ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

অফবিট

ত্রাতার বেশে আফ্রিকার তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে চীন

জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৯, ২০১৮
ত্রাতার বেশে আফ্রিকার তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে চীন ত্রাতার বেশে আফ্রিকার তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে চীন

দুনিয়ার যেখানেই অর্থসঙ্কট আর বিনিয়োগসঙ্কট সেখানেই কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার নিয়ে ত্রাতার বেশে হাজির চীন। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা—সবখানেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে একালের অর্থনৈতিক পরাশক্তি শি জিনপিংয়ের দেশ। গোটা আফ্রিকা মহাদেশে চীন সূচনা করেছে এক ‘নতুন অর্থনৈতিক রেনেসাঁ’র। কিন্তু এর পেছনেও ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়!’

ফরাসি পত্রিকা লা মঁদ (Le Monde) এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে চীনের ভালো মানুষির মুখোশের আড়ালে অন্য এক রূপ। আর তা হচ্ছে স্পর্শকাতর তথ্য চুরি।

 

৬ বছর আগে ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবাতে আফ্রিকান ইউনিয়ন (এইউ) উদ্বোধন করলো এর দৃষ্টিনন্দন আলিশান সদর দপ্তর ভবন। বলা বাহুল্য, বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে ২০ কোটি ডলার ব্যয়ে ভবনটি গড়ে দিয়েছিল চীন।  

ভবন শুধু নয়, এর এর চেয়ার-টেবিল থেকে শুরু করে যাবতীয় আসবাব ও যন্ত্রপাতি সবই সরবরাহ করেছে চীনারা। সুবিশাল এই অট্টালিকাটির প্রায় ১০০ মিটার উঁচু টাওয়ারটি আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোর সঙ্গে চীনের নতুন মিতালির প্রতীক হয়ে সগর্বে নিজের অস্তিত্বের কথা জানান দিচ্ছে।  

ভবনটি উদ্বোধনকালে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, নতুন এক আফ্রিকান রেনেসাঁ শুরুর প্রতীক এই ভবন। কিন্তু চলতি সপ্তাহে লা মঁদ-এর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এলো বিস্ফোরক তথ্য। এতে বলা হলো, মূলত আফ্রিকান ইউনিয়ন ও এর সদস্য দেশগুলোর স্পর্শকাতর তথ্য চুরি(হ্যাকিং) করার জন্যই ভবনটি নিখরচায় তৈরিই করে দিয়েছে চীনারা। টানা ৫ বছর প্রতিরাতেই এই ভবন থেকে তথ্য চুরি করে পাঠানো হতো চীনের সাংহাইয়ের সার্ভারে। ভবনটি তৈরি করার সময় চীনারা হ্যাকিংয়ের জন্য নানা গোপন যন্ত্রপাতি পুরে দেয় এতে। লা মঁদ-এর ভাষায়, ‘China inserted a backdoor allowing it access to the continental organisation’s confidential information’।

কিন্তু ধর্মের কলটি বাতাসে নড়েছে ২০১৭ সালে এসে। এ নিয়ে বিলেতের দুটি প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য মেইল ও দ্য গার্ডিয়ানও প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই দুটি পত্রিকার আগে করা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে লা মঁদ বিষয়টি নতুনভাবে তুলে ধরে।  
এতে বলা হয়, আফ্রিকান ইউনিয়নের আদ্দিস আবাবা-ভিত্তিক ইনফরমেশন টেকনোলজি ইউনিট হঠাৎই কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা লক্ষ্য করে:“প্রতিরাতে, মধ্যরাতের শুরু থেকে রাত ২টা পর্যন্ত ড্যাটা ব্যবহার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে দেখে তারা। অথচ এই সময়টায় ভবনটি বলতে গেলে ফাঁকাই থাকে। ’’ 

পরে তারা গোপনে তদন্তে নেমে দেখতে পান আরও অবাক করা ব্যাপার। মানে এখানকার সব সংরক্ষিত স্পর্শকাতর গোপন ড্যাটা সাংহাইয়ের একটি সার্ভারে নিয়মিত চলে যেতো প্রতিরাতে।  

ব্যাপারটি ধরা পড়ার পর এইউ নতুন সাইবার সিকিউরিটি সিস্টেম বসায়। তখন চীনারা বিনামূল্যে ব্যান্ড নিউ সার্ভার কনফিগার করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয় এইউ।  

