ঢাকা, সোমবার, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ মে ২০২৪, ০৪ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

আইনের ফাঁক গলে তামাক চলে বীরদর্পে (২য় পর্ব)

বাহারি কায়দায় চলে তামাকের প্রচার

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩০ ঘণ্টা, জুলাই ২২, ২০২২
বাহারি কায়দায় চলে তামাকের প্রচার

জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশের অন্যতম প্রধান শত্রু তামাক। এর সর্বগ্রাসী ক্ষতি প্রতিরোধে সরকার জনস্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিয়ে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল’র (এফসিটিসির) আলোকে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ প্রণয়ন করে।

২০১৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীও আনা হয়। তারপরও আইনের ফাঁক গলে তামাকজাত পণ্যগুলো চলছে বীরদর্পে। তাই সংশ্লিষ্ট আইনের সঠিক প্রয়োগ ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন কিছু বিষয় সংযোজনসহ আইনকে সময়োপযোগী করে সংশোধনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে ৩ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদন করেছেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সোলায়মান হাজারী ডালিম। ২য় পর্বে থাকছে আইন লঙ্ঘন করে তামাক পণ্যের প্রচারের কথা।

একটি চতুষ্কোণ স্টিকারের সাদা জমিনের ওপর চারপাশে নীল রঙয়ের বর্ডার। শহরের বিভিন্ন দোকানের উন্মুক্ত স্থানের দেয়ালে সাঁটানো এ স্টিকারের সবার ওপরে লেখা ‘এখানে ন্যায্য বাজার মূল্যে পণ্য বিক্রয় করা হয়’, তার নিচে বড় অক্ষরে লেখা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেটের দাম। একদম নিচে ছোট অক্ষরে লেখা পানি ১৫ টাকা, বিস্কুট ৫ টাকা।

রাজধানী থেকে শুরু করে মফস্বল- প্রায় সবখানেই চোখে পড়ে তামাকের এমন প্রচারণা। কায়দা করে ছোট ছোট চকলেটের বাক্সেও বিক্রি করা হয়। কিন্তু তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, এ জাতীয় পণ্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু প্রতিনিয়ত চোখে পড়া এমন বিজ্ঞাপনের প্রচার আইন না মানার শামিল। অনেকেই মনে করেন, আইনের কোনো ফাঁক আছেই, যা গলে অভিনব কায়দায় তামাকজাত পণ্য বিক্রির প্রচার।

উৎসাহিত হচ্ছে নতুনরা
দোকানিরা বলছেন, তামাকজাত প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ধরণের অভিনব কায়দায় প্রচার দেখে যারা সাধারণত ধূমপান করেন না, তারাও উৎসাহিত হন। তারা ছাড়া বিক্রিও বাড়ে। রাজধানীর মহাখালী ওয়ারলেস গেট এলাকার চা-সিগারেট বিক্রেতা হামিদুর রহমান বলেন, দোকানের গায়ে স্টিাকারগুলো লাগানোর অনেক সুবিধা, কোম্পানির লোকরাই এসে এসব লাগিয়ে যায়। যারা সিগারেট পান করেন তারা স্টিকারগুলো দেখেই বুঝতে  পারে দোকানে কোন কোন সিগারেট আছে এবং সেগুলোর দাম কেমন। নতুন যারা সিগারেট পানের চিন্তা করে তারাও খুব সহজে এর দাম জেনে যায়। ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট ও ফেনীর কয়েকজন সিগারেট বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায় আরও বিভিন্ন কৌশলে সিগারেটের প্রচার করে কোম্পানিগুলো।

বিক্রেতাদের জন্য লোভনীয় উপহার
তামাকজাত পণ্যের কোম্পানিগুলো সিগারেট বিক্রির ওপর লক্ষ্যমাত্রা, সেরা বিক্রেতাদের নাম তামাক কোম্পানির বিশেষ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা, আকর্ষণীয় উপহার সামগ্রী প্রদান ও প্রয়োজনীয় গৃহস্থালি সরঞ্জাম, যেমন- বিছানা চাদর, আলমিরা, প্রেশার কুকার, রাইস কুকার, ব্লেন্ডার এবং বিলাসী সামগ্রী, সোনার কয়েন, এলইডি টিভি, এয়ার কন্ডিশনার, ফ্রিজ এবং দামি গিফট ভাউচার ইত্যাদি দিয়ে থাকে।

