ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘এইল্ল্যা ইউএনও দেশত থাইলে দেশ আরও আগাই যাইতো’

সুনীল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬০৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২, ২০২০
‘এইল্ল্যা ইউএনও দেশত থাইলে দেশ আরও আগাই যাইতো’ সাঁকো পাড় হচ্ছেন রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রণয় চাকমা। ছবি: বাংলানিউজ

কক্সবাজার: ‘দেশরলাই-দেশর মাইনসরলাই পরিশ্রম গরেদে, এডিক্যা ইউএনও আঁই খুব হম দেক্কি। আঁরা বেশি দোয়া গরির। অবাজি এইল্ল্যা ইউএনও আরা দেশত থাইলে দেশ আরও বউত আগাই যাইতো।’

সম্প্রতি করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কক্সবাজারের রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রণয় চাকমাকে নিয়েই এমন মন্তব্য রিকশাচালক তরুণ বড়ুয়ার। শুদ্ধ ভাষায় অনুবাদ করলে যার অর্থ দাঁড়ায়- দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য পরিশ্রম করেন এমন ইউএনও আমি খুব কম দেখেছি।

আমরা দোয়া করছি। এরকম ইউএনও সারা দেশে থাকলে, দেশ আরও বেশি এগিয়ে যেতো।  

শুধু এই রিকশাচালকই নন, চলমান করোনা পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে, বিদেশফেরত ব্যক্তিদের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, দ্রব্যমূল্যের কৃত্রিম সংকট রোধে তার নানা উদ্যোগ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও দারুণভাবে প্রশংসিত হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মার্চের শুরুতে বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তির সংখ্যা ছিল প্রায় দেড়শো। এসব মানুষের হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করতে প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে গেছেন ইউএনও প্রণয় চাকমা।

সরকারি নির্দেশনা না মানায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানাও করেছেন অন্তত ১৫ জনকে। অনেককে করেছেন সতর্ক। এছাড়াও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে তার রাত-দিন তৎপরতা ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।  সর্বস্তরের মানুষের পাশাপাশি প্রণয় চাকমার এমন সক্রিয় কর্মকাণ্ড শিশুদের মনেও দাগ কেটেছে।

সম্প্রতি এক ক্ষুদে শিক্ষার্থীর এমন একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ওই ভিডিও বার্তায় শিশুটি বলেছে, ‘সুন্দর সচেতন প্রচার প্রচারণার জন্য করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে, সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে দিন-রাত সরকারি নির্দেশনা মতে কাজ করে যাচ্ছেন রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রণয় চাকমা। মহোদয়ের উদ্যােগে চোখে পড়ার মতো। যা ফেসবুক খুললে চোখের সামনে ভাসতে থাকে। সেই সঙ্গে নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয়ের সাহসী পরিশ্রমকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সবাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকুন। ভালো থাকুন ও সুস্থ থাকুন। সবাইকে ধন্যবাদ। ’.রামুর স্থানীয় সাংবাদিক সোয়েব সাঈদ বাংলানিউজকে বলেন, দেশের এমন দুর্যোগময় মুহূর্তে সত্যিই তার ভূমিকা প্রশংসনীয়। দেশের জন্য-দশের জন্য এ ধরনের নিবেদিতপ্রাণ ইউএনও সব উপজেলায় থাকলে দেশের মানুষ উপকৃত হতো। পাশাপাশি দেশ আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতো।

সোয়েব সাঈদ বলেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে আমি নিজেও ইউএনও মহোদয়ের বিভিন্ন তৎপরতার সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি। করোনা মোকাবিলায় মানুষকে নিরাপদ রাখতে তিনি রাতদিন পরিশ্রম করছেন। ফোনে হোক, স্বশরীরে হোক যখনই যে তথ্য পেয়েছেন ছুটে গেছেন সেখানে। এমনকি একদিনে রামুর সব ইউনিয়নে (১১টি) অভিযান পরিচালনার বিরল দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন এই ইউএনও। যে কারণে জেলায় সবচেয়ে জনপ্রিয় সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন প্রণয় চাকমা। ’

