ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

বিএনপি কেন সংবিধান ছুড়ে ফেলতে চায়

মো. জাকির হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩
বিএনপি কেন সংবিধান ছুড়ে ফেলতে চায়

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রের এমন এক জীবন পদ্ধতি, যা রাষ্ট্র স্বয়ং নিজের জন্য বেছে নেয়। ’ কোনো রাষ্ট্রের সংবিধান হচ্ছে এমন মূল্যবান দলিল, যেখানে বর্ণিত আইন-কানুন, নীতি-নির্দেশনার আলোকে রচিত হয় রাষ্ট্রের অন্যান্য আইন-কানুন, বিধি-বিধান, যা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অপরিহার্য।

এটি সাধারণ আইনের মতো সহজে পরিবর্তনীয় না হলেও কিছু শর্ত সাপেক্ষে রাষ্ট্র-সমাজ ও জনসাধারণের প্রয়োজনে সংবিধানে সংযোজন-বিয়োজন-পরিবর্তন করা যেতে পারে। লিখিত, অলিখিত সব সংবিধানেই সংশোধনের বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান গত ৫১ বছরে ১৭ বার সংশোধন তথা সংযোজন-বিয়োজন-পরিবর্তন করা হয়েছে। যদিও এর কয়েকটি সংশোধনী নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে এবং কোনো কোনো সংশোধনী সংবিধানের অভিভাবক সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক বাতিল ঘোষিতও হয়েছে।

দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ও কয়েক লাখ কন্যা-জায়া-জননীর চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১১ জানুয়ারি মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ওই দিনই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ রাষ্ট্রপতি নতুন সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে গণপরিষদ আদেশ জারি করেন। ১৯৭০-এর ডিসেম্বর এবং ১৯৭১-এর জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যরা নতুন এই গণপরিষদের সদস্য হিসেবে বিবেচিত হন। প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদ মোট ৪৬৯ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হলেও মুক্তিযুদ্ধে নিহত, স্বাভাবিক মৃত্যু, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা, দেশত্যাগ ইত্যাদি কারণে ৬৬ জন সদস্য বাদ পড়েন। বাকি ৪০৩ জন নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে গণপরিষদে একটি খসড়া প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে মোট সদস্য ছিলেন ৩৪ জন। ৩৪ সদস্যের কমিটির ২৪ জনই ছিলেন আইনজীবী, যাদের মধ্যে পাঁচজন ইংল্যান্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যারিস্টার ছিলেন। কমিটির অন্য ১০ জন সদস্যের মধ্যে চারজন অধ্যাপক, একজন ডাক্তার, একজন সাংবাদিক ও তিনজন সমাজকর্মী ছিলেন।


সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটি ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করেন। প্রথম বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিন সপ্তাহ সময় দিয়ে আগ্রহী সংগঠন ও ব্যক্তিদের কাছ থেকে সংবিধান সম্পর্কে প্রস্তাব আহবান করা হয়। সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে এই আহবান জানানো হয়। কমিটি সংবিধান বিষয়ে সাধারণ জনগণের কাছ থেকে ৯৮টি প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল। তার মানে, অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে সংবিধান তৈরি করা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ, উত্তম ও কার্যকর সংবিধান প্রণয়ন করার লক্ষ্যে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন ভারত ও ইংল্যান্ড সফর করে সেখানকার পার্লামেন্টের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেন। তা ছাড়া সংবিধানকে অপেক্ষাকৃত ত্রুটিমুক্ত করার উদ্দেশ্যে কমিটি একজন ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করে। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি ৪৭টি বৈঠকে মিলিত হয়ে পূর্বনির্ধারিত ১৯৭২ সালের ১০ জুন সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়।

কমিটিতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সর্বসম্মতিক্রমে কোনো কোনো সময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে কমিটির ছয়জন সদস্য ভিন্নমত প্রদান করেন। ভিন্নমত প্রদানকারীদের মধ্যে পাঁচজন ছিলেন আওয়ামী লীগের ও অন্যজন ছিলেন তৎকালীন মোজাফফর ন্যাপের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। বিরোধীদলীয় সদস্য ন্যাপের সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পক্ষ থেকে সর্বাধিক আপত্তি উত্থাপিত হয়। তিনি ২৪টি আপত্তি উত্থাপন করেন, তাঁর মূল আপত্তি ছিল—সংবিধানে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় বিধান করা হয়নি, সংসদে আসনসংখ্যা ৩৫০ জন করা, নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন না রাখা এবং সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে চার বছর করা। অন্য সদস্যদের ভিন্নমত ছিল—ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিগ্রহণ, দলত্যাগ বা বহিষ্কারজনিত কারণে সংসদ সদস্য পদ বাতিলের বিরুদ্ধে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা, ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের বিষয় সংযোজন। প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে জানা যায় যে কমিটিতে উন্মুক্ত পরিবেশে আলাপ-আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিরোধীদলীয় একমাত্র সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ওই সময় বলেছিলেন, ‘কমিটির সদস্যগণ খোলা মন নিয়ে সংবিধান সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ’ (বাংলাদেশ গণপরিষদ বিতর্ক, খণ্ড-২, সংখ্যা ১, ১২ আক্টোবর, ১৯৭২, পৃষ্ঠা-২৭)। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথার প্রত্যয়ন মেলে কমিটির আওয়ামী লীগদলীয় সদস্য আসাদুজ্জামানের বক্তব্যে। তিনি বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু কিংবা তাঁর সরকার কোনো সময়েই আমাদের প্রভাবান্বিত করার চেষ্টা করেননি, আমরাও হইনি। ’ (বাংলাদেশ গণপরিষদ বিতর্ক, খণ্ড-২, সংখ্যা ৯, ২৫ আক্টোবর, ১৯৭২, পৃষ্ঠা-২৫৯)।

১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধানটি বিল আকারে গণপরিষদে উত্থাপন করা হয় ও ১৯ অক্টোবর সাধারণ আলোচনার জন্য গৃহীত হয়। ১০টি বৈঠকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত সংবিধান বিলের ওপর বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। ৪৭ জন সদস্য আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। এই ৪৭ জনের মধ্যে ৪৪ জন আওয়ামী লীগের, একজন ন্যাপের ও দুজন স্বতন্ত্র সদস্য। ৩১ অক্টোবর থেকে শুরু হয় সংবিধান বিলের দ্বিতীয় পাঠ তথা অনুচ্ছেদওয়ারি আলোচনা। এই আলোচনা ৩ নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। দ্বিতীয় পাঠের সময় মোট ১৬৫টি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এর মধ্যে ৮৫টি প্রস্তাব উত্থাপন করেন আওয়ামী লীগের সদস্যরা, আর ৮০টি প্রস্তাব আনেন বিরোধী ন্যাপ ও স্বতন্ত্র সদস্যরা। এর মধ্যে ৮৬টি সংশোধনী প্রস্তাব গৃহীত হয়। বেশির ভাগ সংশোধনী কার্যত সম্পাদকীয় ধরনের ছিল, যা মূলত ভাষাগত উৎকর্ষ সাধন কিংবা ভাবের সুস্পষ্টকরণ সম্পর্কিত। গুরুত্বপূর্ণ গৃহীত সংশোধনীর মধ্যে অন্যতম ছিল—এক. খসড়া সংবিধানের ৪২ অনুচ্ছেদে ব্যক্তিগত সম্পত্তি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। এটি সংশোধন করে এই অনুচ্ছেদে একটি নতুন বিধান সংযোজন করা হয় এবং তার দ্বারা জাতীয় সংসদকে ‘ক্ষতিপূরণসহ অথবা বিনা ক্ষতিপূরণে’ ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে অধিগ্রহণের জন্য আইন প্রণয়নের অবাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়। দুই. খসড়া সংবিধান বিলের ৫৬ অনুচ্ছেদে বলা হয় যে কেবল সংসদ সদস্যরাই মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগলাভের যোগ্য হবেন। এই অনুচ্ছেদ সংশোধন করে একটি নতুন বিধান করা হয় যে সংসদ সদস্য নন এমন ব্যক্তিকেও মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করা যাবে, তবে অনুরূপ ব্যক্তিকে মন্ত্রিত্ব বহাল রাখতে ছয় মাস সময়ের মধ্যে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতে হবে। তিন. ৭০ অনুচ্ছেদের খসড়া বিধানে দল থেকে বহিষ্কারের কারণে সংসদ সদস্য পদ হারানোর বিধান সংশোধন করে এটি বাদ দেওয়া হয়। চার. ৭৩ অনুচ্ছেদে উল্লেখ ছিল রাষ্ট্রপতি সংসদে ভাষণদান এবং বাণী প্রেরণ করতে পারবেন। এই অনুচ্ছেদটি সংশোধন করে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রচলিত সর্বজনীন রীতি সংযোজন করে বলা হয়, রাষ্ট্রপতির বাণী বা ভাষণ সম্পর্কে সংসদ আলোচনা করবে।

