ঢাকা, সোমবার, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

পদ্মা সেতু: ফেনীতে মাছের ব্যবসায় হাজার কোটি টাকার হাতছানি

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৫ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০২২
পদ্মা সেতু: ফেনীতে মাছের ব্যবসায় হাজার কোটি টাকার হাতছানি

ফেনী: বর্তমান সরকারের নেওয়া মেগা প্রকল্পগুলোর অন্যতম একটি পদ্মা সেতু। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণের দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে লালিত স্বপ্নের এ সেতুটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে আগামী ২৫ জুন।

সেতু চালুর ফলে দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব বাড়বে ব্যাপক আকারে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় প্রসার ঘটবে এটা অনুমেয়। কিন্তু পদ্মা সেতুর কারণে বহু দূরের জনপদ ফেনীতেও যে ব্যবসার আকার বাড়বে, তা হয়ত জানেন না অনেকেই।

পদ্মা সেতুর কারণে ফেনীর মাছের ব্যবসায়ে বড় প্রভাব পড়েত যাচ্ছে। জানা গেছে, জেলার পৌর মৎস্য আড়ত হতে প্রতিদিন গড়ে ১৭০ টন বিভিন্ন ধরনের মাছ বিক্রি হয়। টাকার অঙ্কে যা প্রায় দুই কোটি! এ বিবেচনায় বছরে ৭০০ কোটি টাকার মাছ এ বাজার হতে বিভিন্নস্থানে সরবরাহ হয়ে থাকে।

পদ্মা বহুমুখী সেতু চালু হলে ওপার হতে মাছের বর্তমান সরবরাহ দ্বিগুণ হতে পারে। ফলে মাছ বিক্রি আরও ৩০০ কোটি টাকা বেড়ে হাজার কোটি টাকা ছাড়াবার সম্ভাবনা রয়েছে। এমন সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন বৃহত্তর খুলনা, শরীয়তপুরসহ আশপাশের জেলা হতে মাছ পরিবহনকারী সংস্থার মালিক ও ফেনীর আড়তদাররা।

পৌর মৎস্য আড়ত ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক খুরশিদ আলম জানান, চাহিদার উল্লেখযোগ্য মাছ আসে পদ্মার ওপার থেকে। বৃহত্তর খুলনা হতে প্রতিদিন গড়ে ১৫ টন হিমায়িত চিংড়ি ও কার্পজাতীয় মাছ আসে। এছাড়া শরীয়তপুরসহ পদ্মার ওপারের আশপাশের জেলা হতে অক্সিজেন ব্যবহার করে আসে আরও ১২ থেকে ১৫ টন জীবিত মাছ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বড় আকারের রুই, কাতলা, মৃগেল, কার্প ইত্যাদি। ৩০ টন মাছের বাজারমূল্য প্রায় ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা। এভাবে মাসে ২৫ কোটি এবং বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার মাছ এসব অঞ্চল থেকে আসে। পদ্মা সেতু চালু হলে এলাকাগুলো থেকে দ্বিগুণ হারে জীবিত-মাছ ফেনীতে সরবরাহ করা যাবে বলে আশা করেন তিনি।

এ প্রসঙ্গে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, সেতু ব্যবহার শুরু হলে পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসার মাছের বাজার আরও বড় হবে। পরিবহন ব্যয় কমবে, একই সঙ্গে কমবে মাছের দামও।

ফেনীতে যেসব পরিবহনে মাছ সরবরাহ হয়ে থাকে তাদের মধ্যে আনোয়ার হোসেন ট্রান্সপোর্ট, আমিনিয়া ফিস এবং বিসমিল্লাহ ফিস অন্যতম। আনোয়ার হোসেন ট্রান্সপোর্টের অন্যতম মালিক মো. ফারুক হোসেন জানান, পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হলে খামারিদের সঙ্গে ফেনীর মাছ ব্যবসায়ীদের সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে। ব্যাপারীদের প্রভাব কমবে, মাছের সরবরাহ ব্যাপক হারে বাড়বে। কমবে দামও।

তিনি আরও বলেন, মাছ পরিবহনকারী বেশিরভাগ ট্রাক শরীয়তপুর হতে ফেরি হয়ে লক্ষ্মীপুর হরিনা ঘাট দিয়ে পদ্মা পার হয়ে নোয়াখালী-ফেনী হয়ে চট্টগ্রাম যায়। লম্বা সময়ের যাত্রায় মাঝেমাঝে গাড়িগুলো যথাসময়ে ফেনী এসে পৌঁছায় না। চিংড়ি এবং কার্পজাতীয় মাছগুলো দূরত্ব ও সময়ের কারণে বরফ ও ককশিটের বাক্সে আসে। এতে মাছের স্বাদ ও দাম দুটোই কম থাকে। মাছের চাহিদা থাকলেও যোগান পর্যাপ্ত নেই।

মৎস্য আড়তের ব্যবসায়ী হাসান বলেন, বড় আকারের কার্পজাতীয় মাছের চাহিদা পূরণ হবে পদ্মা সেতু চালু হলে। তবে মাছের খাবারের দাম বেশি হওয়ায় দাম কমার সম্ভাবনা কম কিন্তু বাজারের আকার বৃদ্ধি পাবে।

