চট্টগ্রামের পশ্চিম পটিয়ায় দ্রুত গড়ে উঠছে ছোট-বড় অসংখ্য শিল্প কারখানা। দ্রুত শিল্পাঞ্চলে পরিণত হতে যাচ্ছে এলাকাটি।
পশ্চিম পটিয়ায় এখন যারা শিল্প কারখানা করছেন তারা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ও তার ছেলে নাজিমুল হক চৌধুরী শারুনসহ হুইপ পরিবারের লোকজনকে ম্যানেজ করেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। খরচ বেড়ে গেলেও মুখ খুলছেন না ভয়ে।
ওই এলাকায় কয়েকটি বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র, স্টিলমিলসহ অসংখ্য কারখানায় হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে।
সেখানে কলকারখানাগুলোর জমি ক্রয়, মাটি ভরাট এবং নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহের কাজ বাগিয়ে নিতে নিজস্ব বাহিনী দিয়ে কৌশলে পুরো এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন হুইপ। তার অনুগতদের বাইরে কেউ গিয়ে কোনো শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে কাজ দিতে হচ্ছে হুইপের অনুগতদের। কাজ না দিলেই নানা ঝামেলা বাঁধিয়ে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো কারখানার ক্রয় করা জমি ছাড়তে বাধ্য করছে হুইপের ছেলে শারুন।
সামশুর পরিবারের লোকজনের চাহিদা মেটাতে এক টাকার কাজ পাঁচ টাকায় করাতে হচ্ছে শিল্পকারখানার মালিকদের। এতে নির্মাণ ব্যয় বাড়ছে। দেশের সার্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নিজস্ব বাহিনীকে কাজ না দিলে ঝামেলা বাঁধিয়ে আবার মীমাংসার জন্য ডেকে নেওয়া হয়। এই ক্ষেত্রে বড় শিল্পকারখানাগুলোর কর্তাদের ডেকে নেওয়া হয় ঢাকার গুলশানস্থ হুইপের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে।
জানা গেছে, পশ্চিম পটিয়ার বারাকা শিকলবাহা পাওয়ার প্ল্যান্ট, বাংলাদেশ অটো স্প্রিং ইন্ডাষ্ট্রি লিমিটেড, আনলিমা পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং স্বনামধন্য তৈরি পোশাক কারখানা ফোরএইচ গ্রুপ নানাভাবে হুইপ পরিবারের থাবার শিকার হয়েছে। কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট শিল্পগ্রুপগুলো ভবিষ্যতে নতুন ঝামেলায় পড়ার ভয়ে গণমাধ্যমে পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হয়নি। বরং চুপ থেকে কারখানা চালিয়ে নেওয়ার কৌশল গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষতিগ্রস্ত কারখানা মালিকদের একজন বলেছেন, ‘অনেক ঝামেলা শেষ করে কারখানার কাজ এগিয়ে নিয়েছি। এখন শান্তিতে কারখানা চালাতে চাই। ওরা যা করছে, তা জঘন্য। বলার ভাষা নেই। ’
কাজ হাতিয়ে নেওয়ার কৌশল
পশ্চিম পটিয়ার শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক, কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সেখানে হাজার কোটি টাকার শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। যারা এখানে শিল্প স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের কাছেই জমি কেনার প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয় হুইপের লোকজন। রাজি না হলেই সৃষ্টি করা হয় সমস্যা। দালাল নিয়োগ করে কৌশলে জমির দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়। হুইপের দালালরাই আবার সেই জমি কিনে দেন। অতিরিক্ত দামে মাটি ভরাটের কাজও হুইপ, তার পুত্র শারুন ও তাদের পরিবার বা দলীয় অনুগত ক্যাডারদের দিতে হয়। নির্মাণ সামগ্রীও তাদের লোকের মাধ্যমে কিনতে হয়। রাজি না হলে স্থানীয় সন্ত্রাসী দিয়ে সমস্যা তৈরি করা হয়। শেষে পটিয়া, চট্টগ্রাম এবং ঢাকার গুলশানে হুইপের কার্যালয়ে ডেকে সমাধানের নামে দফারফা করতে হয়।
