ঢাকা, রবিবার, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে কৃষিজমি দখলের অভিযোগ 

মোস্তাফিজুর রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৬, ২০২২
সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে কৃষিজমি দখলের অভিযোগ 

পাবনা: বেসরকারি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের নামে পাবনার হেমায়েতপুর ইউনিয়নের পদ্মা পাড়ের গ্রাম চরভবানীপুর এলাকায় শতাধিক কৃষকের কৃষিজমি দখলের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে।  

কৃষকদের অভিযোগ, জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে চর অঞ্চলের শতাধিক কৃষকের বৈধ কৃষিজমি দখলে নিয়েছে একটি প্রভাবশালী চক্র।

জমি ক্রয় সংক্রান্ত কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি জেলা প্রশাসনের কাছ থেকেও। জমি দখলের জন্য সেই প্রভাবশালী চক্র সাধারণ কৃষকদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। আইনগতভাবে কোনো সমাধান না হওয়ায় ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন ভুক্তভোগী কৃষকেরা।

এক সময়ের দুর্গম গ্রামটিতে এখন হয়েছে পাকা সড়ক। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ছোঁয়ায় পৌঁছেছে বিদ্যুৎ। প্রযুক্তি ব্যবহারে বালুময় চরগুলো এক ফসলি থেকে হয়েছে দ্বিফসলি, কেউবা ফলাচ্ছেন তিন ফসলও। প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বদলে গেছে কৃষিনির্ভর গ্রামটির আর্থ সামাজিক অবস্থান। তবে সম্প্রতি বেসরকারি একটি কোম্পানির নামে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য হঠাৎ করেই জমি দখলে নেমেছে একটি চক্র।

স্থানীয়রা জানান, সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য ২০১৭ সালে ভবানীপুর মৌজায় ৭২ একর জমি কেনে ডায়ানামিক সান এনার্জি নামের ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠান। প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে না পারায়, পরবর্তীকালে সে জমি হস্তান্তর করে প্যারামাউন্ট গ্রুপের কাছে। এরপর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনায় প্যারামাউন্ট হোল্ডিংসের নামে জমি কিনতে শুরু করেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। অভিযোগ উঠেছে, প্যারামাউন্ট গ্রুপের জন্য জমির ব্যবস্থা করতে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন ও হেমায়েতপুর ইউনিয়নের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মালিথার সহায়তায় ফসলি জমি, অকৃষি দেখিয়ে জোরপূর্বক দখলে নিতে শুরু করে এই প্রভাবশালী চক্র। কেবল তাই নয়, জাল দলিল তৈরি করে শতাধিক কৃষকের জমি বিক্রি করেছে ভুয়া মালিকরা। সরকারি রাস্তা, খাস জমিও কাঁটাতারে ঘিরে ঝোলনো হয়েছে সাইনবোর্ড। উপার্জনের সম্বল হারানোর শঙ্কায় দিশেহারা ওই অঞ্চলের স্থানীয় কৃষক ও জমির মালিকরা।

চরভবানীপুর গ্রামের পল্লী চিকিৎসক মোশারফ বিশ্বাস বলেন, প্যারামাউন্ট হোল্ডিংসহ এর ঘিরে নেওয়া জমির মধ্যে আমার ১১ বিঘা কৃষিজমি, জোরপূর্বক ঘিরে নেওয়া হয়েছে। এসব সম্পত্তি আমার বাবা ও আমার নামে রেকর্ডকৃত। অথচ তারা আমার ফসলের জমিতে খুঁটি পুঁতে কাঁটা তারে ঘিরে নিয়েছে। আমাদের জমিতে যাওয়ার পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

কৃষক আরমান আলী বলেন, ভবানীপুর মৌজায় আমাদের তিন ভাইয়ের প্রায় পাঁচ বিঘা জমি রয়েছে। সেখানে আমরা কলা, ইরি ধান, মসুর আবাদ করে খাই। হঠাৎ করেই কোম্পানির লোকেরা এসে বলে আমার জমি তারা আমার চাচাতো ভাই মকসেদ ব্যাপারীর কাছ থেকে কিনেছে। জোর করেই তারা জমিগুলো কাঁটাতারে ঘিরে নিয়েছে। অথচ মকসেদ ব্যাপারী ২৮ বছর আগে মারা গেছেন। তার মৃত্যু সনদ দেখানোর পরেও তারা আমার জমি ছাড়েনি।

