এরপর এলো ঝড়ো হাওয়া। ১৩ সেপ্টেম্বর ভোরে গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয় মিয়ানমার আর্মি।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের কোল ঘেঁষা উখিয়া উপজেলার পালংখালি ইউনিয়নের একটি গ্রাম বটতলি। রাজিয়ার মতো নি:স্ব-রিক্ত হাজার হাজার নরনারী মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে এই সীমান্ত-গ্রামে।
জন্মস্থানের বাড়িঘর, সহায়সম্পত্তি হারিয়ে এখন তারা নি:স্ব। কেউ স্বামী, কেউ সন্তান হারিয়েছেন। কেউবা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে এসেছেন বাংলাদেশে। স্বামী সন্তান নিয়ে তাদেরেও সুখের সংসার ছিলো। জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এখন খোলা আকশের নিচে, স্কুলঘরের বারান্দায়, মাঠে-ঘাটে আশ্রয় নিয়েছেন।
পরিবারের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে গিয়ে আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন রাজিয়া। শেষ সম্বল দুই সন্তানকে নিয়ে আকুল পাথারে পড়েছেন এই নারী।
রাজিয়া বলছিলেন, স্বামী ও দেবরকে আর্মি নিয়ে যায়। মেরে ফেলেছে নাকি বেঁচে আছে কোনো কিছু জানি না। গ্রামে আগুন দিলে সবাই পালিয়ে আসে। দুই ননদকে ধর্ষণ করে ওখানে মেরে ফেলে রেখে যায়। বাচ্চা দুইটা নিয়ে এসেছি। শাশুড়ি ও জা বাংলাদেশে এসেছেন শুনেছি। খোঁজ পাইনি।
রাজিয়ার মতো দুই মাসের বাচ্চা নিয়ে মিয়ানমারেরর মণ্ডু বুদিচং গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছেন আরেক নারী সখিনা বেগম। স্বামীসহ পরিবারের সব সদস্যকে মেরে ফেললে বাচ্চা নিয়ে পালিয়ে আসেন সখিনা।
সখিনার সন্তান জন্মের পর থেকে জ্বলছে মন্ডু গ্রাম। সবাই পালিয়ে এলেও তারা আকঁড়ে পড়ে ছিলো। কিন্তু শেষরক্ষা আর হলো না। দুই মাসের বাচ্চা কোলে নিয়ে ৭ দিন অবিরাম হেঁটে আঞ্জুমান সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকেন।
স্বামী, এক সন্তান ও পরিবারে সদস্যদের হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েছেন এই রোহিঙ্গা নারী। গতকাল বাংলাদেশে আসা সখিনা কথা বলার সময় অঝোরে তার চোখ বয়ে পানি ঝরছিলো।
বাচ্চার নাম জানতে চাইলে সখিনা বলছিলো, ' নাম রাখবো কিভাবে বাবা নাই, জন্মের পর থেকেই তো গণ্ডগোল। বাঁচার কথাই নয়, সেখানে নাম দিবো কী করে।
এটুকু বলার পর আর কথা বলতে পারলেন না সখিনা। কোলের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে হুহু করে কেঁদে ফেললেন।
সখিনার গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা আরেক নারী সিরাজ খাতুন। স্বামী ও একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। একটানা সাত দিন হাঁটার কারণে দু'পা ফুলে ফোসকা পড়ে গেছে। কথা বলতে গিয়ে একটু পরপর অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছেন এই নারী।
সিরাজ খাতুনের ভাষ্যমতে, ১০ সেপ্টেম্বর ভোর চারটা। অনেকেই আগেই মিয়ানমার আর্মির অত্যাচারে বুদিচং গ্রাম থেকে পালিয়ে এসেছেন। আমরা গুছিয়ে বের হবো; এমন সময় আর্মি এসে গ্রামে আগুন দেয়। উঠানে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে গুলি করে জোয়ান পোলা জামাইকে মেরে ফেলে।
'এরপর সাতদিন পায়ে হেঁটে পরশুদিন (শনিবার) বাংলাদেশে আসি। বাংলাদেশ থাকার জায়গা না দিলে কোথায় যাব? আমাদের একটু সাহায্য করেন। '
স্থানীয়রা জানান, ৪ ও ১৭ সেপ্টেম্বরে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকেই এখনও শরণার্থী শিবিরে জায়গা পাননি। সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর স্কুল, খোলা জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে রাতে ঘুমানো খাওয়া দাওয়া সব করছেন। বৃষ্টি হলে কোনো দোকান বা বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় নিচ্ছেন।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৭
এমসি/জেএম