ঢাকা, শনিবার, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ মে ২০২৪, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ঠিকাদারের লাভে ও লোভে অসহায় শিক্ষার্থীরা!

এ কে এস রোকন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপনডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৫৭ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০২২
ঠিকাদারের লাভে ও লোভে অসহায় শিক্ষার্থীরা! রাস্তা কার্পেটিংয়ের জন্য পুরাতন স্যান্ডেল পুড়িয়ে পিচ গলানো হচ্ছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: বিদ্যালয় ভবন ঘেঁষে প্লাস্টিক ও পুরাতন স্যান্ডেল পোড়ানোর কালো ধোঁয়ায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দূষণের শিকার হলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো নির্বিকার। গত ৭ দিন ধরে ঠিকাদার তার লাভের কারণে প্রধান শিক্ষককে লোভ দেখিয়ে বিদ্যালয় ভবন ঘেঁষে প্লাস্টিক জাতীয় উপকরণ পোড়াচ্ছে।

 

ঘটনাটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর ইউনিয়নের দিয়াড় পশ্চিম জাহাঙ্গীরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। পিচ গলানোর সঙ্গে পাথর ও পিচের মিশ্রণ করানোর মেশিনের শব্দে শিক্ষকের পাঠদান বুঝতে পারছে না শিক্ষার্থীরা।

ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, এলজিইডি বিভাগের তত্ত্বাবধানে পদ্মা নদী রক্ষা বাঁধের সড়কে চলছে পিচ কার্পেটিংয়ের কাজ। সংস্কার কাজের জন্য বিদ্যালয়ের পেছনেই গত ৭ দিন ধরে পিচ গলাতে জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হচ্ছে পুরাতন স্যান্ডেল ও বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক। এতে কালো ধোঁয়ায় ক্লাসে বসা শিক্ষার্থীরা দূষণের শিকার হচ্ছে। খোলা জায়গা হওয়ায় ওইসব ধোঁয়া ক্লাস রুমেও প্রবেশ করছে। পাশাপাশি বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ ঘেঁষে মেশিনে পিচ ও পাথরের মিশ্রণ করার কারণে ধুলাবালি ও শব্দে অতিষ্ঠ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অভিযোগ আছে মাত্র ১৫ হাজার টাকায় প্রধান শিক্ষককে একটি দোলনা কিনে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে এসব পরিবেশ দুষণকারী উপকরণ পোড়াচ্ছে ঠিকাদার।

শিক্ষার্থীরা জানায়, কালো ধোঁয়ায় তাদের চোখ জ্বালা করে। দম বন্ধ হয়ে আসে। বমি বমি ভাব হয়। টিনের অস্থায়ী শ্রণিকক্ষ হওয়ায় কালো ধোঁয়া বা শব্দ কোনোটাই আটকানো যায় না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষক বলেন, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের এখন নিয়মিত ক্লাস চলছে। এর মধ্যে কালো ধোঁয়া যখন ঢুকছে, তখন লেখা বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীরা হাত দিয়ে নাক-মুখ চেপে ধরছে।

দিয়াড় পশ্চিম জাহাঙ্গীরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোসা. সেলি খাতুন ও মোসা. মমতাজ খাতুন জানান, গত ৭-৮ দিন থেকে হঠাৎ করেই স্কুলের গা ঘেঁষে পিচ গলাতে স্যান্ডেল পোড়ানো ও পিচ-পাথর মেশানো শুরু হয়েছে। প্রচুর পরিমাণে গন্ধ আসে। ক্লাসের শিক্ষার্থীদের খুব কষ্ট হয়। এরই মাঝে বাধ্য হয়েই ক্লাস করতে হচ্ছে।

চতুর্থ শ্রেণির শামীম, পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী মরিয়ম, সিমা খাতুন বলে, ক্লাস করা অবস্থাতেই চোখেমুখে মেশিনের ধুলাবালি আসে। কালো ধোঁয়া নাকের কাছে আসলে বমি বমি ভাব হয়। ম্যাডামদের বারবার বলেও কোনো লাভ হয় না।

স্থানীয় বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি আশপাশের এলাকার আমের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে স্যান্ডেল পোড়ানোর ধোঁয়াতে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই এলাকার প্রধান অর্থকারী ফল আম। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমচাষিরা। কারণ যে আমে ধোঁয়া লাগে, সেসব আম স্বাভাবিক মিষ্টতা ও আমের গায়ের রং নষ্ট হয়। এতে আমের দাম পাওয়া যায় না।

অপর এলাকাবাসী তরিকুল ইসলাম জানান, আগে পিচ গলাতে জ্বালানি হিসেবে কাঠ ব্যবহার করা হলেও এবারই প্রথম এসব পোড়াতে দেখা যাচ্ছে। । মানুষের স্বাস্থ্য ও বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি বিবেচনায় প্রশাসনকে স্যান্ডেল পোড়ানোর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করছি।

দিয়াড় পশ্চিম জাহাঙ্গীরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল মতিন বলেন, পিচ গলানো ও মেশিনে পাথর মিশ্রণের কাজ শুরুর কয়েকদিন আগে ঠিকাদারের লোকজন এসেছিল আমার কাছে। তারা আমাদের স্কুলের পাশের জায়গায় কাজ করবে, এর বিনিময়ে স্কুলের ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা করার জন্য একটি দোলনা কেনা বাবদ ১৫ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তাই আর কোনো প্রতিবাদ করিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেখানে কর্মরত এক শ্রমিক জানান, শিবগঞ্জ উপজেলার ছত্রাজিতপুর থেকে এসব রাবারের পুরাতন ও পরিত্যক্ত স্যান্ডেল কিনে এনে এখানে পোড়ানো হচ্ছে। কেজি প্রতি ১১ টাকা করে এসব স্যান্ডেল কেনা হয়েছে। বেশি সময় ধরে জ্বলে বলে ঠিকাদার লাভের আশায় এসব পোড়াচ্ছে।

ঠিকাদার খাইরুল কবির রানা মোবাইল ফোনে জানান, উন্নয়ন কাজ করতে গেলে একটু অসুবিধা হবেই। তাই এই সাময়িক অসুবিধার বিষয়টি মেনে নিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে হবে। তবে জ্বালানি হিসেবে পুরাতন রাবারের স্যান্ডেল ব্যবহার নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি তিনি।

এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর-এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোজাহার আলী বলেন, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটিয়ে এসব কাজ করা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়াও পিচ গলাতে জ্বালানি হিসেবে কাঠ বা কাপড়ের ঝুট ছাড়া স্যান্ডেল ব্যবহার করার কোনো নিয়ম নেই।

উল্লেখ্য, শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত দিয়াড় পশ্চিম জাহাঙ্গীরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২০ জন এবং শিক্ষক রয়েছেন ৪ জন।

বাংলাদেশ সময়: ১২৫২ ঘণ্টা, জুন ১৪, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।