ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

লালমনিরহাটে আশ্রয়ণের অনেক ঘরেই তালা, অসহায় বৃদ্ধার ঠাঁই রান্নাঘরে! 

খোরশেদ আলম সাগর, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬১০ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০২২
লালমনিরহাটে আশ্রয়ণের অনেক ঘরেই তালা, অসহায় বৃদ্ধার ঠাঁই রান্নাঘরে!  হস্তান্তরের পর থেকেই তালা ঝুলছে অনেক ঘরে, ছবি: বাংলানিউজ

লালমনিরহাট: কেউ গৃহহীন থাকবে না। প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা বাস্তবায়ন করতেই আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার।

লালমনিরহাটের আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধিকাংশ ঘরে কেউ থাকছেন না। অপর দিকে বরাদ্দ না পেয়ে অসহায় বৃদ্ধা থাকছেন সেই প্রকল্পের রান্নাঘরে।  

সুফল ভোগীদের তালিকা করায় ব্যাপক অনিয়মের কারণে প্রকৃত অসহায় ও ভূমিহীনরা বঞ্চিত হয়েছেন। যাদের ঘর বাড়ি বা সম্পদ রয়েছে- এমন লোকদের নামে ঘর বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এসব সুফলভোগী জমির দলিল আর ঘরের চাবি নিলেও প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরে আসেননি।  

জানা গেছে, আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় সরকারি খাস জমি চিহ্নিত করে সেখানে প্রতিটি পরিবারের জন্য বারান্দা বিশিষ্ট দুই কক্ষের পাকা ঘর, কিচেন ও টয়লেট নির্মাণে দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়। ঘরের পাশে রাখা হয় সবজি বাগান করার মত সামান্য ফাঁকা জমিও। যেখানে সবজির বাগান করবেন সুফলভোগীরা। ঘর নির্মাণ শেষ হলে সুফলভোগীদের তালিকা তৈরি করে তাদের হাতে দুই শতাংশ জমির দলিল আর ঘরের চাবি বুঝিয়ে দেওয়া হয়।  

সুফলভোগীদের তালিকা করার ক্ষেত্রে ভূমিহীন ও প্রকৃত অসহায়দের গুরুত্ব দেওয়ার কথা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে বঞ্চিত থাকছেন প্রকৃত অসহায়রা। অভিযোগ রয়েছে, এক শ্রেণির অসাধু জনপ্রতিনিধি তালিকা করতে স্বজনপ্রীতি করেছেন। যাদের জমি বা থাকার মতো ঘরবাড়ি রয়েছে, এমন অনেকের নামেও ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তারা জমির দলিল আর ঘরের চাবি বুঝে নিলেও বাস্তবে কখনোই আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে আসেননি। ফলে বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা আশ্রয়ণ প্রকল্পের বেশির ভাগ ঘরেই জন্ম থেকে তালা ঝুলছে। ফলে অপরাধীদের অভয়াশ্রমে পরিণত হচ্ছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো।

আদিতমারী উপজেলার মিলন বাজার এলাকায় গত বছর নির্মাণ করা আশ্রয়ণে ৪২টি পরিবারের মধ্যে পাঁচটি পরিবার একদিনের জন্যও আসেননি তাদের নামে বরাদ্দকৃত ঘরে। অপরদিকে অসহায় বৃদ্ধা নয়াবিবি (৮০) থাকেন তার মেয়ে জামাইয়ের নামে বরাদ্দকৃত ঘরের রান্নাঘরে। তার ছেলে সন্তান নেই, নেই কোনো বাড়ি বা জমি। সরকারি ঘর বরাদ্দ চেয়েও পাননি। তাই নিরুপায় বৃদ্ধা নয়াবিবির আশ্রয় হয়েছে রান্নাঘরে।  

নয়াবিবি বলেন, মোর থাকবার ঘর নাই। তাই কষ্ট হইলেও বেটির (মেয়ের) ঘরের পায়খানায় থাকোং। মেলা (অনেক) ঘর ফাঁকা আছে। একনা (একটা) ঘর মোক (আমাকে) নিয়া দেন বাপু। বুড়া মানুষ। কেনটে যাইম।  

হাতীবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়নের পূর্ব বিছনদৈ গ্রামে ৫৯টি পরিবারের জন্য একটি আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে ওঠে। সেখানে ৫৯টি পরিবার থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে থাকে মাত্র ২৪/২৫টি পরিবার। বাকিরা চাবি আর দলিল নিলেও উপহারের ঘরে এক বছরে একদিনও আসেননি। জমি আর ঘরের মালিকানা নিতেই তারা সুফলভোগী হয়েছেন। বাস্তবে তাদের জমি ও ঘরবাড়ি থাকায় সেখানেই বসবাস করেন। কেউ কেউ মাঝে মধ্যে এসে ঘর দেখে চলে যান। তবে অধিকাংশ ঘরে জন্ম থেকেই ঝুলছে তালা।

নিজের কোনো জমি বা ঘর না থাকায় রিকশাচালক পূর্ব বিছনদৈ গ্রামের আজিজুল ইসলাম থাকেন এ আশ্রয়ণের ২৮ নম্বর মোজাম্মেলের ঘরে। মোজাম্মেলের নিজেস্ব বাড়ি থাকায় পরিত্যক্ত ছিল আশ্রয়ণের ঘরটি। তাকে অনুরোধ করে আপাতত পরিবার নিয়ে থাকছেন আজিজুল। তার মতো আরও কয়েকজন অসহায় এভাবেই অন্যের বরাদ্দকৃত ঘরে থাকেন। আর সরকারি খাতার সুফলভোগীরা জমির দলিল আর ঘরের চাবি বুঝে নিয়ে থাকেন নিজেদের বাড়িতে। সুফলভোগী নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের কারণে এমনটা হয়েছে।  

এমনই অবস্থা হাতীবান্ধার সিন্দুর্না আশ্রয়ণ প্রকল্পেরও। সেখানে প্রায় একশ’ ঘর করা হলেও বাস্তবে ৩০-৩৫টি পরিবার বসবাস করেন। শুধু হাতীবান্ধা বা আদিতমারী উপজেলায় নয়। এমন চিত্র গোটা জেলার সব আশ্রয়ণ প্রকল্পে।  

মিলন বাজার আশ্রয়ণের আমিনা বেগম বলেন, যেসব ঘরে তালা ঝুলছে, সেসব ঘরের মালিকরা কখনোই আসেননি। গত এক বছরে তাদের চেহারাও আমরা দেখতে পাইনি। অথচ অনেকেই থাকার ঘর না পেয়ে নয়াবিবির মতো রান্নাঘরে আর বারান্দায় থাকছেন। যারা আশ্রয়ণের ঘরে থাকেন না, তাদের বরাদ্দ বাতিল করে প্রকৃত অসহায়দের দেওয়া হোক। নয় তো বরাদ্দকৃতদের চাপ দিয়ে ঘরে থাকতে বাধ্য করা হোক। যেসব ঘরে কেউ থাকে না। সেসব ঘরের পাশে রাতে বহিরাগতরা মাতলামো করেন। যা বসবাসকারীদের জন্য ভয়ের কারণ।  

হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সামিউল আমিন বলেন, এ উপজেলার বেশির ভাগ মানুষ পরিবার নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় কাজের জন্য বসবাস করেন। তাই হয়তো কিছু ঘরে তালা ঝুলছে। তবে এলাকায় থেকেও যারা আশ্রয়ণে থাকছেন না, তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

বাংলাদেশ সময়:  ঘণ্টা, মার্চ ১৮, ২০২২
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।