স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস ১০ জানুয়ারি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিশ্ব জনমতের চাপে ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের মিয়ান ওয়ালী কারাগারে দীর্ঘ ৯ মাস কারাভোগের পর মুক্তি লাভ করেন বঙ্গবন্ধু।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেদিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আবার আমি ফিরতে পারবো কি-না। আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন’।
সেদিন বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, ‘রক্ত দিয়ে হলেও আমি বাঙালি জাতির এই ভালোবাসার ঋণ শোধ করে যাবো’। রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের মাত্র তিন বছর সাত মাসের মাথায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কুচক্রি মহলের চক্রান্তে সপরিবারে নিহত হন তিনি। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে শোধ করে যান সেই ঋণ।
আজ বিশ্ব পরিমণ্ডলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করা হয়। তাঁর ভাষণ নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। তাঁর রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভাবনাগুলো নিয়ে অধ্যয়ন করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ, জনমত তৈরি এবং পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টিতে ভারত প্রথম থেকেই বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে, বিশেষ করে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছিল লক্ষণীয়। ১৭ জুন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের কারাগারে আটক শেখ মুজিবুর রহমানের শারীরিক অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিশ্ব নেতৃবৃন্দদের শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা চালানোর অনুরোধ করেন। ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ সানডে টাইমসকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘শেখ মুজিবকে অবশ্যই মুক্ত করা হবে’।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান রচিত হয়, ভারত তার সংবিধান রচনা করে তাদের স্বাধীনতার ৩ বছর পর অর্থাৎ ১৯৫০ সালে। আর বাংলাদেশ স্বাধীনতার মাত্র ১ বছর পর সংবিধান রচনা করে। জাতিসংঘের মত আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের সদস্যপদ সহ পাকিস্তান ও অন্যান্য আরও ১৩৯টি দেশের স্বীকৃতি লাভ বঙ্গবন্ধুর কৃতিত্ব। বঙ্গবন্ধুর বড় কীর্তির মধ্যে আরেকটি হলো- অতি অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থানকারী বন্ধুপ্রতীম ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানে আটকা পড়া বাঙালি সৈন্য ও সাধারণ নাগরিকদের স্বদেশে ফিরিয়ে আনা। বন্ধুপ্রতীম ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী এক কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন করেন তিনি। চাকরির ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার প্রদান করে হাজার হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরির ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৪ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী আন্তর্জাতিক শক্তির ষড়যন্ত্রের ফলে দেশে খাদ্য সংকট দেখা দেয়। তা মোকাবেলার জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে লঙ্গরখানা স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু।
কৃতজ্ঞতাবোধ বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের এক অন্যতম উজ্জ্বল দিক। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি সশ্রদ্ধচিত্তে ভারতের জনগণ ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সালাম জানাই। বিশ্বের এমন কোনও দেশ নেই যেখানে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আমার মুক্তির জন্য যাননি। অনেকে বলেছেন, ভারতীয় সেনবাহিনী কবে যাবে? মতিলাল নেহেরুর নাতনি, পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর কন্যা ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি ভালো করে চিনি। আমি যেইদিন বলবো, সেইদিনই ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশ থেকে চলে যাবে৷ ভারতীয় সৈন্য হানাদার বাহিনী নয়’।
বঙ্গবন্ধু তাঁর সাহস, অনমনীয় দৃঢ়তা এবং অসাধারণ বাগ্মিতার অভূতপূর্ব সমন্বয়ে বাঙালির শ্রেষ্ঠতম নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় ৩০৫৩ দিন তিনি জেলখানায় অতিবাহিত করেছেন৷ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ এই দুইটি অসাধারণ গ্রন্থে এবং সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর ‘Secret documents of intelligence branch on father of the nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman’ গ্রন্থে আমরা এসব দিনের অনেক খুঁটিনাটি সম্পর্কে জানতে পারি।
পরিশেষে এই রাজনীতির কবি’র অসীম সাহস ও আত্মত্যাগের আদর্শ অনুধাবন করে এই জাতি এগিয়ে যাবে, এই হোক বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের অঙ্গীকার।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০২৪
এসি/টিসি