীতিকে আরও জটিল, দুর্নীতিগ্রস্ত ও অকার্যকর বলে মনে করবে। এতে তরুণরা গণতন্ত্র থেকে বিমুখ হয়ে পড়তে পারে।
পিআর পদ্ধতির সুবিধা ও সীমাবদ্ধতা
সম্ভাব্য সুবিধা:
• ছোট দলগুলোর সংসদে প্রবেশ সহজ হবে।
• বহুমাত্রিক প্রতিনিধিত্ব আসবে।
• বিভিন্ন মতাদর্শ সংসদে আসতে পারবে।
সীমাবদ্ধতা:
• সরকার গঠন ও টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
• উন্নয়ন প্রকল্প ব্যাহত হবে।
• ছোট দলগুলোর অতিরিক্ত প্রভাব বড় দলগুলোকে জিম্মি করবে।
• আসন বণ্টনে দুর্নীতি, সন্ত্রাস ও ভোট কেনাবেচা বাড়বে।
• ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি উসকে যাবে।
• নারী, তরুণ ও সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব হবে প্রতীকী।
ব্রিটিশ অভিজ্ঞতা: একটি বিশ্বস্বীকৃত গণতন্ত্র
আমি ৩০ বছরের বেশি সময় ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসে কাজ করেছি। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি—ব্রিটিশ গণতন্ত্র বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত একটি মডেল, যেখানে ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট (FPTP) পদ্ধতি এখনো কার্যকর।
এই ব্যবস্থার সুফল হলো:
• সরাসরি জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়।
• সরকার স্থিতিশীল থাকে।
• সিদ্ধান্ত দ্রুত ও কার্যকর হয়।
• উন্নয়ন ধারাবাহিকভাবে এগোয়।
বাংলাদেশের জন্যও ব্রিটিশ গণতন্ত্রের এই মডেল সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। কারণ আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা নেপালি মডেলের জন্য উপযোগী নয়।
বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি: ধর্মীয় নেতৃত্বের সরাসরি নির্বাচন
বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় ধর্মীয় নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই আমার প্রস্তাব—বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর নেতাদের সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত করার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এতে—
• জনগণ প্রকৃত যোগ্য ও সৎ নেতাদের বেছে নিতে পারবে।
• ধর্মভিত্তিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি দুর্বল হবে।
• জাতীয় ঐক্য ও সম্প্রীতি জোরদার হবে।
এভাবে ধর্মীয় নেতারা সংসদে অংশ নিতে পারবেন, তবে তারা জনগণের সরাসরি নির্বাচিত প্রতিনিধি হবেন—দলীয় আনুগত্যের দাস নয়।
বাংলাদেশের জন্য পিআর নয়, টেকসই গণতন্ত্রই পথ
নেপালের অভিজ্ঞতা স্পষ্ট করেছে—প্রতিনিধিত্ব যথেষ্ট নয়, কার্যকর ও স্থিতিশীল সরকার অপরিহার্য। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায়—
• পিআর পদ্ধতি আমাদের সংবিধানে নেই এবং তা চালুর সুযোগও নেই।
• এটি চালু হলে সংসদ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগে অচলাবস্থা তৈরি হবে।
• উন্নয়ন ব্যাহত হবে, বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারাবে।
• ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়বে।
• পুরো জাতি রাজনৈতিক অস্থিরতায় নিমজ্জিত হবে।
তাই বলা যায়—বাংলাদেশের জন্য পিআর পদ্ধতি কার্যকর নয়, উপযোগীও নয়। বরং আমাদের উচিত—
• বিদ্যমান গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করা,
• স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করা,
• জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ বাড়ানো,
• এবং ব্রিটিশ গণতন্ত্রের মতো স্থিতিশীল একটি মডেল অনুসরণ করা।
বাংলাদেশ এখন এক সংবেদনশীল মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। ভুল সিদ্ধান্ত উন্নয়ন থামিয়ে দেবে, সমাজকে বিভক্ত করবে এবং গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তাই আমাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে হলে স্থিতিশীল ও টেকসই সরকার দরকার, পিআর পদ্ধতির মতো বিভ্রান্তিকর পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা নয়।
ড. মোহাম্মদ ফয়েজ উদ্দিন এমবিই
চেয়ারম্যান, নিউ হোপ গ্লোবাল
মানবাধিকার সংগঠক, আন্তর্জাতিক গবেষক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বার্মিংহাম, যুক্তরাজ্য