ঢাকা, সোমবার, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

রেহেনার জীবনের মূল্য মাত্র চার লাখ টাকা!

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৬ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০২২
রেহেনার জীবনের মূল্য মাত্র চার লাখ টাকা!

ফরিদপুর: ফরিদপুরের সালথা উপজেলার মা ও শিশু স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ভিজিটর রোকেয়া বেগমের নিজ বাসায় গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে মারা যাওয়া সেই তিন সন্তানের জননী রেহানা বেগমের জীবনের মূল্য চার লাখ টাকায় মীমাংসা করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। টাকাটা নিহত রেহানার পরিবারকে দেবেন অভিযুক্ত ভিজিটর রোকেয়া।

বুধবার (৩১ আগস্ট) সকালে নিহত রেহেনার মেয়ে রিতা আকতার সালিশের মাধ্যমে মীমাংসার কথা বাংলানিউজকে নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে সোমবার (২৯ আগস্ট) দিনগত রাতে সালিশে উপস্থিত ব্যক্তিরা এ রায় দেন।  

অতিরিক্ত টাকার লোভে ফরিদপুরে নিজ বাসায় গোপনে গর্ভপাত ঘটানোর অভিযোগ ওঠে ভিজিটর রোকেয়া বেগমের বিরুদ্ধে। গত শুক্রবার (২৬ আগস্ট) তার বাসায় রেহানা বেগম (৪০) নামে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারীর গর্ভপাত করাতে গেলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান তিনি। এ ঘটনার পর থেকে রোকেয়া গা ঢাকা দেন।  

অভিযোগ রয়েছে, অবৈধভাবে রোকেয়া তার বাসায় বিভিন্ন এলাকার নারীদের গর্ভপাত ঘটান। এতে মৃত্যুঝুঁকি থাকে বলে জানা যায়। গর্ভপাতে মারা যাওয়া রেহানা সালথা উপজেলার কানাইড় গ্রামের কৃষক আজিজুল শেখের স্ত্রী। তার ৩টি মেয়ে রয়েছে।

ঘটনাটি নিয়ে রোববার (২৮ আগস্ট) বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর টনক নড়ে অভিযুক্ত ভিজিটর রোকেয়ার। তিনি তড়িঘড়ি করে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের দারস্থ হয়ে সোমবার (২৯ আগস্ট) দিনগত রাত ৮টার দিকে ফরিদপুর শহরের একটি শ্রমিক ইউনিয়ন অফিসে সালিশ-মীমাংসায় বসেন। এ সময় তাকে চার লাখ টাকা জরিমানা করেন সালিশ-বৈঠকে উপস্থিত নেতারা।  

সালিশ-বৈঠকে উপস্থিত থাকা সালথার গট্টি ইউপি চেয়ারম্যান মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ফরিদপুর পৌরসভার কাউন্সিলর গোলাম নাসির, স্থানীয় ইউপি সদস্য পারভেজ মাতুব্বর, সাবেক ইউপি সদস্য কুদ্দুস মোল্যা, খোরশেদ খাঁন, জাহিদ মাতুব্বরসহ স্থানীয় নেতাদের উপস্থিতিতে রেহানার মৃত্যুর বিষয়টি মীমাংসা করা হয়েছে। সালিশে চার লাখ টাকা রোকেয়াকে জরিমানা করা হয়। জরিমানার এই টাকা রেহানার অসহায় পরিবার পাবে।  

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, কি করবো বলেন- রেহানার পরিবার অনেক গরিব। তাই বিষয়টি নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি না করে মীমাংসা করে দিলাম। স্থানীয় ইউপি সদস্য পারভেজ মাতুব্বর বলেন, স্থানীয় নেতাদের উপস্থিতিতে বিষয়টি চার লাখ টাকায় মীমাংসা হয়েছে।  

মীমাংসা হওয়ার পর নিহত রেহানার মেয়ে রিতা আকতারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি তিনি বাংলানিউজের কাছে তিনি স্বীকার করেন।  