এছাড়া কোম্পানিগুলো ডিলার, পাইকার এবং খুচরা বিক্রেতাদের উৎসাহ প্রদানের জন্য ডিনার ও দেশে-বিদেশে বিনামূল্যে ভ্রমণের ব্যবস্থাও করে থাকে। অনেক সময় অনেক দোকানীকে ব্যবসা করার জন্য পুঁজিও দিয়ে থাকে তামাক কোম্পানিগুলো। ফেনী রেলওয়ে ষ্টেশন এলাকার হারিস আহমেদ পুঁজি পাওয়াদের মধ্যে একজন। নাম উল্লেখ না করলেও একটি সিগারেট কোম্পানির কর্মকর্তা তাকে এ ব্যবসার জন্য অর্থ দিয়েছিলেন বলে জানান।

আইন যা বলছে
আইনে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ। কিন্তু বিজ্ঞাপন চলছে প্রতিনিয়ত। বিভিন্ন কায়দায় সিগারেট বিক্রির বিজ্ঞাপন চলে। কখনও রাস্তার পাশে দেয়ালে, কখনও ছোট দোকানগুলোর সামনে স্টিকার বা ফ্লাই-রিলিজে। আবার কখনও কোম্পানি বেতন দিয়ে তরুণ-তরুণীদের মাধ্যমে সিগারেটের বিজ্ঞাপন করে থাকে। প্রকাশ্যে ধূমপানও এক প্রকার বিজ্ঞাপন। বাংলাদেশে বিদ্যমান তামাক আইনের এফসিটিসির ধারা ১৩ অনুযায়ী, বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু আইনে এ বিষয়টি পরিষ্কার করে নিষিদ্ধ না করায়, কোম্পানিগুলো দোকানগুলোয় তামাকদ্রব্যের মোড়কে সাজিয়ে দিচ্ছে, যা পরোক্ষ বিজ্ঞাপন। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করার ফলে দৈনিক ধূমপানের প্রবণতা প্রায় ৭ শতাংশ হ্রাস পায়। বাংলাদেশেও আইন সংশোধন করে সিগারেটের ব্র্যান্ডের প্রদর্শন কমলে ব্যবহারও কমবে।

বিশ্বের ৬২টি দেশে তামাক কোম্পানির সব ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচি বা সিএসআর নিষিদ্ধ। কিন্তু দেশের আইন অনুসারে তামাক কোম্পানির সিএসআর নিষিদ্ধ নয়। সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল বলছে সংশ্লিষ্ট আইনের ধারা-৫ এর উপধারা (ছ) অনুসারে, বিড়ি-সিগারেট বিক্রয়স্থলে যেকোনো উপায়ে এসবের বিজ্ঞাপন প্রচার করবেন না বা করাবেন না। এ মর্মে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাও দেওয়া আছে।

ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডাব্লিউবিবি) ট্রাস্ট তামাক বিরোধী জোটভুক্ত সংগঠনসমূহের সহায়তায় ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আইন লঙ্ঘনের চিত্র চিহ্নিত ও পর্যালোচনার মাধ্যমে প্রতিবেদন আকারে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়েছে। কিন্তু তার প্রচার বন্ধ হচ্ছে না।

বিক্রয়কেন্দ্রগুলোই প্রচারের হাতিয়ার
ডাব্লিউবিবি ট্রাস্টের এক গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকজাত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বিক্রয়কেন্দ্রগুলোকে বিজ্ঞাপন প্রচারের প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। দেশব্যাপী হাট-বাজারে, বাস-সিএনজি স্ট্যান্ড, রাস্তা-ঘাটে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিকের সামনে তামাক কোম্পানিগুলোর বিক্রয়স্থল বেশি লক্ষ্য করা যায়।

সবচেয়ে বেশি (৪৯ শতাংশ) বিক্রয়স্থল পাওয়া গেছে বাস-সিএনজি স্ট্যান্ডের আশপাশে, সবচেয়ে কম (৬ শতাংশ) অফিস-আদালত এলাকায়। হাটবাজারে বা এর পাশে ৪৮ শতাংশ, হাসপাতাল, ক্লিনিকের পাশে ১৯ শতাংশ, বিনোদন কেন্দ্রের আশপাশে ৯ শতাংশ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে ১৬ শতাংশ তামাকপণ্য বিক্রয়কেন্দ্র দেখা যায়।

