ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ মে ২০২৪, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

কাঁটাতারের সাথেই বসত!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৭
কাঁটাতারের সাথেই বসত! কাঁটাতারের সাথেই বসত এখন রোহিঙ্গাদের। ছবি: সোহেল সারওয়ার

ঘুমধুম থেকে:  ঘর ছিলো, জমি ছিলো, খাদ্য ছিলো, সবই ছিলো মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের। কিন্তু আজ নিজের দেশেই জায়গা নেই। আবার পালিয়ে বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে এলেও মাথার ওপরে ছাদ নেই। যেসব শিশুর মুখে মায়েদের ভাত তুলে খাওয়ানোর কথা, আজ তারাও অনাথ।

হাজারো রোহিঙ্গার বসত এখন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের কাঁটাতারের পাশে।

কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে মিয়ানমারের তুমব্রু আর বাংলাদেশের ঘুমধুমের মধ্যবর্তী নো-ম্যান্স ল্যান্ডেও আশ্রয় নিয়েছেন সহস্রাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী।

মাথার ওপর পলিথিনের ছাউনি আর ত্রাণের কিছুটা খাবার- এ নিয়েই কাটছে তাদের দিন-রাত।
 
পাহাড় বেয়ে কাঁটাতার ডিঙিয়ে ঝুঁকি নিয়ে জীবন বাঁচানোর এ চেষ্টা।                                          ছবি: সোহেল সারওয়ারবাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তগুলো দিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ এখন অনেকাংশেই কমে আসছে। তবে সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরেও নো-ম্যান্স ল্যান্ডের পরে কাঁটাতার ডিঙিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকতে দেখা গেছে কয়েকজন রোহিঙ্গাকে। পাহাড় বেয়ে ঝুঁকি নিয়ে জীবন বাঁচানোর এ চেষ্টা এখনো চলছে।

এপার থেকে ওপারের তুমব্রু গ্রামে ধোঁয়া উড়তেও দেখা গেছে। নো-ম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থান নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও জানান, এখনো জ্বলছে আরাকানের অনেক গ্রাম। অনেকে কেবলমাত্র জীবনটা নিয়ে পালিয়ে আসছেন।
 
কাঁটাতার পার হয়ে আসা কাদির বলেন, ‘আমাদের গ্রামে আগুন দেওয়া হয়েছে। স্ত্রী আর বাচ্চাদের আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি। ভেবেছিলাম, টিকতে পারবো। কিন্তু এখন যাদের পাচ্ছে, তাদেরকেই হত্যা করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তাই পালিয়ে এসেছি। কাঁটাতার পার হতে পারবো কি-না, জানতাম না। জীবনটা নিয়ে পার হতে পারছি এই তো অনেক। আমার স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে বালুখালি ক্যাম্পে আছে। ওখানে গিয়ে তাদের খুঁজে বের করবো’।
 
ঘুনধুম নো-ম্যান্স ল্যান্ডে থাকা শিশু শরণার্থীরা কাঁটাতারের বেড়া ধরে অনেকেই তাকিয়ে থাকে মিয়ানমারের দিকে। কাঁটাতারের সঙ্গেই যেন বসতি ওদেরও। পাঁচ বছরের শিশু জরিনার চোখ থেকে যেন পানি সরতেই চায় না। তার সামনেই হত্যা করা হয়েছে বড় চাচাকে।

বাংলানিউজকে জরিনা বলে, ‘রাতে স্বপ্নে দেখি, সবাইকে মেরে ফেলতেছে। এই বেড়ার পিছনেই আমাদের গ্রাম ছিলো। আমাদের সঙ্গের সব বাচ্চাকে মেরে ফেলা হয়েছে’।
 
নো-ম্যান্স ল্যান্ডে অবস্থান নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবেতর জীবনযাপন।  ছবি: সোহেল সারওয়ারতবে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসতে পারা পুরুষ শরণার্থীরা বলছেন, এখন আর আরাকান রাজ্যে কোনো জীবিত রোহিঙ্গা নেই।

কাঁটাতারের ওপাশটাতে তাকাতেই নাইজরের মনে পড়ে যায় তার স্ত্রী রুবির কথা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন এই রোহিঙ্গা নারী।
 
বাংলানিউজকে নাইজর বলেন, ‘হঠাৎই আর্মি চলে আসায় সবাই দৌড়াতে শুরু করলে আমার স্ত্রী রুবি মাটিতে পড়ে যান। সেনাবাহিনী তাকে গুলি করে হত্যা করে। কাঁটাতারের সামনে তাকালে রুবির কথা মনে পড়ে’।
‘আর কোনো গ্রামে কেউ বাঁইচে আছে বলে মনে হয় না। এখনো ওপাশ থেকে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। মানে কোনো না কোনো গ্রামতো জ্বলছেই’।
 
অনেক নারী এখনো জানেন না যে, স্বামী বেঁচে আছেন কি-না। অনেক শিশুও জানে না যে, বাবা ফিরবেন কি-না।

এক বছরের সন্তান কোলে জাইনূর বলেন, ‘আমার স্বামী এখনো ওই পারেই আছেন। আমাদের সীমান্ত পার করে দিয়ে তিনি চলে গেছেন। এ কাঁটাতারের ফাঁক দিয়ে এখানে এসেছিলাম। প্রায়ই মনে হয়, তিনিও বুঝি ঢুকছেন। বলেছিলেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এখনো তিনি নিজেই তো এলেন না। তুমব্রুতে আমাদের এতোসব জমি আছে, সব শেষ হয়ে যাবে’।
 
সীমান্তের ওপারে এখনো জ্বলছে আরাকানের অনেক গ্রাম।  ছবি: সোহেল সারওয়ার সীমান্তঘেঁষে ও নো-ম্যানস ল্যান্ডে  থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের খাবার-পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। পয়ো:নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে নারী-শিশুদের। যেখানে-সেখানে মল-মূত্র ত্যাগ করায় রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। অসুস্থ হয়ে পড়ছে শিশুরা।
 
মিয়ানমারের কুন্দু গ্রাম থেকে আসা রোকাইয়া বলেন, ‘আমাদের খাবার পানি নেই। ঘরের পাশেই মল-মূত্র ত্যাগ করতে হচ্ছে। অনেকেরই ডায়রিয়া, জ্বর হচ্ছে। সেই কুতুপালং চিকিৎসাকেন্দ্রে গিয়ে ওষুধ আনতে হয়। কিন্তু কিছুই করার নেই। ওপারে থাকলে এতোদিনে আমাদের মেরে ফেলতো’।
 
বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৭
ইউএম/এএসআর

** ছয়মাসের খুরশীদার দায়িত্ব নেবেন কি কেউ!
** ‘পুরুষদের করা হয়েছে জবাই, নারীদের ধর্ষণ’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।