একই গ্রামের কৃষক মো. আসলাম হোসেন বলেন, উপজেলা চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মালিথা ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল বারী বাকীর মাস্তানবাহিনী আমাদের জমি জোর করে দখল করে নিয়েছে। আমরা জমি বিক্রি করবো না জানালে তারা বলেছে, তারা যে দাম দেবে সে দামেই জমি বিক্রি করতে হবে। সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আমাদের জমি জোর করেই তারা নিয়ে নেবে। আমরা নিরক্ষর মানুষ, কৃষিকাজ ছাড়া আমাদের কোনো কাজ জানা নেই। এই জমি চলে গেলে আমরা কি করে খাবো, বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন কৃষি জমিতে কোনো প্রতিষ্ঠান করা যাবে না। এই চর অঞ্চলে এখন সোনার ফসল ফেলে। কৃষির ওপরে শুধু মানুষ নয় গবাদি পশুর খাদ্যের চাহিদা পূরণ হয়ে থাকে। তাই চরের অসহায় মানুষের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করেন স্থানীয় কৃষকেরা।

এদিকে জমি দখলের বিষয়টি জানিয়ে জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভবনীপুরের কৃষকেরা। কৃষকদের অভিযোগের বিষয়টি খোঁজ নিয়ে সত্যতা পেয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স। তিনি বলেন, প্যারামাউন্ট গ্রুপের জমি কেনা নিয়ে এলাকায় অস্থিরতার খবর পেয়ে আমি সরেজমিনে পরিদর্শন করেছি। আমি জানতাম না কৃষিজমিতে তারা সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে। কৃষকদের কাছ থেকে বিষয়টি জেনে আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। স্থানীয় চাষিরা তাদের জমি ছাড়তে চান না। জমি কেনা নিয়ে বড় ধরনের ঘাপলাও হয়েছে। আমার মনে হয়, প্যারামাউন্ট কর্তৃপক্ষকেও স্থানীয় কোনো চক্র বিভ্রান্ত করেছে। আমি আশা করবো তারা কৃষিজমি নষ্ট না করে চরের পতিত জমিতে তাদের প্লান্ট স্থাপন করবেন।

তিনি আরও বলেন, জমি বিক্রি নিয়ে কৃষকদের অভিযোগ সমাধানের জন্য আমরা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে একটি কমিটি করে দিয়েছি। তারা ব্যর্থ হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

প্যারামাউন্ট গ্রুপের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার অ্যাডভোকেট হরিপদ দেব বলেন, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন করতে চরভবানীপুরে ৩০০ একর জমি কেনার পরিকল্পনা রয়েছে প্যারমাউন্ট গ্রুপের। এর মধ্যে ৭২ একর জমি ডায়ানামিক সান কোম্পানি আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছে। আমরা আরও ৭১ একর জমি কিনেছি। আইনগত প্রক্রিয়া মেনেই জমি কেনা হয়েছে। কাউকে জোর করে জমি থেকে উচ্ছেদের অভিযোগ সত্য নয়। এগুলো কৃষিজমিও নয়, দাম বাড়ানোর জন্য স্থানীয় কৃষকরা সেখানে ফসল বুনেছে। শিল্প স্থাপনে স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, জমি কেনার পর প্রকল্প স্থাপনের অনুমোদন পেলে জেলা প্রশাসনকে জানানো হবে।

পাবনা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন বলেন, এলাকার উন্নয়ন ও স্থানীয় জনগণের কর্ম সংস্থানের স্বার্থে প্যারামাউন্ট গ্রুপকে জমি কিনতে আমরা সহযোগিতা করেছিলাম। এখানে কাউকে জোর জবরদস্তি করা হয়নি। তিন বছর ধরে যারা স্বেচ্ছায় জমি বিক্রি করেছে তাদের জমিই নেওয়া হয়েছে। জমি রেজিস্ট্রিতেও অনিয়ম হয়নি। এরপরও সংসদ সদস্য মহোদয় যেহেতু কমিটি করে দিয়েছেন আমরা বিষয়টি দেখবো।

পাবনা জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন বলেন, কৃষিজমিতে কোনো কিছু করতে হলে প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়। প্যারামাউন্ট গ্রুপ জমি কেনার বিষয়ে প্রশাসনকে অবহিত করেনি। এ ব্যাপারে সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমিকে তদন্ত করতে বলা হয়েছে। অনিয়ম হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৬, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।