ঢাকা, সোমবার, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

শান্তি প্রিয় বান্দরবান আজ অশান্তির পথে

কৌশিক দাশ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১২ ঘণ্টা, মার্চ ৭, ২০২২
শান্তি প্রিয় বান্দরবান আজ অশান্তির পথে

বান্দরবান: সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়ে গেছে বান্দরবান পার্বত্য জেলায়। পার্বত্য এলাকার আঞ্চলিক দলগুলো হঠাৎ করে তাদের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করে আধিপত্য বিস্তারের জন্য চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের মতো নৃশংস ঘটনাগুলো বৃদ্ধি করেছে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শনিবার (৫ মার্চ) দুপুরে বান্দরবানের রোয়াংছড়ির তারাছা ইউনিয়নের নয়াপাড়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সন্তু গ্রুপের এক কর্মীকে গুলি করার পর তাকে অপহরণ করে নদীপথে ইঞ্জিন বোটে নিয়ে যায় একটি সশস্ত্র গ্রুপ।

এদিকে এ ঘটনার রেশ না কাটতেই রোববার (৬ মার্চ) বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পালিক্ষ্যং ঝিরির সাংগু নদীর তীরবর্তী এলাকা থেকে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এসময় একজনের মরদেহ মাটির নিচ থেকে ও অপর ৩ জনের দেহ সাংগু নদীর পাড় থেকে উদ্ধার করা হয়।

পুলিশ জানায়, শনিবার (৫ মার্চ) বিকেল থেকে পালিক্ষ্যং ঝিরি এলাকায় গোলাগুলির শব্দ শুনতে পায় পাড়াবাসী। এসময় অনেকে ভয়ে পালিয়ে পাহাড়ের উপরে ওঠে যায় আর অনেকে পালিয়ে অন্যপাড়ায় চলে যায়। এদিকে সারারাত আতঙ্কে শেষে রোববার (৬ মার্চ) সকালে সূর্য ওঠার পর পাড়াবাসী তাদের অনেকের ঘরের নারীদের নিখোঁজ থাকায় তাদের খুঁজতে বের হলে নদীর পাড়ে চারটি মরদেহ পায়। পরে এলাকাবাসী বিষয়টি পুলিশকে জানালে পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহগুলো উদ্ধার করে। এ ঘটনার পর ওই এলাকায় এখন চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।

সূত্রে আরো জানা যায়, সাঙ্গু নদীর তীরে ৪ জনের পড়ে থাকা শরীরে জলপাই রংয়ের সামরিক পোশাক পাওয়া যায়। এদের মধ্যে একজনকে মাটি দিয়ে চেপে পুঁতে রাখা হয় আর ৩ জনকে নদীর পাড়ে বাদাম ক্ষেতে গুলি করে মেরে ফেলে রাখা হয়।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে আরও জানা যায়, ২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি বান্দরবানের লামা উপজেলায় শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে এসে সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ হারান রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালীয়া এলাকার পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক দলের (জেএসএস) সক্রিয় কর্মী মংক্যচিং মার্মা (৩৫)।

এরপর গত ৩ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের রুমা উপজেলার বথিপাড়ায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলিতে নিরাপত্তা বাহিনীর এক সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার ও ৩ জন জেএসএস সদস্য নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য।

এরপরে ২৬ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে সন্ত্রাসীদের গুলিতে সদর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের নয়াপাড়ায় মৃত নিসামং মারমার ছেলে মংসিংশৈ মারমাকে (৩৮) গুলি করে কয়েকজন দুর্বৃত্ত। পরে শনিবার (৫ মার্চ) দুপুরে বান্দরবানের রোয়াংছড়ির তারাছা ইউনিয়নের নয়াপাড়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সন্তু গ্রুপের এক কর্মীকে গুলি করার পর তাকে অপহরণ করে নদীপথে ইঞ্জিন বোটে নিয়ে যায় একটি সশস্ত্র গ্রুপ। আর এ ঘটনার রেশ না কাটতেই রোববার (৬ মার্চ) বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের পালিক্ষ্যং ঝিরির সাংগু নদীর তীরবর্তী এলাকা থেকে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এসময় ঘটনাস্থল থেকে সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত একটি ওয়াকিটকি, ২৭টি কাতুর্জ, ১৫০টি টু টু রাইফেলের গুলি, কয়েকটি মোবাইল এবং সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত পোষাক ও টুপি উদ্ধার করে পুলিশ। এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে বান্দরবানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্ক বিরাজ করছে সর্বত্র।

দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি বান্দরবান জেলা শাখার সভাপতি অং চ মং বাংলানিউজকে বলেন, ১৯৯৭ সালে বর্তমান সরকার শান্তিচুক্তি করার পর বান্দরবানে শান্তি ছিল তবে হঠাৎ করেই পার্বত্য জেলা বান্দরবানে আইনশৃংঙ্খলা পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠেছে আর এই শান্তি ও সম্প্রীতির জেলার সুনাম অক্ষুণ রাখতে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে এই সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

বান্দরবান প্রেসক্লাবের সভাপতি মনিরুল ইসলাম মনু বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের শান্তি প্রিয় জেলাটি আজ অশান্তির পথে। সবচেয়ে আমাদের জন্য যেটি বেশি অশনি সংকেত সেটি হলো বান্দরবানে যে কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠি পাহাড়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছে তাদের বেশিরভাগ সদস্য তরুণ যুবক। আর এই যুবকরাই পথভ্রষ্ট হয়ে পার্বত্য এলাকার আঞ্চলিক বিভিন্ন সংগঠনে যোগ দিয়ে নিজের জাতি গোষ্ঠির ওপর নিজেরাই হামলা করছে।  

তিনি বাংলানিউজকে আরো বলেন, অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে বান্দরবানের বিভিন্ন দুর্গম এলাকাতে সন্ত্রাসীদের বিচরণ এখন নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আগামীর সুন্দর বান্দরবান রক্ষায় প্রশাসনকে আরো জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।  

পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী মজিবর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, সরকারের কাছে আমাদের দাবি এই মুহূর্তে পার্বত্য এলাকায় অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে জোরালো অভিযান করা প্রয়োজন। তিনি বাংলানিউজকে আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ভঙ্গ করে যারা দামি দামি গাড়ি নিয়ে ঘুরছে, কোটি কোটি টাকার চাঁদা আদায় করছে আর মানুষ হত্যা করে বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের গ্রেফতার করে কঠিন, তাদের বিচার করা দরকার।  

তিনি আরো বলেন, বান্দরবান পার্বত্য জেলার বিভিন্ন অরক্ষিত সীমান্ত এলাকায় সেনাবাহিনী, বিজিবির চৌকি বৃদ্ধি করা দরকার এবং এই  মুহূর্তে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশের সমন্বয়ে পার্বত্য এলাকায় অশান্তি সৃষ্টিকারী সন্ত্রাসীদের একে একে খুঁজে বের করে নির্মূল করা সময়ের দাবি।

এদিকে বান্দরবানের পুলিশ সুপার জেরিন আখতার বাংলানিউজকে জানান, কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠিকে বান্দরবানে থাকতে দেওয়া হবে না। সন্ত্রাসীদের কয়েকটি দল পার্বত্য এলাকার বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডেরমত নৃশংস ঘটনা ঘটাচ্ছে তবে তাদের জীবন ক্ষণস্থায়ী।  

তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি বান্দরবানে বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে এবং পুলিশ সংবাদ পাওয়া মাত্রই বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করেছে এবং যারা পার্বত্য এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে তাদের ধরতে পুলিশের অভিযান আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ০৭, ২০২২
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।