রামু অন্যতম প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন প্রজন্ম’৯৫ এর সাধারণ সম্পাদক রেজাউল আমিন মোরশেদ বাংলানিউজকে বলেন, গাড়িচালক না থাকলে নিজেই গাড়ি চালিয়ে চলে যাচ্ছেন, যেখানে যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা নেই, সে ধরনের দুর্গম এলাকায় পায়ে হেঁটে চলে যাচ্ছেন। আসলে নিজের ভেতরে সততা, নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা থাকলে সবই সম্ভব। তার দৃষ্টান্ত এই প্রণয় চাকমা।

‘শুধু করোনা মোকাবিলায় নয়, ইতোপূর্বে রামুতে শিক্ষার প্রসারে তার শিক্ষাবান্ধব বিশেষ বাস ‘স্বপ্নযাত্রা’ চালুর উদ্যোগটিও ব্যাপক প্রশংসিত হয়। এছাড়াও উপজেলা পরিষদ চত্বরে তিনি চালু করেন দৃষ্টিনন্দন ওয়ান স্টপ সার্ভিস ও উপজেলা ডিজিটাল সেন্টার ‘খোলা জানালা’।  ইউএনও প্রণয় চাকমার সহযোগিতায় রামু উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিফিনের টাকায় এক হাজার ফুট দীর্ঘ ব্যানারে বঙ্গবন্ধুর একহাজার আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজনও এখন মানুষের মুখে মুখে।

রামুর সদর ফতেখাঁরকুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদুল আলম বাংলানিউজকে বলেন, রামুতে যোগদানের পর থেকেই অবৈধভাবে বালি উত্তোলন, পাহাড় নিধনসহ পরিবেশবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং মাদক, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধসহ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অপরাধ দমনে তার নিরলস চেষ্টা আমরা দেখছি। বেশ কয়েকটি বাল্যবিয়ে বন্ধের পর এখন রামুতে বাল্যবিয়ের হার কমে গেছে।

রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের সহকারী পরিচালক ও কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বাংলানিউজকে বলেন, করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সরকার শুরু থেকেই সতর্ক অবস্থানে ছিল। পাশাপাশি রামুবাসীকে সুরক্ষিত রাখতে ইউএনও প্রণয় চাকমা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

একইসঙ্গে এই দুর্যোগে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (এনএসআই) কর্মকর্তা আবু হানিফ এবং সাংবাদিক সোয়েব সাঈদকে ধন্যবাদ জানান প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু।

রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রণয় চাকমা বাংলানিউজকে বলেন, সরকারের প্রজাতন্ত্রের একজন কর্মচারী হিসেবে আমাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা আমি সাধ্যমত পালন করার চেষ্টা করছি। আমি মনে করি, মানবসেবার উপরে আর কোনো মহৎ কাজ নেই। তাই করোনা পরিস্থিতিতেও সরকারি নির্দেশনা মতে কাজ করে যাচ্ছি।

ইউএনও আরও বলেন, করোনা ভাইরাস নিয়ে সাধারণ মানুষ খুব আতংকিত। উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষ বিশেষ করে রিকশাচালক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠী আর্থিক সংকটে পড়বে। এ মুহূর্তে সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানদের তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসা উচিত। করোনা সংক্রমণ রোধে উপজেলার সব নাগরিককে কিছুদিন ঘরে অবস্থান করার আহ্বান জানান প্রণয় চাকমা।

রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাজে সন্তোষ প্রকাশ করেন কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও  রামুর সাবেক ইউএনও মো. শাজাহান আলী। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, প্রণয় চাকমা একজন দক্ষ অফিসার। একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে প্রণয় চাকমার এমন কর্মকাণ্ডে তিনি নিজেও গর্বিত।

বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০২০
এসবি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।