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধান বিলের তৃতীয় ও শেষ পাঠ অনুষ্ঠিত হয় এবং ওই দিনই গণপরিষদ কর্তৃক সংবিধানটি গৃহীত হয়। কোনো সদস্য বিপক্ষে ভোট দেননি। নতুন সংবিধান ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর তথা বিজয় দিবস থেকে বলবৎ হয় এবং ওই দিনই গণপরিষদের বিলুপ্তি ঘটে। গণপরিষদে সংবিধানের ওপর বক্তব্য দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই সংবিধান শহীদের রক্তে লিখিত, এই সংবিধান সমগ্র জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে। ’

শহীদের রক্তে লেখা এই সংবিধান বিএনপি বদলে ফেলতে চায়। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বাংলাদেশের সংবিধান পুরোপুরি বাতিল করে নতুন একটি সংবিধান প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছেন। তাঁর এই প্রস্তাবকে সমর্থন করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ‘বাই চান্স’ বা ‘ভাগ্যক্রমে’ হয়েছে। তাই দেশের সংবিধানও অপরিকল্পিত। তিনি বলেছেন, ‘ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি সেই সংবিধান নতুন করে প্রণয়ন করবে। যাঁরা সংবিধান তৈরি করেছেন, তাঁদের সংবিধান তৈরি করার কোনো অধিকার ছিল না। ’ অন্যদিকে আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘একদলীয় লোকেরা এই সংবিধান তৈরি করেছেন। আওয়ামী লীগের বাইরে মাত্র দুজন সদস্য সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে ছিলেন। তাঁরা কেউই সেই সংবিধানে স্বাক্ষর করেননি। তাই এটি একনায়কদের সংবিধান। এই সংবিধান বারবার কাটাছেঁড়া না করে পুরোটাই ফেলে দিন। নতুন করে একটি সংবিধান তৈরি করুন। যেখানে মানুষের অধিকারের নিশ্চয়তা থাকবে। ’ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আরো বলেন, ‘আমাদের দলের স্ট্যান্ডিং কমিটিকে বলব আপনারা ঘোষণা দিন ক্ষমতায় গেলে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবেন। বর্তমান সংবিধানের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তাই সবার মতামত নিয়ে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। ’

