ঢাকা, সোমবার, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

আইনের ফাঁক গলে তামাক চলে বীরদর্পে (৩য় পর্ব)

স্মোকিং জোনের কারণে অরক্ষিত পাবলিক প্লেস

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২৯ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০২২
স্মোকিং জোনের কারণে অরক্ষিত পাবলিক প্লেস

তামাক জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশের অন্যতম প্রধান শত্রু। তামাকের এই সর্বগ্রাসী ক্ষতি প্রতিরোধে সরকার জনস্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসির) আলোকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ প্রণয়ন করে।

২০১৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীও আনা হয়।

এরপরও বর্তমান আইনের ফাঁক গলে তামাকজাত পণ্যগুলো চলছে বীরদর্পে। এ কারণেই আইনের সঠিক প্রয়োগ ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন কিছু বিষয় সংযোজনসহ আইনকে সময়োপযোগী করে সংশোধনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ৩ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন করেছেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সোলায়মান হাজারী ডালিম। ৩য় ও শেষ পর্বে থাকছে পাবলিক প্লেসে ‘স্মোকিং জোনে’র বিষয়ে।

নাজিফা তাসনিম খানম তিশা, পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। ধূমপানের পরোক্ষ ভুক্তভোগী তিনি। বাংলানিউজকে নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন তিশা। বলেন, আমার আশপাশে যখন লম্বা সময় দুই-তিনজন সিগারেট পান করেন, রাতে  ঘুম হয় না। শ্বাসকষ্ট হয়।

তিশার মতো এমন ভুক্তভোগী আছেন হাজারো। প্রতিনিয়ত ধূমপানের পরোক্ষ ক্ষতির শিকার হচ্ছেন তারা। কিন্তু প্রতিকার নেই কোথাও। তিশা বলেন, সব জায়গায় দেখা না গেলেও এখন কিছু কিছু জায়গায় স্মোকিং জোন। তাও পাবলিক প্লেসে। যেখানে কোনো ধরণের বিশেষ ব্যবস্থাপনা নেই। এসব জোনে গিয়ে ধূমপান করলেও ধোঁয়া চলে আসে বাইরে। সাধারণ মানুষ এর শিকার হচ্ছেন।

ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাফসান জানান, প্রায় সময় রেস্টুরেন্ট খেতে গেলেও সিগারেটের ধোঁয়ার শিকার হতে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তারা স্মোকিং জোনের দোহাই দেন। যে কারণে তাদের কিছু বলাও যায় না।

দেশের আইন যদি পাবলিক প্লেসে ধূমপায়ীদের জন্য জায়গা করেই দেয়, তবে অধূমপায়ীরা রেহাই পাবে কীভাবে, প্রশ্ন তিশা-রাফসানদের।

অধূমপায়ীদের ভাষ্য, দেশে ধূমপায়ীরা আইনের তোয়াক্কা করেন না। তার ওপরে আইনেই সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে জনসমাগম হয় এমন এলাকায় আলাদা করে ধূমপানের জায়গা করে দেওয়ার। এতে ধূমপায়ীরা আরও বেশি উৎসাহিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন অধূমপায়ীরা। এক্ষেত্রে আইন সংশোধন প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে বিভিন্ন অফিস, হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও বিমানবন্দর এলাকায় ধূমপানের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থান ঠিক করে দেওয়ার কথা বলা আছে। তারপরও ধূমপানের পরোক্ষ শিকার থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষা করা যাচ্ছে না।

ধূমপান বিরোধী সংগঠন ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হলেও সেখান থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে আশপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। অধূমপায়ীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। ফলে কোনোভাবে ধূমপানের প্রভাব থেকে তাদের মুক্ত করা যাচ্ছে না।

তামাক বিরোধীরা বলছেন, ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বহাল রেখে অধূমপায়ীদের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। নির্ধারিত আইনও সক্রিয় নয়। ধূমপায়ীদের কারণে কর্মস্থলসহ বিভিন্ন জায়গায় নারী ও শিশুরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এক্ষেত্রে দ্রুত আইনের সংশোধন প্রয়োজন।

কানাডা, স্পেন, নেপালসহ বিশ্বের ৬৩টি দেশে পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত জায়গা নিষিদ্ধ করে আইন রয়েছে। অথচ বাংলাদেশের আইনে পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা, চার দেয়ালে আবদ্ধ এক কক্ষ বিশিষ্ট নয় এমন রেস্টুরেন্ট, একাধিক কক্ষবিশিষ্ট গণ-পরিবহন (ট্রেন, লঞ্চ) ও অযান্ত্রিক পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের স্থান রাখা যাবে। এমন বিধানের কারণে আইনের ফাঁকে তামাক জাতীয় পণ্যের ব্যবহার চলছে বীরদর্পে।

এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৮’র গাইডলাইন ও অসংখ্য গবেষণা দ্বারাও এটি স্বীকৃত যে, স্মোকিং জোনের আশপাশের স্থানগুলো কখনও ধোঁয়ামুক্ত হয় না। এজন্য নির্ধারিত স্থান বিলুপ্তসহ সকল পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ করা জরুরি। একইসঙ্গে শতভাগ ধূমপান মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতও গুরুত্বপূর্ণ।