২৫ জুন পদ্মা বহুমুখী সেতু উদ্বোধনের পর থেকে উৎপাদন-মুখী জেলাগুলোর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হতে যাচ্ছে দেশের অন্যসকল জেলা। গতিশীলতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাণিজ্যিক বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসছে সর্বাগ্রে।

সেতু উন্মুক্ত হলে মাছের বাজার সম্প্রসারণের পাশাপাশি বাণিজ্যিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তারা। ফারুক হোসেন বলেন, বর্তমান বাজার ব্যবস্থা মাছের ব্যাপারীরা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। মাছচাষি থেকে তারা মাছ কিনে দেশের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। মাছ ব্যবসার এটি অনেক পুরনো প্রথা। তাই সকল বাজারই ব্যাপারীদের সম্পর্কের জালে আবদ্ধ। পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হলে দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দূরত্ব কমবে। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা মাছ চাষিদের অনুকূলে যাবে। ঘের মালিকরা সরাসরি বিভিন্ন অঞ্চলে মাছ সরবরাহ করার সুযোগ পাবে। এর মাধ্যমে বহুবছর ধরে ব্যাপারীদের তৈরি করা বাজারে ভাটা পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ফেনী পৌর মৎস্য আড়ত ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক খুরশিদ আলম বলেন, সরাসরি চাষিদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করা গেলে মাছের সরবরাহ বাড়বে। সরবরাহ বাড়লে দাম নিয়ন্ত্রণে থাকার সম্ভাবনা বেশি।

বিয়েসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অতিথি আপ্যায়নে দেশি মাছের কদর রয়েছে। ফেনী পৌর মৎস্য আড়তের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, চাহিদা মেটাতে ভোক্তাকে বড় আকারের মাছের দিকে চেয়ে থাকতে হয়। এ চাহিদা সাধারণত হিমায়িত কার্পজাতীয় মাছের উপর নির্ভর করতে হয়। এ প্রসঙ্গে একাধিক ব্যবসায়ী জানান, দাম একটু বাড়লেও পদ্মা সেতুর বদৌলতে জীবিত বড় আকারের মাছ ফেনীর মাছ বাজারগুলোয় মিলতে পারে।

সংশ্লিষ্ট পরিবহন সংস্থা সূত্র জানায়, অক্সিজেন সরবরাহের মাধ্যমে জীবিত মাছে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে ফেনীতে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। খুলনার পাইকগাছা এলাকার মাছচাষি শহিদুল জানান, বড় আকারের ঘের হওয়ায় বড় মাছ উৎপাদন সহজ। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হলে নিশ্চিতভাবেই মাছ ব্যবসায় সুদিন আসবে।

মৎস্য বিভাগ ফেনীকে মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ বললেও মোট চাহিদার বড় অংশ বিভিন্ন জেলা হতে সরবরাহ হয়ে থাকে। সমিতির সাধারণ সম্পাদক খুরশিদ আলম জানান, মুহুরি প্রকল্পসহ জেলা বিভিন্নস্থান হতে দৈনিক আনুমানিক ২৫ টন মাছ আড়তে আসে। এগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ মাঝারি আকারের রুই, কাতল, মৃগেল অন্যতম। কুমিল্লা হতে পাঙ্গাস মাছ বেশি আসে। সবধরনের মাছ মিলে এর পরিমাণ প্রায় ১৫ টন। প্রতিদিন গড়ে ২০ হতে ২৫ টন শিং মাছের বড় যোগান আসে ময়মনসিংহের তারাকান্দা, নেত্রকোনা ও মুক্তাগাছা হতে, জেলার বিভিন্ন ছোট বড় ঘের হতে আসে ১২ হতে ১৫ টন, খুলনাসহ অন্যান্য অঞ্চল হতে আসে অবশিষ্ট মাছ।

বৃহত্তর খুলনা, শরীয়তপুরসহ আশপাশের জেলা হতে মিঠাপানির মাছ বৃহত্তর নোয়াখালী, কুমিল্লা চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রাম সরবরাহ হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম হতে সামুদ্রিক মাছ ফিরতি পথে সেসব অঞ্চলে সরবরাহ হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, বর্তমানে সরবরাহের পরিমাণ কম হলেও পদ্মার ওপারে উন্নত যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ায় সরবরাহ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে মিঠাপানির মাছের পাশাপাশি সামুদ্রিক মাছের বাজার আরও বিস্তৃত হবে।

পদ্মা সেতু উন্মুক্ত হলে ফেনীর সবজি বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়বে বলে জানিয়েছেন পৌর তরকারি আড়তের ব্যবসায়ী আবদুল মতিন পারভেজ। তিনি জানান, প্রতিদিন ১২ হতে ১৫ ট্রাক সবজি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে আসে। এর মধ্যে যশোরসহ আশপাশের জেলা হতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সবজি ফেনীর বাজারে আসে।

এখন যশোর হতে সবচেয়ে বেশি আসে পটল। ফেনী বাজারের আকৃতি উল্লেখ করে পারভেজ বলেন, ফেনী পৌর আড়ত আকার বিবেচনায় দেশের চতুর্থ বলা হয়ে থাকে। এখান থেকে সবজি আশপাশের উপজেলাগুলোয় সরবরাহ হয়ে থাকে। দক্ষিণাঞ্চল হতে অধিক সবজি সরবরাহের সম্ভাবনা বাস্তবিক হলে সবজির দাম তুলনামূলক কমতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২০ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০২২
এসএইচডি/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।