উল্টো তারা পুরো ভবনজুড়ে চালায় ব্যাপক তল্লাশি। একে একে বের হতে থাকে থলের বেড়াল—দেয়ালে ও ডেস্কের নিচে পাওয়া যায় সুকৌশলে লুকানো মাইক্রোফোন। এমনকি চীনারা যে টেবিল-চেয়ার ও আসবাবপত্র সরবরাহ করেছে সেগুলোতেও লুকানো রয়েছে নানা আড়িপাতা যন্ত্র।  

চীন অবশ্য ঢালাওভাবে সব অভিযোগকেই ‘উদ্ভট’, ‘মোটেই বোধগম্য নয়’ এবং ‘হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। এইউতে নিযুক্ত চীনা দূত কুয়াং ওয়েইলিন ইথিওপীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে এসব বিশেষণ ব্যবহার করে আসল জবাব এড়িয়ে যান। তিনি শুধু লা মঁদ-এর প্রতিবেদনকে ভিত্তিহীন বলেই নিজের দায়িত্ব শেষ করেন। সঙ্গে যোগ করেন: ‘‘ আফ্রিকার নিজস্ব ব্যাপারে আমরা কখনো নাক গলাই না এবং আফ্রিকার স্বার্থরিরোধী কোনো কাজে কখনোই নিজেদের লিপ্ত করি না। ’’ 

এ বিষয়ে লা মঁদ এইউ-তে নিযুক্ত চীনা মিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কিন্তু তারা কোনো মন্তব্য দিতে রাজি হননি।

সাংবাদিকরাও অতো সহজে ছাড়ার পাত্র নন! এই তথ্য চুরি ও আড়িপাতার অভিযোগের পর আফিকার দেশগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্কে জটিলতা দেখা দেবে কিনা এমন প্রশ্ন করেন তারা। জবাবে কুয়াং ওয়েইলিন শুধু বলেন, তিনি এমনটা মনে করেন না।  
  
তথ্য চুরি বা ইনফরমেশন এসপিওনাজ কি কেবল চীন একাই করছে? লা মঁদ বলছে, এক্ষেত্রে চীনের পাশাপাশি সাহায্যদাতার বেশে ইউরোপীয়রাও একই কাজ করে যাচ্ছে। অনেক আগে থেকেই এহেন অপকর্মে লিপ্ত আছে ব্রিটেন ও ফ্রান্স।  

লা মঁদকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আফ্রিকান কূটনীতিক তো বলেই দিয়েছেন, চীনাদের ওপর তারা অতোটা অখুশি নন, যতো অখুশি অতীত ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটিশ ও ফরাসিদের প্রতি। কেননা তার ভাষায়, ‘‘ চীন তো আফ্রিকার দেশগুলোর ওপর ঔপনিবেশিকতার জোয়াল চাপায়নি। তারা তো আফ্রিকাকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা দিচ্ছে!’’ 

চীন কেবল যে এইউ’র জন্য ভবন নির্মাণ করেছে তা কিন্তু নয়। তারা এরই মধ্যে আফ্রিকার আরো দেশে নিজেদের টাকায় সুরম্য ভবন নির্মাণ করে দেবে বলে একাধিক চুক্তি করেছে। তারা  বানাবে জিম্বাবুয়ে ও রিপাবলিক অব কঙ্গোর জন্য পার্লামেন্ট ভবন। আর মিশরে? পিরামিড আর নীল নদের দেশের নতুন প্রশাসনিক রাজধানীর জন্য তারা গড়ে দেবে পুরো একটা বিজনেস ডিসট্রিক্ট। সবটাই নিখরচায়। এরই মধ্যে চীনারা মালাওয়ি, সিচেলেস, গিনি বিসাউ এবং লেসোথোর জন্য এরই মধ্যে অনুরূপ ভবন বানিয়ে ফেলেছে। আর সিয়েরা লিওনে তারা পার্লামেন্ট ভবন সংস্কার করে দিয়েছে।  

পূর্ব আফ্রিকায় প্রতি চারটি বড় প্রকল্পের একটির টাকা যোগায় চীন। আর সব ধরনের নির্মাণকাজের অর্ধেকই করে চীনারা। চীনের টাকাভরা লম্বা হাত এখন সবখানে। চীনকে এড়িয়ে যাবার সাধ্যি কারো নেই। আবার তার অর্থ নিলেও বিপদ।
আফ্রিকাসহ বিনিয়োগের জন্য লালায়িত দরিদ্র দেশগুলোকে ঝুঁকি নিয়ে হলেও চীনের হ্যাকিং নামের ডেমোক্লিসের তরবারির নিচে মাথা পেতে দিতেই হবে। ‘জেনে শুনে বিষ’ পান করা বুঝি একেই বলে!

বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০১৮
জেএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।