প্রশ্ন হলো, শহীদের রক্তে লেখা সংবিধান বিএনপি কেন বদলে ফেলতে চায় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানে আছে, কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে নেই এমন কোনো বিষয় কি আছে থাকলে সেটা কী বিশ্বের অন্যান্য দেশের সংবিধানে আছে কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে তা সংযোজন করা হয়নি, এমন বিষয় সংবিধানে সংযোজন করলেই তো সমাধান হয়ে যায়। এ জন্যই তো সংবিধানে সংশোধনের বিধান সংযোজন করা হয়েছে। এই সংবিধানকে ছুড়ে ফেলে তথা শহীদের রক্তের দাগ মুছে ফেলে নতুন করে কেন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে তার মানে কি মুক্তিযুদ্ধকে তথা লাখ লাখ শহীদ ও কন্যা-জায়া-জননীর চরম আত্মত্যাগকে ও মুক্তিযোদ্ধাদের মুছে ফেলতে চান বাংলাদেশ ভাগ্যক্রমে স্বাধীন হয়নি। কয়েক দশকের সুদীর্ঘ রক্তপিচ্ছিল পথ বেয়ে অনেক মাইলফলক পেরিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বৈধ পদ্ধতিতে গণপরিষদ গঠিত হয়েছে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের গণপরিষদ যে প্রক্রিয়ায় সংবিধান প্রণয়ন করে তার সব কটি ধাপ অনুসরণ করে অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে সর্বসম্মতিক্রমে সংবিধান বিল গণপরিষদে গৃহীত হয়েছে। এটি একদলীয় সংবিধান নয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অনেক দল অংশগ্রহণ করেছে, কিন্তু মানুষ তাদের ভোট দেয়নি, আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে। কেউ কেউ সব রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠনের প্রতিনিধির সমন্বয়ে জাতীয় কনভেনশনের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়নের দাবি করেছিলেন। যৌক্তিক কারণেই তা গ্রহণ করা হয়নি। অনুরূপ কনভেনশন ডাকতে গেলে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিত্বের পরিমাণ ও পদ্ধতি এবং প্রস্তাবিত কনভেনশনের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে গুরুতর আইনগত ও রাজনৈতিক জটিলতার সৃষ্টি হতো।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার সোপান ছয় দফা ঘোষণা করলে তৎকালীন রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। ডানপন্থী দলগুলোর পক্ষ থেকে ছয় দফাকে ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ধ্বংস করার কমিউনিস্ট ভারতের ষড়যন্ত্র বলা হয়। অন্যদিকে কিছু বামপন্থী ছয় দফার ভেতরে সিআইএকে আবিষ্কার করে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও ছয় দফার প্রবল সমালোচনা হয়। বিরোধিতা এতই প্রকট ছিল যে দলের মধ্যেই ভাঙন শুরু হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়েও রাজনৈতিক দলে বিভক্তি ছিল। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিধা ছিল। এমন রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাতীয় কনভেনশনের মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়ন অবাস্তব ধারণা। নানা মত-পথের মধ্যে সমন্বয় করতে না পারায় পাকিস্তানের ৯ বছর লেগেছে সংবিধান প্রণয়ন করতে। ভারতেরও তিন বছর লেগেছে। বাংলাদেশেও যদি সংবিধান প্রণয়নে কয়েক বছর লেগে যেত এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সংবিধান তৈরি করা হতো, তবে তা বাংলাদেশের সংবিধান নয়, পাকিস্তানের সংবিধানের রেপ্লিকা হতো।

গণপরিষদের সদস্যদের সংবিধান প্রণয়নের অধিকার নিয়ে যদি প্রশ্ন তোলা হয়, তাহলে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তথা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অন্তর্বর্তী সংবিধানও বিতর্কিত হয়ে পড়বে। কারণ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে। আর এই গণপরিষদের সদস্যরাই তো স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুমোদন করেছেন, যা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বলবৎ হয়। রাষ্ট্রপতির আদেশবলে গণপরিষদ গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতির গণপরিষদ আদেশকে যদি অবৈধ বলতে চান, তাহলে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে দাঁড়িয়ে নতুন সংবিধান তৈরির কথা বলছেন সেই রাষ্ট্রের পাটাতনটিই ধসে পড়বে। উদাহরণস্বরূপ, অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকা আদেশ, বাংলাদেশ ব্যাংক, শিল্প ব্যাংক, বাংলাদেশ বিমান, হাইকোর্ট, স্থানীয় পরিষদ, শিপিং করপোরেশন, ইনস্যুরেন্স করপোরেশন, নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, বাংলা একাডেমি, বার কাউন্সিল, বাংলাদেশ রেলওয়ে, পিডিবি, টিসিবি, এনবিআর, বিআইডাব্লিউটিসি, চট্টগ্রাম বন্দর, শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, বিডিআরসহ (বিজিবি) অসংখ্য প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রপতির আদেশে সৃষ্টি হয়েছে।

গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ে কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ার উপযোগী দলিল বাংলাদেশের সংবিধান। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা—এই চারটি মূল আদর্শের ভিত্তিতে সংবিধান প্রণীত হয়েছে। এই চারটি আদর্শের পক্ষে জনগণ পাকিস্তান আমলেই আওয়ামী লীগকে রায় দিয়েছে। এই আদর্শের জন্যই মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। তাহলে কেন এই সংবিধানকে ছুড়ে ফেলে নতুন সংবিধান তৈরি করতে হবে সংবিধান ছুড়ে ফেলা মানে তো কিছু শব্দ আর বাক্যসংবলিত গ্রন্থ ছুড়ে ফেলা নয়। তার মানে মুক্তিযুদ্ধকে ছুড়ে ফেলা। শহীদের রক্ত আর কন্যা-জায়া-জননীর আত্মত্যাগ মুছে ফেলা। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক অস্বীকার করা।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩  
এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।