ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ মে ২০২৪, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

বিদেশে নিয়ে সাইবার প্রতারণার ট্রেনিং!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০২২
বিদেশে নিয়ে সাইবার প্রতারণার ট্রেনিং!

ঢাকা: রাজধানীর পল্টন থেকে মানবপাচারকারী চক্রের মূলহোতাসহ তিনজনকে আটক করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এ সময় তাদের কাছ থেকে তিনটি পাসপোর্ট, চারটি মোবাইল ফোন, একটি রেজিস্ট্রার, মানবপাচার সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র ২৫০ পৃষ্ঠা ও নগদ পাঁচ হাজার ১৬ টাকা উদ্ধার করা হয়।

মঙ্গলবার (০৬ সেপ্টেম্বর) র‌্যাব-৩ এর অপারেশন অফিসার সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) ফারজানা হক বাংলানিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

আটক মানবপাচারকারীরা হলেন নাজমুল ইসলাম (৩০), নূর ইসলাম সাজ্জাদ (২৫), মো. সিরাজুল ইসলাম পঞ্চায়েত (৫৭)।

এএসপি ফারজানা হক বলেন, রাজধানীর পল্টন এলাকায় একটি মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা কম্বোডিয়ায় উচ্চ বেতনে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি দেওয়ার মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশ গমনে ইচ্ছুক বেকার যুবক-তরুণীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করছে। তারা বিদেশে গিয়ে সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন এমন সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর পল্টন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তাদের আটক করা হয়।

তিনি বলেন, প্রাথমিক অনুসন্ধান ও আটকদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা সংঘবদ্ধ মানবপাচার চক্রের সদস্য। এ চক্রের মূলহোতা কম্বোডিয়া প্রবাসী নাজমুল ইসলাম। তিনি বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে উচ্চ বেতনে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি দেওয়ার নাম করে ভুক্তভোগী এবং তাদের অভিভাবকদের প্রলুব্ধ করেন। তিনি দালালদের মাধ্যমে শিক্ষিত, কম্পিউটার বিষয়ে পারদর্শী বেকার যুবক ও তরুণীদের প্রলুব্ধ করে থাকেন। কম্বোডিয়ায় পাঠানোর খরচ বাবদ প্রাথমিকভাবে তারা চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে থাকেন।

তিনি আরও বলেন, আগ্রহী বেকার যুবক ও তরুণীদের প্রথমে কম্পিউটার বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে কম্বোডিয়া প্রবাসী আলীম ও শরিফুলের সহায়তায় তাদের জন্য কম্বোডিয়ান ট্যুরিস্ট ই-ভিসা করা হয়। তারপর তাদের প্লেনে কম্বোডিয়ায় পাঠানো হয়। কম্বোডিয়ায় যাওয়ার পর নাজমুলের সহযোগী কম্বোডিয়া প্রবাসী রাকিব, রফিকের সহায়তায় প্রথমে ভুক্তভোগীদের কম্বোডিয়া প্রবাসী আরিফের হোটেলে নিয়ে তাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট ছিনিয়ে নেওয়া হয়। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করার পর তাদের কম্পিউটার বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য কম্বোডিয়া প্রবাসী কামাল ওরফে লায়ন কামাল ও আতিকের সহায়তায় একটি বিদেশি ট্রেনিং সেন্টারে নেওয়া হয়। সেখানে বিদেশি প্রশিক্ষকরা ভুক্তভোগীদের গুগল ট্রান্সলেটের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছদ্মনামে অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করে অন্যদের সঙ্গে কীভাবে প্রতারণা করা যায়, ভুয়া ক্লোন ওয়েবসাইট ব্যবহার করে ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা আত্মসাৎ করার কৌশল, ভুয়া নাম্বার থেকে ফোন কল দিয়ে বা চ্যাটিং করে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার নামে কৌশলে ডিপোজিট হাতিয়ে নেওয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভয়েস কল ও ভিডিও কল রেকর্ডিং করে পরবর্তীতে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ আত্মসাৎ করার কৌশল শেখানো হয়। মানবপাচারকারীদের ভাষায় সাইবার প্রতারণার বিষয়টি ‘স্ক্যামার’ হিসেবে পরিচিত।

এএসপি ফারজানা বলেন, ট্রেনিং শেষে ভুক্তভোগীদের একটি বিদেশি কোম্পানির কাছে দুই হাজার থেকে তিন হাজার ডলারের বিনিময়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তারপর ভুক্তভোগীদের একটি সুরক্ষিত ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই ভবনে যাওয়ার পর ভুক্তভোগীদের দেহ তল্লাশি করে সব প্রকার ইলেকট্রনিক ডিভাইস ছিনিয়ে নেওয়া হয়। তারপর তাদের একটি কম্পিউটার ল্যাবে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি বড় কক্ষে ৩০০ থেকে ৪০০ কম্পিউটার সাজানো থাকে। মানবপাচারকারীদের ভাষায় ওই ল্যাবকে ‘ক্যাসিনো’ বা প্ল্যাটফর্ম বলা হয়।

তিনি বলেন, কেউ টার্গেট সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে বা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে শারীরিক ও মানষিকভাবে নির্যাতন করে তার খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই ক্যাসিনো বা প্ল্যাটফর্মগুলোতে কঠোর নিরাপত্তা বজায় রাখা হয়। সেখান থেকে কারও পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেউ কাজ থেকে অব্যাহতি চাইলে তাকে কিনতে যে ডলার ব্যয় হয়েছে তার দ্বিগুণ অর্থ ফেরত দিতে বলা হয় ও তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে কোনো অভিযোগ করবে না এ মর্মে অঙ্গীকারনামাও নেওয়া হয়। তখন ভুক্তভোগীকে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ থেকে টাকা সংগ্রহ করে ওই কোম্পানিতে ফেরত দিয়ে কম্বোডিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি দালালদের আশ্রয়ে যান। তখন দালালরা ভুক্তভোগীদের পুনরায় আরেকটি সাইবার প্রতারক কোম্পানিতে বিক্রি করে দেন। যদি কেউ দেশে ফিরতে চায়, তখন দেশে ফেরত যাওয়ার শর্ত হিসেবে আরও গ্রাহক সংগ্রহ করে দেওয়ার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। এ সময়ে ভিকটিমের কম্বোডিয়ায় থাকা খাওয়ার খরচ নিজেকে বহন করতে হয়। ভুক্তভোগীর কোনো রোজগার না থাকায় তারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে অবৈধ কাজ করতে বাধ্য হন।

আটকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও জানান এএসপি ফারজানা।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০২২
এসজেএ/আরআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।