ওই শিল্পাঞ্চলে হুইপের বিরুদ্ধে এভাবে নিজস্ব বাহিনী দিয়ে কাজ নিয়ন্ত্রণ করার বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে শিল্প কারখানা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হুইপ পরিবারের সদস্যরা নেপথে থেকে কাজ পাওয়ার জন্য চেষ্টা করে। এইক্ষেত্রে দরপত্র দুইভাগে দাখিল করা হয়। একটি সর্বনিম্ন দর দিয়ে। অন্যটি উচ্চ দরে। কারখানা কর্তৃপক্ষ নিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ দিতে চাইলে দরপত্র দাখিলকারী ওই প্রতিষ্ঠান কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করে। তখন সমঝোতার নামে ডেকে উচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে বাধ্য করা হয়। পরে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে নিম্ন ও উচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান প্রকৃতপক্ষে একই চক্রের। কাজ পাওয়ার কৌশল হিসেবেই এসব বাহানা চলে। এসব শিল্পগ্রুপ থেকে কাজ বাগিয়ে সেই অর্থের বিলাসী জীবন পার করছেন শারুন। আর হুইপের সম্পদের পরিমাণ দিন দিন হু হু করে বাড়ছে।
কিছু উদাহারণ
হুইপ সামশুল হক ও তার ছেলে শারুনের থাবায় কাজ বন্ধ হয়েছিল পশ্চিম বারাকা শিকলবাহা পাওয়ার লিমিটেড (বিএসপিএল) নামে প্রতিষ্ঠানটির। অথচ ১০৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আগ্রহ ও অনুমোদন ছিল। ২০১৭ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে বারাকা শিকলবাহা পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ জমি ক্রয়ের কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু শুরুতেই হোঁচট খায় প্রতিষ্ঠানটি। জমি ক্রয় ও মাটি ভরাটে বিপত্তি শুরু হয় হুইপ ও শারুনের কৌশলগত বাধায়। তাদের লোকদের মাধ্যমে জমি ক্রয়, বালি দিয়ে মাটি ভরাট ও নির্মাণ সামগ্রী ক্রয়ে প্রতিষ্ঠানটি রাজি হচ্ছিল না। এই কারণে স্থানীয় সন্ত্রাসী দিয়ে বাধার সৃষ্টি করা হয়।
এরপর বারাকা পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ ২০১৮ সালে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিনের তৎকালীন ডিজি ড. বেনজীর আহমেদের (বর্তমান পুলিশ প্রধান আইজিপি) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সমস্যার কথা জানায়। শেষে তৎকালীন ডিজির আইনী সহযোগিতায় বারাকা শিকলবাহা পাওয়ার প্ল্যান্ট তাদের কাজ এগিয়ে নেয়। শেষে ২০১৯ সালের ১৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১০৫ মেগাওয়াট বারাকা শিকলবাহা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
বাংলাদেশ অটো স্প্রিং ইন্ডাষ্ট্রি লিমিটেড নামক প্রতিষ্ঠান প্রায় ৪৪০ শতক জমির ওপর স্প্রিং মিল স্থাপনের সময়ও একই কায়দায় বাধাপ্রাপ্ত হয় স্প্রিং মিল কর্তৃপক্ষ। মাটি ভরাট এবং নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ কাজে সুবিধা করতে না পেরে সন্ত্রাসী ভুট্টেুা ও বুলবলের নেতৃত্বে হামলা চলে। তারা কারাখানায় ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। ওই সময় কারখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, তারা আট টাকা দরে প্রতি ঘনফুট বালি ভরাটের কাজ ঠিক করেছিল। পরে সেই বালু ১৩ টাকা দরে বিক্রির প্রস্তাব দেয় ভুটো ও বুলবুল। কারখানা কর্তৃপক্ষ এতে রাজি না হওয়ায় সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে কারখানা ভাঙচুর করা হয়। এই সন্ত্রাসীরা হুইপের অনুসারী। শারুন তাদের পরিচালনা করেন বলে এলাকায় প্রচার আছে।
মিলের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ছোটখাটো কাজগুলো ওদের (হুইপ ও শারুন) ছেলেদের দিতে বাধ্য হয়েছি। এছাড়া প্রায় সাত শতক জমি ছেড়ে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করতে বাধ্য হয়েছি শারুনের বাধার কারণে। শারুন নিজস্ব ক্যাডার দিয়ে চরমভাবে ডিস্টার্ব করছিল।
বাধার মুখে পড়েছিল আনলিমা পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ভবিষ্যত সমস্যা হবে এমন আশঙ্কায় প্রকাশ্যে বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। একজন কর্মকর্তা দাবি করেছেন, ‘পটিয়ায় পাওয়ার প্ল্যান্ট হুইপ ও শারুনের কারণে নানাবিধ সমস্যা হচ্ছে। আথির্ক ক্ষতিও হচ্ছে। কিন্তু এসব বলে নতুনভাবে ঝামেলায় জড়াতে চাই না। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২১