অধূমপায়ীদের রক্ষায় বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান বা ডেজিগনেটেড স্মোকিং জোন বিলুপ্ত করতে হবে। চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ নয় এমন রেস্তোরাঁসহ সব ধরনের হোটেল, পাবলিক প্লেস, কর্মক্ষেত্র এবং একাধিক কামরা বিশিষ্ট যান্ত্রিক পরিবহন ও সকল অ-যান্ত্রিক গণ-পরিবহনে ধূমপান সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে। পাশাপাশি ধূমপান মুক্ত ভবন বলতে সেই ভবনের বারান্দাসহ সকল আচ্ছাদিত স্থানকেও আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭’র তথ্য মতে, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন এমন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ৮১ লাখ (৪২ দশমিক ৭ শতাংশ) পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। প্রায় ২ কোটি ৫০ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ গণ-পরিবহনে যাতায়াতের সময় (২৪ শতাংশ), রেস্তোরাঁয় (১৪ দশমিক ৭ শতাংশ) এবং চা-কফির দোকানে ৩৬ দশমিক ২ শতাংশ পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হয়ে থাকে।

বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর প্রধান ৮টি কারণের ছয়টির সঙ্গেই তামাক জড়িত। গ্যাটস’র প্রতিবেদন অনুসারে, তামাক ব্যবহারকারীদের হৃদরোগ, স্ট্রোক, সিওপিডি বা ফুসফুসের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ৫৭ শতাংশ। তামাকজনিত অন্যান্য ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি ১০৯ শতাংশ বেশি। এ কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজারেরও বেশি মানুষ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারজনিত রোগে মারা যান।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল’র (এফসিটিসি) ধারা ৮ ও এ সংক্রান্ত গাইডলাইন অনুযায়ী, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার থেকে অধূমপায়ীদের রক্ষায় ‘পূর্ণাঙ্গ ধূমপান মুক্ত নীতিমালা’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এফসিটিসি’র সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছেন।

তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন- ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) এ ‘পাবলিক প্লেস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, আধা-সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, লিফট, আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্র (ইনডোর ওয়ার্ক প্লেস), হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, আদালত ভবন, বিমানবন্দর ভবন, সমুদ্রবন্দর ভবন, নৌ-বন্দর ভবন, রেলওয়ে স্টেশন ভবন, বাস টার্মিনাল ভবন, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণী ভবন, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, শিশুপার্ক, মেলা বা পাবলিক পরিবহনে আরোহণের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারি, জনসাধারণ কর্তৃক সম্মিলিতভাবে ব্যবহার্য অন্য কোনো স্থান অথবা সরকার বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক, সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা, সময় ঘোষিত অন্য যেকোনো বা সকল স্থান এবং এ সমস্ত স্থানে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এই আইনে পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ করলেও এসব এলাকায় স্মোকিং জোন রাখার বিধান করা হয়েছে। স্মোকিং জোন হিসেবে আইনে বলা হয়েছে, কোনো পাবলিক প্লেস বা পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্দিষ্টকৃত কোনো এলাকাই হলো ধূমপান এলাকা।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় ঢাকা আহছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টরের পরিচালক ইকবাল মাসুদের সঙ্গে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী একটা ডিবেট আছে স্মোকিং জোন নিয়ে। প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় এটা আসলে কার্যকর হয় না। এই জোন থেকে ধোঁয়া লিকেজ হয়ে আশপাশের জায়গাগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে। যে কারণে এফসিটিসি এটাকে গ্রহণ করেনি। তারা মনে করে, পাবলিক প্লেস হতে হবে শতভাগ ধূমপান মুক্ত। সেখানে ধূমপায়ীদের জন্য কোনো ধরনের স্মোকিং জোন রাখা যাবে না। কারণ, এটা মেইনটেনেন্স করা যায় না। ভেন্টিলেশন হয় না।

সরকারের কাছে দাবী রেখে ধূমপান বিরোধী এ সংগঠক বলেন, পাবলিক প্লেসে ধূমপানের কারণে আন্তর্জাতিকভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণের যে রেটিং সেখানে আমরা দুর্বল হয়ে গেছি। আইনে ধূমপায়ীদের জন্য পাবলিক প্লেসে স্থান নির্ধারিত রাখার যে বিধান রয়েছে এটা যেন বাদ দেওয়া হয়।

স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক আহম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, খুব দ্রুত আমরা এটি করতে পারব না। আগে আমাদেরকে এর কুফলগুলো নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। এরপর একটা পর্যায়ে গিয়ে স্মোকিং জোন বন্ধ করা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে সিগারেটের ধোঁয়াকে কোনোভাবেই আটকে রাখা যায় না। তা বেরিয়ে আসবে এবং তা পরিবেশের সঙ্গে মিশে গিয়ে মানুষের ক্ষতি করবে। কারণ, স্মোকিং জোনগুলোয় ভেন্টিলেশনের কোনো ব্যবস্থা নেই।

জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সদস্য সচিব  ও স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব আলী হোসেন খন্দকার বলেন, এ বিষয়ে তামাক বিরোধী সংগঠকরা বলে আসছেন। এটার বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন। আইনের সংশোধনীর সময় আমরা আশা রাখছি এটারও সংশোধন হবে। পাবলিক প্লেস পুরোপুরিভাবে ধূমপান মুক্ত হোক এটা সরকারও চায়।

আরও পড়ুন :

এসব যেন তামাকপণ্যই না!

বাহারি কায়দায় চলে তামাকের প্রচার

বাংলাদেশ সময় : ১৫২৫ ঘণ্টা, ৩০ জুলাই, ২০২২
এসএইচডি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।