রিতা বলেন, স্থানীয় কিছু নেতারা বসে ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে এ ঘটনায় মীমাংসা করেন। মীমাংসার টাকাটা আমার তিন বছরের ছোট বোনটাকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমরা টাকাটা নিতে চাইনি। কারণ আমার মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে আপস করলে আমার মায়ের আত্মা কষ্ট পাবে।

এসময় রিতা বলেন, রোকেয়া নামের ওই ভিজিটর আমার পরিবারটাকে এতিম করে দিয়েছে। এছাড়া সে (ভিজটর রোকেয়া) আমাদের কাছে অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে। আমি ক্ষমা করিনি। কারণ, ক্ষমা করার মালিক আল্লাহ ও আমার মৃত মা।

রিতা আরও বলেন, আমাদের ঘরটা অন্ধকার করে দিয়েছে। এদেশে আমাদের মতো গরিব মানুষের জন্য কোনো বিচার নাই। আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি। আল্লাহ এর বিচার করবেন।

স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিবর্গ ঘটনাটি মীমাংসা করতে আপনাদের কোনো চাপ সৃষ্টি করেছিল কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে রিতা বলেন, টাকা পয়সার কাছে সবাই বিক্রি হয় যায়। তাই কার কাছে বিচার দেব বলেন? 

এদিকে ঘটনাটি মীমাংসার আগে নিহত রেহানার মেয়ে রিতা আকতার অভিযোগ করে বলেছিলেন, আমার মা পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ৪০ বছর বয়সে আবার সন্তান জন্ম দেওয়ার বিষয়টিতে তিনি লজ্জা পাচ্ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে ভিজিটর রোকেয়ার কাছে গেলে তিনি তার মাকে গর্ভপাত করার পরামর্শ দেয়। তার কথা মতো গত বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট) রোকেয়ার ফরিদপুর শহরের আলীপুর বাসায় নিয়ে গর্ভপাতের জন্য মাকে প্রথমে ওষুধ খাওয়ায়। এতে প্রসব ব্যথা শুরু হলে আমার মা ছটফট করতে থাকেন। এ সময় ৫ হাজার টাকাও নেন রোকেয়া।  

তিনি আরও বলেন, এতে মায়ের শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হতে থাকে। শুক্রবার (২৬ আগস্ট) সকালে রোকেয়া আরও পাঁচ হাজার টাকা দাবি করে বলেন, তা না হলে তোমার মাকে ফরিদপুর মেডিক্যালে নিয়ে যাও। তার অবস্থা খারাপ। আমি কিছু করতে পারবো না। তখন আমি মাকে ফরিদপুর মেডিক্যালে নিয়ে গেলে চিকিৎসা শুরু করার আগেই সকাল ১১টার দিকে আমার মা মারা যান।  

তবে, অভিযোগ ওঠা ভিজিটর রোকেয়া বেগম সব অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে বাংলানিউজকে বলেন, আমি তো অসুস্থ। এছাড়া ঘটনাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে।  

রোকেয়া বলেন, নিহত মহিলা (রেহেনা) এলোমেলো ওষুধ খেয়ে রক্তক্ষরণ হলে আমার কাছে আসেন। পরে তার অবস্থা বেগতিক দেখে শিগগিরই তাকে ফরিদপুর মেডিক্যাল হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলি। এরপর কি হয়েছে তা আর জানিনা। তবে পরে ওই নারীর মৃত্যু হয়েছে বলে জানতে পেরেছি।

সালিশের ব্যাপারে রোকেয়া বলেন, একটা সালিশ হয়েছে। তবে টাকার বিনিময়ে মীমাংসার ব্যাপারটি সঠিক না।

এ ব্যাপারে ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) সুমন রঞ্জন সরকার বাংলানিউজকে বলেন, রেহানার মৃত্যুর বিষয়টি মীমাংসা হয়েছে কি না, তা আমার জানা নেই। আপনাদের কাছ থেকেই এখন শুনলাম। এছাড়া পরিবার যদি বিচার না চায় সেক্ষেত্রে পুলিশের একার পক্ষে কাজ করাটা বেশ দুরূহ।  

পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, রেহানার মৃত্যুর বিষয়ে তার পরিবার থানায় একটি জিডি করেছে। লাশ ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আসার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩১০ ঘণ্টা, আগস্ট ৩১, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।