গবেষণায় আরও বলা হয় বিভিন্ন সময়ে তামাক কোম্পানিগুলোকে বিজ্ঞাপন প্রচারের কৌশল পরিবর্তন করে। যেমন, বাজেট চলাকালীন ন্যায্যমূল্যে সিগারেট বিক্রয়ের তথ্যসহ ব্রান্ডগুলোর নাম বড় বড় অক্ষরে লিখে স্টিকার করা মাধ্যমে তামাক কোম্পানিগুলোর অন্যতম কৌশল। মূলত, বিজ্ঞাপন প্রদানের মাধ্যমে ব্র্যান্ড প্রমোশন করাই ধূর্ত তামাক কোম্পানিগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য।

যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা
তামাক বিরোধী জোটের সংগঠকরা বলছেন, কোম্পানিগুলো আইন লঙ্ঘন করলেও দোকানদারদের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করে। এ জন্য কোম্পানিগুলোকে সরাসরি ধরাও যায় না। অধিকাংশ সময় কোম্পানিগুলো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। কিন্তু তাদের সরাসরি শাস্তির আওতায় আনা প্রয়োজন।

যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস’র আর্থিক সহায়তায় ঢাকা আহছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য শাখা পরিচালিত একটি  গবেষণায় বলা হয়, দেশে তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপন ও পণ্য প্রচারের বিষয়ে আইনত নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ৭৭ শতাংশ বিপণিবিতানে তামাক পণ্যের (বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, গুল ইত্যাদি) বিজ্ঞাপন ও প্রসারে কার্যক্রম দেখা গেছে।

এ প্রসঙ্গে কথা হয় ঢাকা আহছানিয়া মিশনের স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টরের পরিচালক ইকবাল মাসুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের বর্তমান আইনে তামাকে প্রচারের বিষয় নিষিদ্ধ। এটা যারা করছেন, অন্যায় করছেন। যারা দোকানে সিগারেট সাজিয়ে প্রকাশ্যে প্রদর্শন করেন; আইনের আলোকে তারা এটা করতে পারেন না।

তিনি আরও বলেন, আইনে সংশোধনীর মাধ্যমে আরও ক্লিয়ার করতে হবে কোনো কৌশলেই যেন কেউ তামাক পণ্যের প্রচার করতে না পারে। এ ব্যাপারে আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তামাক ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতনতা করা প্রয়োজন। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অমান্য করলে জেল ও জরিমানার বিধান রয়েছে এ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলকে এ বিষয়ে আরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো সিগারেটের প্যাকেটকে গুছিয়ে দোকানগুলোর ভালো একটা জায়গায় সাজিয়ে দেয়। যাতে তাদের পণ্যটি খুব সহজে নজরে আসে। এর ফলে যা হয়, যারা নিয়মিত ধূমপায়ী তারা যেভাবে আকৃষ্ট হয় তেমনি ভাবে আকৃষ্ট হয় অধূমপায়ী কিশোর ও তরুণরা।

তিনি মনে করেন, সিগারেটের প্রচার বন্ধ করার সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হলো বিক্রয় কেন্দ্রে প্রকাশ্যে প্রদর্শন বন্ধ করা। এটা করা গেলে তামাকের প্রসার অনেকটাই কমে আসবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি ড. আতিউর রহমান বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও স্বার্থান্বেষী মহল প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। তাই এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সকল অংশীজনকে সচেষ্ট থাকতে হবে।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বিষয়ে, জনস্বাস্থ্য অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব সৈয়দ মজিবুল হক বলেন, আইন মানতে হবে। আইন মানার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চান বাংলাদেশ তামাক মুক্ত হবে। সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে সরকার। সংশোধনের মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে আরও শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া চলছে। মানুষকে এই প্রাণঘাতী পণ্য থেকে দূরে রাখতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।  

পড়ুন- আইনের ফাঁক গলে তামাক চলে বীরদর্পে (১ম পর্ব)
এসব যেন তামাকপণ্যই না!

বাংলাদেশ সময় : ১৬২২ ঘণ্টা, ২২ জুলাই, ২০২২
এসএইচডি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।